Published : 21 May 2025, 01:27 AM
যুক্তরাষ্ট্র থেকে অন্য দেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে কর বসাতে প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প যে আইন প্রস্তাব করেছেন, তা পাস হলে বাংলাদেশের রেমিটেন্সে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার শঙ্কা দেখছেন বিশ্লেষকরা।
তাদের মতে, এ ক্ষেত্রে হুন্ডির মতো অবৈধ পথে রেমিটেন্স পাঠাতে উৎসাহিত হতে পারেন প্রবাসীরা, যা রিজার্ভের জন্য বড় ধাক্কার কারণ হবে।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী মঙ্গলবার দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, রেমিটেন্সের ওপর কর বসিয়ে ট্রাম্প প্রশাসন আইন করলে প্রবাসীদের অতিরিক্ত অর্থ খরচ করতে হবে। তাতে ‘অনানুষ্ঠানিক উপায়ে’ দেশে রেমিটেন্স পাঠানোর প্রবণতা বেড়ে যাবে।
“গত কিছুদিনে রেমিটেন্সের প্রবাহ তুলনামূলকভাবে ভালোই বেড়েছে, যা এ মুহূর্তের অর্থনীতির জন্য দরকার। তাছাড়া ডলার বাজার স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রে এই নতুন আইন পাস হলে অবশ্যই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স পাঠানোর ক্ষেত্রে প্রভাব পড়বে।
“ব্যাংকিং চ্যানেলে বাড়তি ৫ শতাংশ কর আরোপ হলে তো তখন অনেকেই পাঠাবেন না। বিকল্প হিসেবে হুন্ডির মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠাবে। তাতে প্রভাব পড়বে বাংলাদেশের রিজার্ভের ওপর। কারণ মাঝে রেমিটেন্স আসা কমেছিল। তখন হুন্ডিতে এসব রেমিটেন্স আসছিল বলে আমরা বিভিন্ন সোর্স থেকে খবর পেতাম।”
ডনাল্ড ট্রাম্প প্রস্তাবিত ‘ওয়ান বিগ বিউটিফুল বিল অ্যাক্ট’ নামের নতুন আইনের পক্ষে রোববার ভোট দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হাউজ বাজেট কমিটি। আগামী সপ্তাহে কংগ্রেসের নিম্নকক্ষে বিলটির ওপর ভোট হতে পারে।
এই বিলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে অন্যান্য দেশে অর্থ পাঠানোর ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ হারে কর আরোপের প্রস্তাব করা হয়েছে।
অর্থাৎ, বিলটি পাস হলে আন্তর্জাতিক রেমিটেন্সের ওপর এই কর আরোপ হবে। এর আওতায় পড়বেন যারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন অথচ কাজ বা ব্যবসা সূত্রে সেদেশে থাকেন, তারাসহ এইচ-১বি ভিসা, এফ-১ ভিসাধারী এমনকি গ্রিনকার্ডধারীরাও।
করের ক্ষেত্রে কোনো ছাড় সীমা উল্লেখ নেই। অর্থাৎ, যে কোনো অঙ্কের অর্থ পাঠালেই কর দিতে হবে। তবে কেউ যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হলে তার ক্ষেত্রে এই নিয়ম প্রযোজ্য হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক নন, এমন ব্যক্তিরা যারা নিয়মিত দেশে অর্থ পাঠিয়ে থাকেন—পরিবারের ব্যয় মেটাতে বা বিনিয়োগের জন্য—তারা আগের মতো পুরো অর্থ পৌঁছে দিতে চাইলে তখন খরচ করতে হবে বাড়তি ডলার।
পিউ রিসার্চ সেন্টারের ২০২৩ সালের তথ্য মতে যুক্তরাষ্ট্রে আনুমানিক ৩ লাখ বাংলাদেশি বসবাস করেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের রেমিটেন্স আয়ের অন্যতম বড় উৎস যুক্তরাষ্ট্র। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মার্চ পর্যন্ত নয় মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স এসেছে ৩৯৪ কোটি ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৩১২ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে।
তার আগের ২০২৩-২৪ অর্থবছরেও যুক্তরাষ্ট্র থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছিল। সে অর্থবছরে ২৯৬ কোটি ডলার রেমিটেন্স এসেছিল। ওই বছর সবচেয়ে বেশি রেমিটেন্স আসে আরব আমিরাত থেকে, ৪৬০ কোটি ডলার।
রেমিটেন্সের ওপর ট্রাম্পের নতুন কর বিল, ধাক্কা খেতে পারে একাধিক দেশ
২০২২-২৩ অর্থবছরেও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স, ৩৫২ কোটি ডলার পাঠিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা। সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে সে অর্থবছরে সর্বোচ্চ ৩৭৬ বিলিয়নের সর্বোচ্চ রেমিটেন্স এসেছিল।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে চলতি অর্থবছরের নয় মাসে যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠানো ৩৯৪ কোটি ডলারের ওপর যদি ৫ শতাংশ কর দিতে হত, তাহলে ১৯ দশমিক ৭ কোটি ডলার বেশি গুনতে হত প্রবাসী বাংলাদেশিদের, যা দেশি মুদ্রায় ২ হাজার কোটি টাকার বেশি।
ট্রাম্পের নতুন কর বিল পাস হলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে কৗ পরিমাণে রেমিটেন্স কমতে পারে, সে বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায়নি।
একটি বেসরকারি ব্যাংকের ট্রেজারি প্রধান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, “এ মুহূর্তে এটা বলা মুশকিল। কারণ আমরা এই খবর পেয়েছি বেশিক্ষণ হয়নি। এটা নিয়ে আমাদের বিভাগ কাজ করছে। কত কমে যেতে পারে তা সময়ই বলে দেবে।”
রেমিটেন্সে শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্রই
অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ জালাল উদ্দিন শিকদার।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “অনেক আগে থেকেই এসব দেশের সরকারের মধ্যে আলোচনা ছিল যে বাইরের দেশ থেকে লোকজন এসে কাজ করছে এবং বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার যুক্তরাষ্ট্র থেকে নিয়ে যাচ্ছে। এজন্য তারা চাইছে, বিপুল পরিমাণের অর্থ তাদের দেশ থেকে বাইরে চলে গেলেও যেন সেখান থেকে কিছু অর্থ কর আরোপের মাধ্যমে ধরে রাখতে পারে।”
জালাল উদ্দিনের মতে, অভিবাসনের গন্তব্য দেশগুলোতে এই ধারণা অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত যে বিপুল পরিমাণে রেমিটেন্স বাইরে চলে গেলে সেখান থেকে কর আরোপের মাধ্যমে তাদের দেশের অর্থ ধরে রাখা সম্ভব। যুক্তরাষ্ট্র দেশের কর বাড়ানোর জন্য সেই নীতি অনুসরণ করতে যাচ্ছে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এর প্রভাব নিয়ে তিনি বলেন, “যারা ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিটেন্স পাঠাতেন, তারা এখন হুন্ডির মাধ্যমে পাঠাবেন। বৈধ পথে রেমিটেন্স পাঠানোর ইচ্ছা থাকলেও অনেকেই তখন অনানুষ্ঠানিকভাবে পাঠাবেন।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমরা সর্বোচ্চ কিংবা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রেমিটেন্স পাই। রেমিটেন্সের ওপর কর আরোপ করলে স্বাভাবিকভাবেই ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিটেন্স কমে যাবে। তাতে হুন্ডি চ্যানেলে এসব রেমিটেন্স আসার সম্ভবনা তৈরি হবে।”