Published : 03 Jun 2025, 04:34 PM
ক্ষমতার পট পরিবর্তনের পর জাতীয় পর্যায়ে সংস্কারের যে প্রত্যাশা ও অঙ্গীকারের কথা বাজেটে উপস্থাপন করা হয়েছে, তার সঙ্গে বাজেট বাস্তবায়ন কৌশলে ‘সাজুস্য’ দেখছে না সেন্টার পর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)।
এ গবেষণা সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলছেন, “এই সরকার এসেছে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর। সব খাতে, বিশেষ করে আর্থিক খাতে বৈষম্য দূর করার কথা বাজেট প্রস্তাবে বলা হয়েছে। আমরা দেখতে পাই, বাস্তবায়ন কৌশলে তার সঙ্গে সাজুস্য নেই।’’
বাজেটের পরদিন মঙ্গলবার রাজধানীর গুলশানের লেকশোর হোটেলে প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানায় সিপিডি। তাদের পর্যালোচনা এবং সাংবাদিকদের প্রশ্নে বারবারই ঘুরেফিরে আসে রাজস্ব আদায় ও সংস্কার প্রসঙ্গ।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য সোমবার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট দেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ।
বাজেট ঘাটতি ধরা হয় ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৬২ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরেও যে রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে পিছিয়ে আছে, সে কথা তুলে ধরে ফাহমিদা খাতুন বলেন, গত মার্চ পর্যন্ত আদায়ের যে ধারা, তা বজায় থাকলে অর্থবছরের শেষ দুই মাসে এক লাখ কোটি টাকা আদায় বাড়াতে হবে, যা নিয়ে সংশয় আছে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন তার ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়’ শিরোনামের বাজেটকে ‘ব্যতিক্রমধর্মী’ বলেছেন।
তিনি বলেছেন, “দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মত আমরা বিগত বাজেটের চেয়ে ছোট আকারের বাজেট আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাব করছি। প্রবৃদ্ধিকেন্দ্রিক ধারণা থেকে সরে এসে আমরা চেষ্টা করেছি সামগ্রিক উন্নয়নের ধারণায় জোর দিতে।”
১০ মাসেরও কম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার অর্থনীতির সংস্কারের লক্ষ্য পূরণে ‘অনেক দূর এগিয়ে যেতে’ সক্ষম হয়েছে দাবি করে উপদেষ্টা বাজেট বক্তৃতায় বলেন, “জুলাই অভ্যুত্থানের পর যে আশায় আমরা বুক বেঁধেছিলাম তা খুব শিগগিরই পূরণ করতে সক্ষম হব, ইনশাআল্লাহ।”
তবে সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলছেন, বৈষম্য দূর করতে হলে রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের সংস্কার লাগবে বলে তারা মনে করেন।
“রাজস্ব আদায় কখনোই প্রক্ষেপণ অনুযায়ী হয় না। সব সময় রাজস্ব আদায় একই ধারায় রয়েছে। এবারও উচ্চ আকাঙ্ক্ষার রাজস্ব আহরণ বাজেটের বড় চিন্তার বিষয়। গত ১০ বছর ধরেই আমরা দেখছি, লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয় না।
“রাজস্ব আহরণ বাড়াতে না পারলে ঘাটতি বেড়েই যাবে। রাজস্ব আদায় সেভাবে না হওয়ায় এবার বাজেট ঘাটতি কমানো হয় মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের পদক্ষেপ হিসেবে।”
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব খাতে আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যা বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের ৮.৯ শতাংশ বেশি।
এনবিআরের বিরাজমান অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে এ পরিমাণ রাজস্ব আদায় কীভাবে হবে, তার কোনো কৌশল দেখছে না সিপিডি।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, “কর্মকর্তাদের আন্দোলনের কারণে রাজস্ব আদায় কিন্তু কম হচ্ছে। এই সময়ে সবচেয়ে বেশি আদায় হওয়ার কথা।“
জিডিপির তুলনায় দেশের কর আদায় ৯ শতাংশের মত। প্রতিযোগী দেশগুলোতে তা ১৭-২০ শতাংশের বেশি। এই বাস্তবতা তুলে ধরে সিপিডির সম্মনীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “কর-জিডিপি অনুপাত ১৭ শতাংশের উপরে না নেওয়া পর্যন্ত এই বাজেট দিয়ে সমাজ থেকে বৈষম্য দূর করা সম্ভব না।’’
জোড়ালো পদক্ষেপ নিয়ে রাজস্ব বাড়াতে প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে রাজস্ব আদায় করতে বড় ধরনের সংস্কারের মধ্যে দিয়ে যেতে হবে। সরকার ভ্যাট ও পরোক্ষ করের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। কর আদায় বাড়াতে সরাসরি কর আরোপ ও সম্পদ কর ছাড়া স্বম্ভব না।”
কালো টাকা সাদা করার সুযোগ এবারো দেওয়ার সমালোচনা করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, “এটা বৈষম্যবিরোধী কথার সঙ্গে চরমভাবে সাংঘর্ষিক।”
অর্থপাচার বন্ধ হওয়ায় হুন্ডির বদলে ব্যাংকিং চ্যানেলে এক বছরে অতিরিক্ত ৭ বিলিয়ন ডলার রেমিটেন্স এসেছে বলে ধারণা দেন মোস্তাফিজুর রহমান।
নানামুখী উদ্যোগের পরও মূল্যস্ফীতি কমার গতি ধীর হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে ফাহমিদা খাতুন বলেন, “এর আগে মূল্যস্ফীতিকে স্বীকার করা হয়নি। এজন্য মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতি দেয়া হয় সাংঘর্ষিকভাবে।”
মুদ্রানীতির সঙ্গে রাজস্বনীতি ও বাজার ব্যবস্থাপনা সম্মিলিতভাবে কাজ করলে মূল্যস্ফীতি দ্রুত স্বাভাবিক পর্যায়ে নেমে আসবে বলে মনে করেন তিনি।