Published : 27 Nov 2024, 07:07 PM
ঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ না নেওয়ায় বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণের পর রপ্তানি খাতে কঠিন ‘চ্যালেঞ্জের’ মুখোমুখি পড়তে যাচ্ছে। কেবল এদিক থেকে এগিয়ে থাকায় ভিয়েতনাম এ সময়ে রপ্তানিতে বাজিমাত করবে।
বুধবার ঢাকায় এক সেমিনারে মূল প্রবন্ধে এমন ধারনার কথা তুলে ধরেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র্যাপিড) চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক।
তিনি বলেছেন, “এলডিসি থেকে উত্তরণ এবং ভিয়েতনামের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির ফলে কেবল এ অঞ্চলেই বাংলাদেশের রপ্তানি কমবে ২০ শতাংশ।
“একই সঙ্গে এলডিসি উত্তরণ ঘিরে শুল্ক বৃদ্ধি ও ভিয়েতনাম বাণিজ্যে বৈচিত্র নিয়ে আসায় তার প্রভাব বাংলাদেশেও পড়বে। এতে বাংলাদেশে মোট দেশজ উৎপাদনও-জিডিপি ১ শতাংশ কমবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।”
র্যাপিড এবং জার্মানিভিত্তিক উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেডরিখ-ইবার্ট-স্টিফটাং (এফইএস) বাংলাদেশ যৌথভাবে এই সেমিনার আয়োজন করে।
বাংলাদেশ যখন এলডিসির পরে ধুঁকতে থাকবে তখন ভিয়েতনাম কেবল মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির ফলে ইইউতেই ৮২ শতাংশ রপ্তানি বাড়াতে পারবে বলে গবেষণার তথ্য তুলে ধরেন কমনওয়েলথ সচিবালয়ের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতির সাবেক প্রধান এম এ রাজ্জাক।
সংকট মোকাবেলায় এলডিসি উত্তরণের পরে ৩ থেকে ৫ বছরের জন্য শুল্ক কম বৃদ্ধির জন্য আলোচনা বাড়ানো, জিএসপি প্লাসের সক্ষমতা অর্জন, বৈদেশিক বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে মুক্ত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ চুক্তি এবং শিল্পে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করেন এ অর্থনীতিবিদ।
তবে এই গবেষণার ফলের সঙ্গে একমত হতে পারেননি বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান।
ফতুল্লা অ্যাপারেলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসান বলেন, “আমি ভাবি না যে, এলডিসির পরে আমাদের রপ্তানি ২০ শতাংশ কমে যাবে বরং আমাদের প্রবৃদ্ধি ‘স্লো’ হতে পারে।”
পোশাক রপ্তানি খাত ‘ভয়াবহ সমস্যার’ মধ্য দিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, “সবকিছু আমাদের ব্যবসার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। একইরকম চলতে থাকলে প্রবৃদ্ধি কমবে কিন্তু রপ্তানির ভল্যুম কমবে না।
“আমাদের এখন নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি সরবরাহ প্রয়োজন” বলেন তিনি।
একই সঙ্গে পোশাক রপ্তানি থেকে চোখ না সরিয়ে বরং কেন অন্যান্য খাতের রপ্তানি বাড়ানো গেল না তা নিয়ে গবেষণার অনুরোধ জানান তিনি।
‘সুরক্ষা নীতি’ নিয়ে চলা দেশের মধ্যে সারা বিশ্বেই বাংলাদেশ অন্যতম উল্লেখ করে বাংলাদেশে ইইউর বাণিজ্য উপদেষ্টা আবু সৈয়দ বেলাল বলেন, “ভিয়েতনামকে ইইউ প্রবেশের সুযোগ করে দেয়নি বরং তারা সঠিক সময়ে সঠিক নীতি পদক্ষেপ নিয়েছে। দেশটি তাদের নীতি সবসময়ই খুবই সহজ রেখেছে।”
তার ভাষ্য, ভিয়েতনাম যখন নীতি সহজের পন্থায় হেঁটেছে বাংলাদেশে তখন ‘দ্বিত্ব নীতি’ চলেছে।
তাজরীন ফ্যাশন বা রানা প্লাজার মতো দুর্ঘটনা ভিয়েতনামে হয়নি কিন্তু বাংলাদেশে হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
এসব আর যেন সামনের দিনে না হয় সেটি নিশ্চিত এবং এর ফলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে বাংলাদেশ যেন পিছিয়ে না পরে সেদিকটিও নিশ্চিতের পরামর্শ দেন তিনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এফটিএ শাখার অতিরিক্ত সচিব আয়েশা আক্তার বলেন, “রপ্তানির প্রতিযোগিতা বাড়াতে নীতি সহায়তা ছাড়াও অনেক বিষয়ের প্রয়োজন রয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কার।”
‘ভিয়েতনাম সময়ে সময়ে এটি করতে পেরেছে’ বলে মনে করেন তিনি।
এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সংকট মোকাবেলায় সবচেয়ে ভালো সম্ভাব্য সুযোগ হচ্ছে ইইউর সঙ্গে এফটিএ করা। বাংলাদেশ সরকার সেই চেষ্টা করে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।
একই সঙ্গে চীন, জাপান, ইন্দোনেশিয়াসহ ২৮টি দেশের সঙ্গে এফটিএর সম্ভাব্যতা যাচাই করা হয়েছে। অনেক দেশের সাথেই একাধিক আলোচনা হয়েছে বলেও জানান আয়েশা আক্তার।
পোশাক খাতে ‘জ্বালানি সংকট’
আলোচনায় অংশ নিয়ে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, বিদ্যুতের গুণমান এবং গ্যাসের ঘাটতি এখন শিল্পে, বিশেষ করে পোশাক খাতের বড় চ্যালেঞ্জ ।
তিনি এনবিআরের সমালোচনা করে বলেন, “রপ্তানি নীতি ও আমদানি নীতি আদেশেও আংশিক রপ্তানিকারকদের কথা যুক্ত থাকলেও এসব নীতি বাস্তবায়ন করেনি রাজস্ব আদায়ের এ সংস্থা।”
এটি হতে পারত ‘গেম চেঞ্জার’, বলেন তিনি।
এর ফলে এসএমই খাতও বন্ডের সুবিধা নিয়ে রপ্তানি বাড়াতে পারত উল্লেখ করে তিনি বলেন, “এনবিআরকে বারবার অনুরোধ করলেও এটি আমলে নেওয়া হয়নি।”
তবে তারপরও বাংলাদেশের রপ্তানির ব্যাপারে আশাবাদ ব্যক্ত করে ইপিবি চেয়ারম্যান বলেন, “২০৩০ নয় বরং এর আগেই পোশাক খাতে ১০০ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি দাঁড়াবে।”
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব মো. শাহরিয়ার কাদের ছিদ্দিকীও এ বিষয়টি উল্লেখ করে বলেন, “প্রতিনিয়ত নীতি হস্তক্ষেপ থাকলে হয়ত রপ্তানি বাড়বে কিন্তু টেকসই হবে না। বিদেশিরা আসবে না। আমাদের নীতির সামঞ্জস্য লাগবে। সঙ্গে নীতির ধারাবাহিকতাও প্রয়োজন।”
বিশ্ব ব্যাংকসহ বিশ্বের অন্যান্য দাতা সংস্থা ও দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে কাজ করতে আগ্রহী বলেও তিনি জানান।