Published : 07 Jun 2025, 10:32 PM
চট্টগ্রামে আড়তদারদের বিরুদ্ধে দাম কম দেওয়ার অভিযোগ তুলেছেন মৌসুমি ব্যবসায়ীরা।
কলেজ শিক্ষার্থী তুষার বিকালে বলছিলেন, তারা কয়েক বন্ধু মিলে আগ্রাবাদের দায়য়া পাড়া এলাকা থেকে ৭০০/৮০০ টাকা দরে গরুর ৪১টি চামড়া কেনেন। এরপর বিক্রির জন্য দুপুরে সেসব নিয়ে আসেন আগ্রাবাদের চৌমুহুনী এলাকায়। কিন্তু বিকাল পাঁচটাতেও একটি চামড়া বিক্রি করতে পারেননি।
চট্টগ্রাম নগরীর বিভিন্ন পাড়া মহল্লা থেকে যা কিছু চামড়া কেনাবেচা হয়, সেগুলোর বেশির ভাগ নিয়ে আসা হয় আগ্রাবাদের চৌমুহুনী এলাকায়। সেখান থেকে আড়াতদারের প্রতিনিধিরা চামড়াগুলো কিনে নেন। আবার কেউ কেউ চামড়া এনে চৌমুহুনীর মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে যান।
তুষার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, চামড়া বিক্রি করতে দুপুরে চৌমুহুনী এলাকায় আসলেও বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত তারা কোনো চামড়া বিক্রি করতে পারেনি।
তার ভাষ্য, আড়তদারদের সঙ্গে ‘সিন্ডিকেট’ করে কিছু লোক অল্প দামে চামড়া কেনার চেষ্টা করছে। ৭০০/৮০০ টাকায় তারা চামড়া কিনে আনলেও সেগুলো দর করা হচ্ছে সাড়ে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা।
শনিবার বিকালে নগরীর চৌমুহুনী এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন পাড়া মহল্লা থেকে কিছু লোক রিকশা কিংবা ভ্যানে করে চামড়া নিয়ে আসছেন সেখানে। তাদের কেউ সরাসরি আড়তদারের প্রতিনিধির কাছে বিক্রির জন্য অপেক্ষা করছেন; আবার কেউ কেউ সেখানে থাকা অন্যান্য মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছে চামড়া বিক্রি করে চলে যাচ্ছেন।
বিভিন্ন পাড়া থেকে চামড়া নিয়ে আসা লোকজনের অভিযোগ, চৌমুহুনী এলাকায় কিছু মৌসুমী ব্যবসায়ী আছেন, যারা সরাসরি আড়তদারদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের প্রতিনিধির মত কাজ করেন। তারা দামে চামড়া কিনে বেশি দামে আড়তদারদের কাছে বিক্রি করেন।
নাছের নামের এক মৌসুমী ব্যবসায়ী বলেন, “৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা দরে চামড়া কিনেছি। কিছু লাভে সেগুলো বিক্রি করে দেব। কিন্তু বিকাল ৫টা পর্যন্ত কোনো আড়তদারের লোক আসেনি।”
আলম সওদাগর নামে এক মৌসুমী ব্যবসায়ী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কয়েক দশক ধরে তিনি মৌসুমী চামড়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত।
“এমনও একটা সময় ছিল যখন লাখ টাকা লাভ হতো এ ব্যবসায়। তবে গত কয়েক বছরে ২০/২৫ হাজার টাকা লাভ করতেও কষ্ট হচ্ছে।”
একটা সময় কোরবানির পর চামড়া সংগ্রহে এলাকার উঠতি যুবকদের দৌড়াদৌড়ি ছিল বিভিন্ন অলিগলির চিরচেনা রূপ। তবে কয়েক বছর ধরে বন্দরনগরীতে তা কেবলই ‘স্মৃতি’। কোরবানির পশুর চামড়া নিয়ে টানাটানি, উত্তেজনা কিছুই নেই।
আলম সওদাগর বলেন, “আকার বুঝে সকালে ৬০০ টাকা দরে চামড়া কিনেছিলাম। বিকাল পর্যন্ত ৩০০টি চামড়া সংগ্রহ করেছি। কিন্তু কোনো আড়াতদার আসেনি।
“তাই বিকালে আমরা চামড়া কিনছি সাড়ে ৪০০ টাকা করে। শ’খানেক টাকা লাভে সেগুলো আড়তদাদের কাছে বিক্রি করব।”
ঈদের দিন দুপুরের পর থেকে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহ শুরু করেন আড়তদাররা। আড়তদারের প্রতিনিধি ও মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন যানবাহনে করে চামড়া নিয়ে যাচ্ছে আতুড়ার ডিপো এলাকায়। সেখানেই রয়েছে নগরীর কাঁচা চামড়ার সব আড়ত।
চামড়ার কম দর নিয়ে অভিযোগ প্রতিবারই
কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের দাম ঠিক করে দিয়েছে সরকার; এবার গরুর চামড়ার দাম গতবারের চেয়ে ৫ টাকা করে বাড়ানো হয়েছে।
ট্যানারি ব্যবসায়ীদের এবার ঢাকায় লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া কিনতে হবে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়; গত বছর এই দাম ছিল ৫৫ থেকে ৬০ টাকা।
ঢাকার বাইরে লবণযুক্ত প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়ার দাম হবে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা, গতবছর যা ৫০ থেকে ৫৫ টাকা ছিল।
এছাড়া সারা দেশে লবণযুক্ত খাসির চামড়া প্রতি বর্গফুট ২২ থেকে ২৭ টাকা দরে বিক্রি হবে ট্যানারিতে, যা গত বছর ছিল ২০ টাকা থেকে ২৫ টাকা। আর বকরির চামড়ার প্রতি বর্গফুটের দাম ২০ থেকে ২২ টাকা, যা গতবার ছিল ১৮ থেকে ২০ টাকা।
আড়তদারদের কাছ থেকে লবণযুক্ত চামড়া বর্গ ফুট হিসেবে কেনেন ট্যানাররা। আর আড়তদার ও ফড়িয়ারা চামড়া কেনেন গড়পরতা আকার ধরে।
মৌসুমী ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, আড়তদাররা নির্দিষ্ট সময়ে চামড়া সংগ্রহ না করে দাম কমাতে বাধ্য করে থাকে।
তবে আড়তদারদের ‘সিন্ডিকেট’ করার কোনো সুযোগ নেই বলে ভাষ্য চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির।
সংগঠনটির সাবেক সহ-সভাপতি আব্দুল কাদের বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা একটি চামড়া সর্বোচ্চ এক মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে পারব। তারপর সেগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। প্রক্রিয়াজাত করে ট্যানারিতে চামড়া সংরক্ষণ করতে পারে।”
কাদেরের ভাষ্য, সরকারের বেঁধে দেওয়া দামটি সংরক্ষণের পরের দাম, যা অনেক কোরবানি দাতা কিংবা মৌসুমী ব্যবসায়ীরা বোঝেন না। তারা মনে করেন সরকারের বেঁধে দেওয়া দামে আড়তদাররা চামড়া কিনবেন মৌসুমী ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। এ কারণে অনেকেই চামড়া বিক্রি না করে রেখে দেন এবং পরে আড়তদারদের দায়ী করেন।
কাদেরের দাবি, একটি চামড়া সংগ্রহের পর সংরক্ষণ করে ঢাকায় ট্যানারির কাছে বিক্রি পর্যন্ত ৪৯৮ টাকা খরচ হয়। ঢাকায় খরচ কম হলেও সরকার প্রতিবার ঢাকায় বেশি দাম ঠিক করে।
“চট্টগ্রামে একটি মাত্র ট্যানারি আছে, যার কারণে আমাদের ঢাকার ট্যানারিগুলোর ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। তারা যে দামে বিক্রি করতে বাধ্য করে, সে দামে আমাদের বিক্রি করতে হয়।”
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমিতির সাবেক সভাপতি মুসলিম উদ্দিন সম্প্রতি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, তাদের সমিতির বর্তমান সদস্য সংখ্যা ১১২ হলেও তাদের মধ্যে চামড়া সংগ্রহ করেন জনা ত্রিশেক আড়তদার।
আড়তদার মুসলিম বলেন, “আগে চট্টগ্রামে ২২টি ট্যানারি ছিল; এখন আছে একটি। এ ট্যানারি আমাদের কাছ থেকে ৪০ হাজারের মত চামড়া সংগ্রহ করে। বাকি চামড়া বিক্রির জন্য আমরা ঢাকার ট্যানারিগুলোর উপর নির্ভরশীল।”
চামড়া সংগ্রহে গাউসিয়া কমিটি
আঞ্জুমানে রহমানিয়া আহম্মদিয়া সুন্নীয়া ট্রাস্টের অধীনে দেশে পরিচালিত হয় দুই শতাধিক সুন্নীয়া মাদ্রাসা। এ ট্রাস্টের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন গাউসিয়া কমিটি। মহামারীর মধ্যে কোভিডে মৃতদের সৎকারের মত কাজে সহায়তা দিয়ে এ সংগঠন আলোচনায় আসে।
গত কয়েক বছর ধরে গাউসিয়া কমিটির সদস্যরা বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গিয়ে চামড়া সংগ্রহের কাজ শুরু করে। পরে সেগুলো আড়তদারদের কাছে বিক্রি করেন।
এবার নগরী এবং উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামে প্রায় তিন হাজারকর্মী বিভিন্ন বাসা বাড়িতে গিয়ে চামড়া সংগ্রহ করছেন।
মোহাম্মদ আলী নামে এক আড়তদার এবারও গাউসিয়া কমিটির নগরীর চামড়া কিনে নিচ্ছেন। গাউসিয়া কমিটির সংগ্রহ করা চামড়াগুলো এ আড়তদারের লোকজন সংরক্ষণ করছে।
চামড়া সংরক্ষণ শুরু
বাংলাদেশে পশুর চামড়ার যে চাহিদা- তার ৮০-৯০ শতাংশই পূরণ হয় কোরবানির ঈদে জবাই করা পশু থেকে। ফলে এটাই চামড়া সংগ্রহের মূল মৌসুম।
আতুড়ার ডিপো এলাকায় যেসব চামড়া নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, সেসব চামড়া লবণ দিয়ে সংরক্ষণের কাজ শুরু করে দিয়েছেন আড়তদাররা।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাবেক সহ-সভাপতি আবদুল কাদের বলেন, “আমরা এবছর সাড়ে চার লাখ চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ করলেও তা চার লাখের বেশি হবে বলে মনে হয় না।
“আমাদের সদস্যদের যারা চামড়া সংগ্রহ করছেন, তারা বিভিন্ন মসজিদ মাদ্রাসার সাথেও যোগাযোগ করে চামড়া কিনছেন। তাদের কাছ থেকে খবর নিয়েছি প্রায় দেড় লাখের মত চামড়া ইতোমধ্যে সংগ্রহ হয়েছে।”
কাদের আরও বলেন, “আগে বিভিন্ন মাদ্রাসা থেকে চামড়া দিনে দিনে আড়তে নিয়ে আসা হতো। এবার সরকারের পক্ষ থেকে লবণ বিতরণ করা হয়েছে। এটি ভালো একটি দিক।
“যার ফলে মাদ্রাসাগুলোতে চামড়া সংগ্রহ করে রাখতে পারবে। চামড়া নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা কম।”
বাংলাদেশে সারা বছর যে সংখ্যক পশু জবাই হয়, তার মোটামুটি অর্ধেক হয় এই কোরবানির মৌসুমে। কোরবানি যারা দেন, তাদের কাছ থেকে কাঁচা চামড়া কিনে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা বিক্রি করেন পাইকারদের কাছে।
পাইকাররা সেই চামড়ায় লবণ দিয়ে সংরক্ষণের প্রাথমিক কাজটি সেরে বিক্রি করেন ট্যানারিতে। ট্যানারি কেমন দামে চামড়া কিনবে, তা প্রতিবছর নির্ধারণ করে দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
কোরবানি: সাড়ে চার লাখ চামড়া কেনার লক্ষ্য চট্টগ্রামের আড়তদারদের