Published : 20 May 2025, 08:52 AM
আউট হয়ে ফেরার পর ডাগ আউটে ফিরে নির্বাক হয়ে বসেছিলেন মুহাম্মাদ ওয়াসিম। হতাশায় তোয়ালেতে মুখ লুকালেন এক পর্যায়ে। পরে লোয়ার অর্ডারদের বীরত্বে ম্যাচে যখন টানটান উত্তেজনা, তাকে দেখা গেল দু হাত তুলে স্রষ্টার কাছে প্রার্থনা করতে। শেষ ওভারের নাটকীয়তায় ম্যাচ জয়ের পর সেই মুখেই দেখা গেল চওড়া হাসি। ম্যাচের পর রোমাঞ্চে হাবুডু্বু খেয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অধিনায়ক বললেন, আনন্দ প্রকাশের ভাষা পাচ্ছেন না তিনি।
২০২৩ সালে নিউ জিল্যান্ডকে একটি টি-টোয়েন্টিতে হারিয়েছিল আরব আমিরাত। সেই ম্যাচে ২৯ বলে ৫৫ রানের ইনিংস খেলেছিলেন ওয়াসিম। আমিরাতের ক্রিকেট ইতিহাসের সবচেয়ে বড় জয় সম্ভবত সেটিই। এবার ওয়াসিমের ব্যাটে রচিত হলো তেমনই গৌরবময় আরেকটি বিজয়গাঁথা। ২০৬ রান তাড়ায় নাটকীয়তার নানা পথ বেয়ে যেভাবে বাংলাদেশকে হারিয়েছে তারা, আমিরাতের স্মরণীয়তম জয় এটিকে বললে খুব বেশি ভুল হয়তো হবে না। ৪২ বলে ৮২ রানের ইনিংস খেলে এবারও নায়ক ওয়াসিমই।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই দেশের সফলতম ব্যাটসম্যান তিনি। টি-টোয়েন্টিতে দেশের সফলতম অধিনায়কও। অথচ কয়েক বছর আগেও এই দেশ ছিল তার জন্য ‘বিদেশ’!
১৯৯৪ সালে তার জন্ম পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের মিয়াঁ চান্নু নামক শহরে। সুফি সাধক বাবা মিয়াঁ চান্নুর নামে ঐতিহাসিক শহরটির নামকরণ। গম, তুলা, আম উৎপাদন আর খুশি বারফি নামক মিষ্টান্নের জন্য বিখ্যাত শহরে ক্রিকেটের সংস্কৃতি তেমন একটা নেই। ওয়াসিম নিজেই যখন শহরের রাস্তাঘাটে টেপ টেনিস ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন, বয়স ততদিনে ১৬ হয়ে গেছে!
টেপ টেনিসে প্রতিভার ছাপ রেখে নজর কাড়েন। ক্রিকেট বলে সত্যিকারের ক্রিকেট শিক্ষার শুরু হয় রাশিদ লাতিফের একাডেমিতে। মিঁয়া চান্নু থেকে ৮০ কিলোমিটার দূরের শহর বুরেওয়ালায় সাবেকে ওই পাকিস্তানি অধিনায়কের একাডেমিতে যখন তিনি যান, বয়স হয়ে গেছে ১৮।
শিক্ষার পালা চলতে থাকে। পাকিস্তানে বিভিন্ন পর্যায়ে ক্রিকেট খেলতে থাকেন। কিন্তু দ্রুতই বুঝে ফেলেন, নিজ দেশে তিনি হলে পানি পাবেন না। অনিশ্চিত ভবিষ্যতের সময়টায় নিশ্চয়তার হাতছানি আসে। সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি কোম্পানি থেকে প্রস্তাব পান। তাদের হয়ে কাজ করার পাশাপাশি ক্রিকেট খেলতে হবে, মিলবে রেসিডেন্সি ভিসা। তিনি লুফে নেন। ২৩ বছর বয়সে পাড়ি জমান আমিরাতে।
আমিরাতের নানা প্রান্তে ক্লাব ক্রিকেট খেলতে থাকন। আবু ধাবি টি-টেন ক্রিকেটে সুযোগ মেলে। ২০১৯ আসরে শিরোপার স্বাদ পান মারাঠা অ্যারাবিয়ান্সের হয়ে। তবে স্রেফ স্কোয়াডের অংশ হিসেবে, মাঠে নামার সুযোগই পাননি!
তার ভাগ্য বদলের শুরু ২০২১ টি-টেন লিগ থেকে। এক ম্যাচে ২৪ বলে ৭৬ করে প্রথম নজর কাড়েন। তবে সত্যিকারের সাড়া জাগান ওই আসরেই এক ম্যাচে ৭ ছক্কায় ১৩ বলে ৫৬ রান করে। সেবার আমিরাতের ডি২০ টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ৫৩৪ রানও করেন।
সেই পথ ধরেই ২০২১ সালের ৫ অক্টোবর টি-টোয়েন্টি অভিষেক নামিবিয়ার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে। অভিষেকে ৩৯ রানের পর চতুর্থ ম্যাচেই আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে করেন ৬২ বলে অপরাজিত ১০৭। দুই ম্যাচ পর ওমানের বিপক্ষে ৪৪ বলে ৮৪, কিছুদিন পর আবার আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে করেন ৬৬ বলে ১১২। আর পেছনে তাকাতে হয়নি তাকে। ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি দুই সংস্করণেই দলের গুরুত্বপূর্ণ ক্রিকেটার হয়ে ওঠেন দ্রুতই।
সেই সাফল্যের পথে ছুটছেন এখনও। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, তার অভিষেকের সময়টা থেকে এই পর্যন্ত আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টিতে গোটা বিশ্বে সবচেয়ে বেশি রান তারই!
৭০ ইনিংস খেলে ২ হাজার ৬৫১ রান করেছেন তিনি ৪০.১৬ ও ১৫৬.১২ স্ট্রাইক রেটে। তার চেয়ে ৫ ইনিংস বেশি খেলে ২ হাজার ১৯২ রান কম করে দুইয়ে সুরিয়াকুমার ইয়াদাভ।
তিনটি সেঞ্চুরি করেছেন এই সংস্করণে, সহযোগী দেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে যা যৌথভাবে রেকর্ড।
বাংলাদেশের বিপক্ষে সোমবার সম্ভাবনা জাগিয়েও সেঞ্চুরি করতে পারেননি। তবে এত বড় রান তাড়ায় যেভাবে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন, তার ক্যারিয়ারের সেরা ইনিংসগুলির একটি এটি নিঃসন্দেহে।
ম্যাচের পর তার উচ্ছ্বাসও ছিল তেমনই। ২০৬ রানের লক্ষ্য পেলেও জয়ের বিশ্বাস তার ছিল বলে জানালেন ৩১ বছর বয়সী ব্যাটসম্যান।
“ভাষায় বোঝতে পারব না (কেমন লাগছে)…। খুব ভালো লাগছে বাংলাদেশকে হারাতে পেরে। দলের পারফরম্যান্সে খুবই আনন্দিত আমি।”
“সবাইকে আশা দেখাচ্ছিলাম যে আমরা এই রান তাড়া করতে পারি। কারণ, আমরা এখানে সবসময় খেলে থাকি এবং কন্ডিশন আমাদের জানা। আমাদের আশা ছিল যে আমরা রান তাড়া করতে পারব। আমি চেষ্টা করেছি আমার সহজাত ব্যাটিং করতে।”
তিনি আউট হওয়ার পরও অবশ্য বেশ কিছুটা পথ পাড়ি দেওয়া চ্যালেঞ্জ ছিল দলের। তখনও ৩১ বলে প্রয়োজন ৫৮ রানের। পরের দিকের ব্যাটসম্যানরা সবাই একটু একটু করে অবদান রেখে দলকে পৌঁছে দেন লক্ষ্যে। নিজে আউট হয়ে গেলেও সতীর্থদের ওপর বিশ্বাসটা ছিল তার।
“আমরা আশা ছাড়িনি। বিশ্বাস রেখে গেছি। শেষ দিকে ধ্রুব (পারাশার) ছক্কা মেরেছে একটি, হায়দারও একটি মেরেছে। আশা ছিল যে পারব।”
নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে সেবার একটি ম্যাচ জিতলেও তিন ম্যাচের সিরিজ জেতা হয়নি আমিরাতের। এবার বাংলাদেশের বিপক্ষে সেই সাফল্যের দেখা চান ওয়াসিম।
“আমরা নিজেদের শক্তিমত্তা অনুযায়ী খেলব এবং ২-১ বানানোর চেষ্টা করব।”
সিরিজের তৃতীয় ম্যাচটি বুধবার।