Published : 26 Dec 2023, 11:45 PM
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে অনেক আসনে নৌকার প্রার্থীদের যেখানে নিজের দলের স্বতন্ত্র প্রার্থির প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, সেখানে চট্টগ্রামের চার আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা অনেকটাই ‘ভারমুক্ত’।
চট্টগ্রাম-৭ আসনে তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, চট্টগ্রাম-৯ আসনে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, চট্টগ্রাম-১৩ আসনে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ এবং চট্টগ্রাম-৬ আসনে বর্তমান এমপি এবিএম ফজলে করিম চৌধুরীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়া কোনো আওয়ামী লীগ নেতার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না।
বিএনপিবিহীন নির্বাচনে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বি না থাকায় এই তিন মন্ত্রী ও এক এমপির নির্বাচনি বৈতরণী পার হওয়া ‘অনেকটাই সহজ’ হয়ে গেছে বলে মনে করছেন স্থানীয় ভোটাররা।
যদিও বিষয়টিকে সেভাবে না দেখে প্রার্থী ও তাদের নিবার্চনি সমন্বয়কারীরা বলছেন, ভোটে অন্য দলের প্রার্থীদের সঙ্গে লড়াইটাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
আর এসব আসনে আওয়ামী লীগের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী না হওয়ার ব্যাখ্যায় তারা বলছেন, নিজ নিজ এলাকায় তাদের ‘জনপ্রিয়তা’ এবং ‘দলীয় সংহতির’ কারণে আসনগুলোতে দলের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হননি।
বিএনপিসহ অধিকাংশ দল ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। সেবার অর্ধেকের বেশি আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় পান, যা নিয়ে এখনও সমালোচনা সইতে হয় ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় থাকা দলটিকে।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে এবারও নির্বাচন বর্জন করেছে বিএনপি ও সমমনা দলগুলো। এ পরিস্থিতিতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয় এড়াতে এবং ভোট ‘অংশগ্রহণমূলক’ দেখাতে নৌকার মনোনীত প্রার্থীদের বাইরে দলের অন্যদেরও স্বতন্ত্র হিসেবে প্রার্থী হতে উৎসাহ দিয়েছে আওয়ামী লীগ; তাতে সাড়াও মিলেছে।
শতাধিক আসনে আওয়ামী লীগের নেতারা নৌকার প্রার্থীর বিপক্ষে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় দাঁড়িয়ে গেছেন। বর্তমান এমপি হয়েও যারা নৌকার টিকেট পাননি, তাদের অনেকে লড়ছেন স্বতন্ত্র হয়ে। প্রভাব বা জনপ্রিয়তার দিক দিয়ে তারাও পিছিয়ে নেই।
এই স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অনেক আসনে জয়-পরাজয়ের অংকে ‘সমানে সমান’ টক্কর দিচ্ছেন, ফলে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে গেছেন নৌকার প্রার্থীরা। আধিপত্য দেখাতে গিয়ে স্বতন্ত্র ও নৌকার সমর্থকরা সংঘাতেও জড়িয়েছেন কোথাও কোথাও।
এবারের নির্বাচনে চট্টগ্রামের ১৬টি সংসদীয় আসনের মধ্যে দুটি জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। নয়টিতে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে জোর টক্কর দিচ্ছেন।
জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া দুটি আসনেও আওয়ামী লীগের মোট চারজন স্বতন্ত্র প্রার্থী লড়াইয়ে আছেন। আগামী ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে তারা শেষ পর্যন্ত মাঠে থাকার ঘোষণা দিয়েছেন।
চট্টগ্রাম- ৬
রাউজান নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-৬ আসনে আওয়ামী লীগের এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন চারজন।
তারা হলেন- জাতীয় পার্টির মো. শফিউল আলম চৌধুরী, তৃণমূল বিএনপির মো. ইয়াহিয়া জিয়া চৌধুরী, ইসলামিক ফ্রন্টের স ম জাফর উল্লাহ ও স্বতন্ত্র প্রার্থী শফিউল আজম।
৩ লাখ ৩৮ হাজার ২০৬ ভোটারের এই আসনে প্রচার শুরুর পর থেকেই ফজলে করিম রাউজানের বিভিন্ন এলাকা চষে বেড়াচ্ছেন। ইসলামী ফ্রন্ট ছাড়া অন্য প্রার্থীদের ভোটের প্রচার ‘তেমন নেই’।
২০০১ সালের সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে প্রথমবার সংসদ সদস্য হন ফজলে করিম। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ের ধারাবাহিকতায় ২০২৪ সালের নির্বাচনেও নৌকার টিকেট পেয়েছেন তিনি।
স্থানীয়রা বলছেন, বিএনপি নির্বাচনে না আসায়, শক্তিশালী কোনো প্রার্থী না থাকায় অতীতের ধারাবাহিকতায় আবারও ‘জয়ের পথে’ রয়েছেন নৌকার প্রার্থী।
নাম প্রকাশ না করে রাউজানের নোয়াপাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, “এই আসনে ছোট দলের কয়েকজন প্রতিদ্বন্দ্বী আছেন মাত্র। দলের (আওয়ামী লীগের) বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র কোনো প্রার্থী না থাকায় উনার বিজয় অনেকটা নিশ্চিত।”
জানতে চাইলে ফজলে করিম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার আসনে আরও চারজন প্রার্থী দাঁড়িয়েছেন। তাদের সকলকেই বলেছি স্বচ্ছতার সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে প্রচার চালাতে। রাউজানে বিগত সময়ে সর্বোচ্চ উন্নয়ন করেছি। জনগণ আমার সাথে রয়েছে।
“নির্বাচনে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না এলে আমার কী করার আছে? কেউ দাঁড়াল না কেন, সেটা তাদের বিষয়। নির্বাচনে ভোটাররা স্বচ্ছতার সঙ্গে ভোট দেবে বলে আশা করি।”
চট্টগ্রাম-৭
রাঙ্গুনিয়ার এ আসনটিতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিএনপির সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে পরাজিত করে প্রথমবার সংসদ সদস্য হন আওয়ামী লীগের হাছান মাহমুদ, পরের নির্বাচনগুলোতেও তিনি জয় পান।
এবারের নির্বাচনে প্রচারের শুরুর থেকেই গণসংযোগ, আলোচনা, সমাবেশ এবং বিভিন্ন বৈঠকের মধ্য দিয়ে ভোটারদের কাছে যাচ্ছেন দলের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। পোস্টারে ছেয়ে ফেলেছেন গোটা এলাকা। অন্য প্রার্থীদের ভোটের ‘প্রচার নেই তেমন’।
তার সঙ্গে এবার আসনটিতে বিভিন্ন দলের আরও পাঁচজন প্রার্থী রয়েছেন। আওয়ামী লীগের কেউ স্বতন্ত্র প্রার্থী হননি রাঙ্গুনিয়ায়।
নির্বাচনে ‘ভারমুক্ত’ থাকার বিষয়ে এক প্রশ্নে হাছান মাহমুদের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার শামসুল আলম তালুকদার বলেন, “সবার অংশগ্রহণে প্রতিনিধিত্বমূলক নির্বাচনের লক্ষ্যে আমরা নির্বাচনি প্রচার চালাচ্ছি। প্রতিদিনই সভা-সমাবেশ ও গণসংযোগের মধ্য দিয়ে আমাদের প্রার্থী ভোটারদের দুয়ারে যাচ্ছেন, ভোট প্রার্থনা করছেন।
“তবে আমাদের চ্যালেঞ্জ হল অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে নিয়ে আসা।…নির্বাচনে শুধু জিততে হবে তা নয়, আমাদের সাংগঠনিক কাজ সুবিধাজনক পর্যায়ে থাকলেও এটাকে আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছি।”
৩ লাখ ১২ হাজার ৮৫৬ ভোটারের এই আসনে হাছান মাহমুদের সঙ্গে লড়াইয়ে আছেন ইসলামিক ফ্রন্টের আহমদ রেজা, তৃণমূল বিএনপির খোরশেদ আলম, জাতীয় পার্টির মুছা আহমেদ রানা, ইসলামী ফ্রন্টের মুহাম্মদ ইকবাল হাছান ও সুপ্রিম পার্টির মোরশেদ আলম।
চট্টগ্রাম-৯
বন্দর নগরীর কোতোয়ালি ও বাকলিয়া থানা মিলিয়ে এই আসন। ভোটের প্রচার ঘিরে আন্দরকিল্লা, চেরাগী পাহাড়, দেওয়ান বাজার, জামালখান, চকবাজার, মিয়াখান নগর, খাতুনগঞ্জ, আসাদগঞ্জ বাকলিয়াসহ বিভিন্ন এলাকায় নৌকা প্রতীকের প্রার্থীর মহিবুল হাসান চৌধুরীর পোস্টার ও নির্বাচনি ক্যাম্প দেখা গেছে।
তার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ন্যাপ, তৃণমূল বিএনপি, ইসলামী ফ্রন্ট, কল্যাণ পার্টিসহ ছয় দলের প্রার্থী থাকলেও আওয়ামী লীগের স্বতন্ত্র কেউ নেই।
কয়েকটি এলাকায় ইসলামিক ফ্রন্টের ওয়াহেদ মুরাদ, তৃণমূল বিএনপির সুজিত সরকারের হাতেগোনা কিছু পোস্টারের দেখা মিলেছে। ১৮ ডিসেম্বর প্রতীক বরাদ্দের মধ্য দিয়ে নির্বাচনি প্রচার শুরু হলেও নওফেল ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থীর নির্বাচনি গণসংযোগ তেমন একটা চোখে না পড়ার কথা বলছেন স্থানীয়রা।
খাতুনগঞ্জ এলাকার ভোটার সাইফুল ইসলাম বলেন, “এই আসনে নৌকার প্রার্থী ছাড়া অন্য কারও প্রচার এখনও পর্যন্ত দেখিনি। পোস্টারও তেমন একটা নেই। নওফেল সাহেব ছাড়া এ এলাকায় কোন প্রার্থীই শক্তিশালী না।”
আওয়ামী লীগের সঙ্গে কেউ স্বতন্ত্র হিসেবে নির্বাচন না করায় লড়াই তেমন একটা ‘জমবে না’ মন্তব্য করে সাইফুল বলেন, “এখানে নৌকার প্রার্থী সহজেই জিতবে।”
আসনটিতে মোট ভোটার ৪ লাখ ১৭ হাজার ৯৪৭ জন। নওফেলের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আছেন ন্যাপের মিটুল দাশগুপ্ত, ইসলামী ফ্রন্টের আবু আজম, ইসলামিক ফ্রন্টের মুহাম্মদ ওয়াহেদ মুরাদ, কল্যাণ পার্টির মোহাম্মদ নুরুল হোসাইন, জাতীয় পার্টির সানজিদ রশীদ চৌধুরী ও তৃণমূল বিএনপির সুজিত সরকার।
চট্টগ্রামের অন্য প্রার্থীদের চেয়ে ‘নিভার্র’ থাকা প্রসঙ্গে মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “নেত্রী বলেছেন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন না হতে। অন্য আসনে যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন সেটা তাদের বিষয়। হতে পারে নেত্রীর সিদ্ধান্তের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমাদের দলের নেতাকর্মীরা এ আসনে নির্বাচনে আসেননি।”
২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে প্রথমবার এ আসনের এমপি হন সাবেক সিটি মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর ছেলে নওফেল। ওই সময় নওফেল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। পরবর্তীতে তাকে শিক্ষা উপমন্ত্রী করা হয়।
চট্টগ্রাম-১৩
আনোয়ারা-কর্ণফুলী নিয়ে গঠিত চট্টগ্রাম-১৩ আসনে ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ প্রতিদিনই নির্বাচনি প্রচারে বের হচ্ছেন।
তার প্রধান নির্বাচনি এজেন্ট রিদুয়ানুল করিম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমাদের প্রার্থী কয়েক মেয়াদে সংসদ সদস্য হিসেবে সফলতার সঙ্গে কাজ করছেন। তিনি সারা বছরই মাঠে ছিলেন। আনোয়ারা-কর্ণফুলী এলাকার প্রতিটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পর্যায়ে দলের শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে।”
নির্বাচনি প্রচারের কথা জানিয়ে রিদুয়ানুল বলেন, “এখানে বিভিন্ন দলের আরও ছয়জন প্রার্থী আছেন। তারাও নিজেদের মত নির্বাচনি কর্মকাণ্ড চালাচ্ছেন। কোথাও কোনো সমস্যা নেই।”
দলীয় কেউ স্বতন্ত্র হিসেবে না থাকায় ভূমিমন্ত্রী তার আসনে ‘সুবিধাজনক অবস্থানে’ কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, “কিছুটা সুবিধাজনক পরিস্থিতি বলা যেতে পারে। তবে নির্বাচনে অন্য দলের প্রার্থীরা আছেন এবং সেটা অংশগ্রহণমূলকই হবে।”
সাইফুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে নির্বাচনে লড়ছেন জাতীয় পার্টির আবদুর রব চৌধুরী, তৃণমূল বিএনপির মকবুল আহম্মদ চৌধুরী, সুপ্রিম পার্টির মো. আরিফ মঈনুদ্দিন, খেলাফত আন্দোলনের মৌলভি রশিদুল হক, ইসলামী ফ্রন্টের মো. আবুল হোসেন এবং ইসলামিক ফ্রন্টের সৈয়দ মুহাম্মদ হামেদ হোসাইন।
৩ লাখ ৫৮ হাজার ২৩৬ ভোটারের এই আসনে ২০১৩ সালের ১৭ জানুয়ারি উপ-নির্বাচনে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সাইফুজ্জামান চৌধুরী। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে তিনি এই আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।