Published : 17 Jun 2025, 08:26 PM
বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রাম জেলায় ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। তবে সিভিল সার্জন বলছেন, পরিস্থিতি এখনো ‘আশঙ্কাজনক নয়’।
নিয়মিত ওষুধ ছিটানো কার্যক্রমে ভরসা রেখে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এগোচ্ছে সিটি করপোরেশন। চলতি মাসের বাকি দিনগুলোতে জনসচেতনতা তৈরির পর সংস্থাটি জুলাই থেকে এইডিস মশার আবাসস্থল ধ্বংসে অভিযানে নামতে চায়।
চিকিৎসকরা বলছেন, এবার যারা ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন, তাদের মধ্যে গুরুতর রোগী খুব কম। মূলত জ্বর ও রক্তের প্লাটিলেট কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। তাই বাসায় থেকেই বেশিরভাগ রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে।
চট্টগ্রামে চলতি মৌসুমে প্রথম বৃষ্টি হয় ২০ মে রাতে। এরপর ২৯ মে রাতে ভারি বৃষ্টি হয়। এরপর জুনের প্রথম সপ্তাহে কয়েকদিন গড়ে ৫ থেকে ৭ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় জেলায়। এইডিস মশার লার্ভা থেকে পূর্ণাঙ্গ মশা হতে ৪ থেকে ৭ দিন সময় লাগে।
চট্টগ্রামে চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী গত তিন বছরের চেয়ে বেশি। ২০২২ সালে জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ৫ মাসে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছিল ১৭ জন।
২০২৩ সালে প্রথম পাঁচ মাসে ১৮২ জন এবং ২০২৪ সালে একই সময়ে মোট ১৫৭ জন রোগী শনাক্ত হয়।
আর চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে জেলায় ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে ২৬৯ জন। এর মধ্যে মে মাসেই শনাক্ত হয়েছে ১১৬ জন।
২০২২ সালে মে মাসে কোনো ডেঙ্গু রোগী ছিল না। ২০২৩ সালে এই সংখ্যা ছিল ৫৩ জন এবং গত বছর ১৭ জন।
চলতি জুন মাসে প্রথম ১৬ দিনে জেলায় ৫০ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছে। অথচ ২০২৪ সালে পুরো জুন মাসে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছিল ৪১ জন।
তবে ২০২৩ সালের জুনে ২৮৩ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়। সেবছর জেলায় ১৪ হাজার ৮৭ জন ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয়েছিল, যা গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
রোগী সংখ্যা বাড়তে শুরু করলেও এখন পর্যন্ত মৃত্যুর হার গত কয়েক বছরের তুলনায় কম। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ২ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে।
চট্টগ্রাম জেলার সিভিল সার্জন জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত মাসে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়েছিল ১১৬ জনের। চলতি মাসে এখন পর্যন্ত ৫০ জন। পরিস্থিতি আশঙ্কাজনক নয়। তবে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। রোগীদের সেবা দিতে আমাদের সবরকম প্রস্তুতি আছে।”
জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রতিবেদন অনুসারে, এ বছর জেলায় সবচেয়ে বেশি ১৮১ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
সেখানকার পরিচালক ব্রিগেডিয়ারে জেনারেল মোহাম্মদ তসলিম উদ্দীন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সোমবারও আমাদের হাসপাতালে নয়জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিল। আউটডোরে অনেক রোগী আসছে। আমরা ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় বেশি নজর দিচ্ছি।
“প্রবণতা দেখে ধারণা করছি, জুলাইতে রোগীর সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে বাড়তে পারে। কারো ডেঙ্গু শনাক্ত হলে অবশ্যই বিশ্রামে থাকতে হবে। রক্তের প্লাটিলেট অনেক বেশি কমে গেলে অবশ্যই দ্রুত হাসপাতালে আসতে হবে।”
চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের বর্হিবিভাগেও প্রতিদিন কয়েকজন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিচ্ছে বলে জানান হাসপাতালটির তত্ত্বাবধায়ক ডা. আকরাম হোসেন।
তিনি বলেন, “আমাদের এখানে কোনো ডেঙ্গু রোগী ভর্তি নেই। তবে আউটডোরে প্রতিদিন রোগী আসছে। তাদের জ্বর এবং প্লাটিলেট কমার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এখনো পর্যন্ত গুরুতর কোনো রোগী পাইনি। রোগীদের সেবার জন্য আলাদা ফিভার কর্নার করা হয়েছে। সেখানে জ্বর নিয়ে আসা রোগীদের স্ক্রিনিং করা হচ্ছে।”
জেলার সীতাকুণ্ড উপজেলার ফৌজদারহাটে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজেসে (বিআইটিআইডি) এ বছর ৩৩ জন ডেঙ্গু রোগী চিকিৎসা নিয়েছে।
ডেঙ্গু নিয়ে গবেষণাকারী বিআইটিআইডির ক্লিনিক্যাল ট্রপিক্যাল মেডিসিনের অধ্যাপক মামুনুর রশিদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সম্প্রতি দিনে ১-৩ জন ডেঙ্গু রোগী আসছে। তবে তাদের কারো স্বাস্থ্য পরিস্থিতি মারাত্মক নয়।
“ডেঙ্গু এখন শুধু বর্ষায় বাড়ে এমন নয়। ডেঙ্গু বাংলাদেশে এখন সারা বছরের রোগে পরিণত হয়েছে। ডেঙ্গুকে এখন এনডেমিক (কোনো রোগ যখন একটি এলাকার জনগোষ্ঠীর মধ্যে সারাবছর থাকে) বলা যেতে পারে। তাই সবসময় এইডিস মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় থাকতে হবে।”
চট্টগ্রাম নগরীতে জরিপ চালিয়ে এইডিস মশার বিস্তার ও ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যার ভিত্তিতে বিভিন্ন জোনে চিহ্নিত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। চলতি বছর সে কাজ এখনো শুরু হয়নি।
জেলা কীটতত্ত্ববিদ মো. মাঈনুদ্দিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “ডেঙ্গুর হেভি ফ্লো এখনো শুরু হয়নি। তবে নিয়মিত রোগী শনাক্ত হচ্ছে।
“স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দল আসলে তাদের সাথে আমরা জরিপের কাজ করে থাকি। অধিদপ্তর থেকে এখনো এ বিষয়ে কোনো নির্দেশনা আসেনি। গত ফেব্রুয়ারিতে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) একটি দল জরিপ করে গেছে। তবে সেটির ফলাফল আমরা এখনো হাতে পাইনি।”
নগরীতে মশার বিস্তার নিয়ন্ত্রণে কাজ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন।
নগর সংস্থার ম্যালেরিয়া ও মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বছরব্যাপী আমাদের স্প্রে ও ফগিং কার্যক্রম চলে। জেলা সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্যের ভিত্তিতে যেসব এলাকায় রোগী বেশি, সেখানে আমরা এইডিস মশা নিয়ন্ত্রণে বেশি কাজ করি।
“আগামী সপ্তাহ থেকে জনসচতেনতা বাড়াতে এলাকাভিত্তিক প্রচারণা শুরু হবে। তারপর জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে নির্মাণাধীন ভবন, পরিত্যক্ত অবকাঠামো বা পণ্য এবং পানি জমে থাকে- এমন সরঞ্জাম অপসারণে এনফোর্সমেন্ট শুরু করব।”
এইডিস মশা ও লার্ভা নিয়ন্ত্রণে পর্যাপ্ত সরঞ্জাম ও ওষুধ আছে জানিয়ে মাহি বলেন, “খাল-নালায় আবর্জনা না থাকায় এবার ওষুধ ছিটানো কার্যকর হবে বলে আশা করছি।
“আইইডিসিআরের ফেব্রুয়ারির জরিপের ফল এখনো পাইনি। এটা জরুরি, কারণ বর্ষার আগের জরিপ ও পরের জরিপের ফলাফল পেলে তুলনা করা যায় আমাদের কার্যক্রম কতটা সফল হয়েছে।”
চলতি বছর এখন পর্যন্ত শনাক্ত রোগীদের মধ্যে ১৬ জন নগরীর এবং বাকি ৩৪ জন বিভিন্ন উপজেলার বাসিন্দা জানিয়ে মশক নিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তা শরফুল ইসলাম মাহি বলেন, “আমরা শুধু নগরীতে কাজ করি। কয়েকটি উপজেলায় নিয়মিত ডেঙ্গু রোগী শনাক্তের তথ্য আসছে।
“বর্ষায় বাড়িঘর ও আশেপাশের স্থানে পানি জমে থাকে। প্রত্যেক বাসাবাড়িতে কোথাও যাতে পানি জমে না থাকে, সে বিষয়ে সচেতন থাকা এবং জমা পানি নিয়মিত পরিষ্কার করা খুব জরুরি।”