Published : 03 Jun 2025, 01:25 AM
নতুন অর্থবছরের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের দেওয়া বাজেট নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া এসেছে বিশ্লেষকদের কাছ থেকে।
যেমন— এডিপির আকার বড় না করার সিদ্ধান্তকে কেউ দেখছেন ইতিবাচক হিসেবে; কেউ বলছেন, কর্মসংস্থানে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
আবার যতটুকু কমানো হয়েছে, তা ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ নয়— এমন মন্তব্যও এসেছে।
মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি নিয়ে যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, সেটা কোনো বিশ্লেষকের কাছে ‘উচ্চাভিলাসী’ ঠেকছে; ‘জটিলও’ ভাবছেন কেউ কেউ। কারো কারো মতে, নতুন বাজেটে কর্মস্থানের খুব বেশি ‘উপাদান’ নেই।
জুলাই অভ্যুত্থানে বদলে যাওয়া বাংলাদেশের ভিন্ন বাস্তবতায় এবার সংসদের বাইরে বাজেট উপস্থাপন করা হয় ভিন্ন আঙ্গিকে।
সোমবার ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকার বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। এতে ঘাটতি ধরা হয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ।
ঘাটতির মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস হতে এবং ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে সংগ্রহের প্রস্তাব রয়েছে বাজেটে।
কিছু পদক্ষেপ ‘সাহসী’: জাহিদ হোসেন
উন্নয়ন ব্যয়কে ‘গতানুগতিক’ মন্তব্য করে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট জাহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘এডিপির কিছু প্রকল্পে তো অর্থায়ন করা হবে না; সুযোগও নাই। কিছু তো বাদ দিতে হবে গুরুত্ব না থাকায়। যা কমানো হয়েছে, তা খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ না।’
“বাজেট পরিকল্পনায় আয়ের জায়গায় সরকার কিছু ‘সাহসী’ ও ‘উদ্যোমী’ পদক্ষেপ নিয়েছে। চলতি মাসে কয়েকটি খাতের প্রণোদনার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সরকার তার মেয়াদ বাড়ায়নি। আরও কিছু খাত থেকে প্রণোদনা কমিয়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে।
তবে প্রণোদনা তুলে নেওয়ায় বাজেট বাস্তবায়নে ব্যবসায়ীদের একটি অংশ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
“প্রস্তাবিত বাজেট অর্থনীতির জন্য ভালো উদ্যোগ। কিন্তু আর্থিক খাতের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা তা বাস্তবায়ন করতে দেবে কিনা, সেটাই এখন বড় বিষয়। এ উদ্যোগ এমন যে, আগুনে হাত দেওয়ার মত। আপনি আগুনে হাত দিলেন, বন্ধ করতে না পারলে পুড়ে যেতে পারে। সরকার সেই সাহস দেখিয়েছে।’’
দুর্নীতি সামলাতে পারলে কর্মে প্রভাব পড়বে না: সাইফুদ্দিন খান
সরকারের উন্নয়ন ব্যয় এবার কমবে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থ বিভাগের অধ্যাপক মুহাম্মদ সাইফুদ্দিন খান।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘মেগা প্রকল্পের পেছনে তো খরচ কমে গেছে। অনেক প্রকল্পে সরকার এখন অর্থায়ন হয়ত করবে না। তাই উন্নয়ন ব্যয় এবার কম হবে।’’
উন্নয়ন ব্যয় বেশি হলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বেড়ে যায় এবং তার ইতিবাচক প্রভাব কর্মসংস্থানেও পড়ে। আর উন্নয়ন ব্যয় কমে গেলে তৈরি হয় উল্টো ঝুঁকি।
এ ব্যাপারে অধ্যাপক সাইফুদ্দিনের পর্যবেক্ষণ বলছে, “যেকোনোভাবেই দুর্নীতিগুলো বন্ধ করতে হবে। অনিয়ম না হলে এবং উন্নয়ন বাজেট বাস্তবায়ন করতে পারলে সমস্যা হবে না।’’
নতুন অর্থবছরে সরকারি কর্মচারীদের জন্য ‘বিশেষ সুবিধা” বাড়ানোর প্রস্তাব রয়েছে।
এ সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে সাইফুদ্দিন খান বলছেন, “অর্থনীতি ‘স্বাভাবিক ছন্দে’ না ফেরায় কিছুটা সংকট তো রয়েছে। সরকার পরিচালন ব্যয় কমাতে পারত। এই সময়ে পরিচালন ব্যয় বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল না। দুর্ভোগে তো সবাই আছে, শুধু সরকারি কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো আরও পরে করা যেত।’’
কর্মসংস্থানের কোনো উপাদান আছে? প্রশ্ন মুজেরীর
নতুন বাজেটে কর্মসংস্থান তৈরির কোনো ‘উপাদান’ আছে কিনা, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘একটা টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরির কথা বলা হয়েছে বাজেটে। কিন্তু এজন্য উদ্যোগ লাগবে।
“বাজেটে কি কর্মসংস্থান তৈরির কোনো উপাদান আছে? কর্মসংস্থানের জন্য বিনিয়োগটা লাগবে। বিনিয়োগ তো বাড়ছে না। এজন্য পরিবেশটা লাগবে; অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশটা আগে লাগবে।”
বিনিয়োগ টানতে সরকারের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ‘সংস্কার’ কর্মসূচির যে কথা বলা হয়েছে, তা বাজেটে ‘ছোটো ছোটো পরিসরে’ আছে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান- বিআইডিএসের সাবেক এ মহাপরিচালক বলেন, ‘‘এটা তো অন্তবর্তীকালীন সরকার। সংস্কারের একটা সুযোগ আছে। এজন্য শক্ত পদক্ষেপ লাগবে। সে সুযোগটা তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিতে পারে।’’
সংস্কার বাস্তবায়নের প্রক্রিয়াটা অংশীজনদের নিয়ে করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘‘সংস্কার করতে হলে তো সবাইকে নিয়ে করতে হবে। প্রক্রিয়াটা জনপ্রিয় করতে হবে। সংস্কারে যারা লাভবান হবে, তাদের নিয়ে এগোতে হবে।’’
মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্যমাত্রা সম্পর্কে মোস্তফা মুজেরী বলেন, ‘‘একটা সমন্বিত কাঠামো গ্রহণ করতে হবে। যদি না করি তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে না।’’
এপ্রিলের শুরুতে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যে বাড়তি শুল্ক আরোপ করে ট্রাম্প প্রশাসন। সেই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য ‘সংলাপের প্রস্তুতি ও পর্যায়ক্রমে কমিয়ে আনার’ অংশ হিসেবে ৬২৬টি পণ্যে শুল্ক ছাড় দেওয়া হচ্ছে নতুন অর্থবছরে।
এর মধ্যে ১১০টি পণ্যের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহারের প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা।
এ বিষয়ে মুজেরী বলেন, “যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানিতে শুল্ক কমিয়ে দেওয়া তখনই কার্যকর হবে, যখন ব্যবসায়ীরা দেখবে লাভ হচ্ছে। দেশটি থেকে আমদানির সুযোগই বা কতটা আছে, তাও দেখতে হবে।’’
মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামানোটা ‘জটিল’: সায়মা হক বিদিশা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা বলেন, “সার্বিকভাবে সমতার কথা, বৈষম্যবিরোধী বাজেট বলা হচ্ছে। সেদিক থেকে যদি আমরা বিবেচনা করি, সেখানে গুরুত্বপূর্ণ হল, গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে কী ধরনের ব্যয় করা হয়েছে এবং কর কাঠামো কী রকমের।
“কর কাঠামোটি প্রগতিশীল কিনা, প্রত্যক্ষ করের ওপরে করজাল বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়া হয়েছে কিনা এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলো (শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা) কেন্দ্র করে ব্যয়ের বরাদ্দটা কেমন। সেটি আসলে আমাদের দেখাবে এ বাজেটের দর্শনটা কী ধরনের।”
যমুনা টেলিভিশনে দেওয়া বাজেট প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন বলেন, “মূল্যস্ফীতি যখন লাগামে আনার কথা বলি, তখন আসলে মুদ্রানীতি এবং রাজস্বনীতি দুটোই একসঙ্গে কাজ করা দরকার। মুদ্রানীতির কিন্তু সংকোচনমূলক রয়েছে, এ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি যদি আরও সংকোচন হয়, তখন কিন্তু বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পরতে পারে। সুতরাং মুদ্রানীতির দিক দিয়ে বেশি কিছু করার আছে বলে মনে হয় না।
“রাজস্ব নীতিতেও দেখলাম কিছুটা কাটছাঁট করা হয়েছে। বাজেটের ক্ষেত্রে যদি আমরা বলি, বাজার ব্যবস্থাপনায় জোর দিতে হবে।”
এবার গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশের মধ্যে রাখার লক্ষ্য নিয়ে নতুন অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করেছেন অর্থ উপদেষ্টা।
সোমবার বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসের ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ থেকে কমে ২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশে নেমে এসেছে।”
কিন্তু এটাকে সাড়ে ছয় ৬ শতাংশে নামানো যাবে কিনা, সেই সম্ভাবনার প্রশ্নে সায়মা হক বিদিশা বলেন, “খাদ্য মূল্যস্ফীতির বিষয়ে যখন বলি, সেটি কিন্তু এখনও উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। সেক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনাটা অত্যন্ত জটিল বলে আমার মনে হয়।
“সার্বিক যে মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতির যে কাঠামো, সেখানে যদি বাজার ব্যবস্থাপনায় একেবারে আমূল পরিবর্তন না আসে, তাহলে কিন্তু সেটাকে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা অনেক জটিল হবে।”
প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ‘উচ্চাভিলাসী’: সেলিম রায়হান
নতুন বাজেটে জনআকাঙ্ক্ষার প্রতিফল রাখার চেষ্টা হলেও পুরনো কাঠামোর কারণে নানা সমস্যায় পড়ার ঝুঁকি দেখছেন সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান।
বেসরকারি সংবাদমাধ্যম ‘চ্যানেলটোয়েন্টিফোরে’ দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় তিনি বলেন, “দশকব্যাপী বাজেটসংক্রান্ত পুঞ্জীভূত যে সমস্যা, তা কিন্তু সে পুরনো কাঠামোর মধ্যেই রয়ে গেছে। সেই কাঠামোর বাইরে খুব বেশি যেতে পারিনি।
“সাড়ে ৫ শতাংশ যে প্রবৃদ্ধির হার ধারণা করা হচ্ছে সামনের অর্থবছরে; অথবা মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে নেমে আসবে- এটা আমার কাছে উচ্চাভিলাসী মনে হচ্ছে।”
কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, “দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বড় ধরনের একটা স্থবিরতা এখন। বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হয়ত আশঙ্কা আছে।…সেজন্য তারা বড় কোনো বিনিয়োগে যাচ্ছেন না। এর ইমিডিয়েট প্রভাব কর্মসংস্থানে দেখতে পাচ্ছি, নতুন কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি হচ্ছে না।”
এনবিআর দুই ভাগ করার কোনো প্রভাব রাজস্বে পড়বে কিনা, সে বিষয়ে তিনি বলেন, “এনবিআরে বেশ কিছু অস্থিরতা কাজ করছে। এনবিআরকে দুভাগ করার যে পরিকল্পনা নিয়ে বিরোধ দেখছি, সংস্কার যদি ঠিকভাবে না হয়, সামনের অর্থবছরে কতটুকু রাজস্ব আদায় হবে, সেটা নিয়ে আমার আশঙ্কা আছে।”
উন্নয়ন ব্যয় কমানোটা ‘শুভ উদ্যোগ’: মাসরুর রিয়াজ
পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান মাসরুর রিয়াজ মনে করেন, “এবার বাজেটে সবচেয়ে পজেটিভ ফিচার হচ্ছে- আকাঙ্ক্ষাটা সীমিত রাখা হয়েছে। যেটা বাজেটের সাইজের মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি।
“বাজেট সব সময় আগের বছরের তুলনায় বেড়ে যায়। এ বছর ওভারঅল বাজেটের সাইজ গতবছরের তুলনায় ৭ হাজার কোটি টাকা কম। বার্ষিক উন্নয়ন ব্যয় গত বছরের তুলনায় ১৩% কম। এটা ওয়েলকাম স্টেপ।”
ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য কয়েকটি ভালো উদ্যোগ থাকলেও আরও ‘ভালো হতে পারত’ বলে মনে করেন তিনি।
বেসরকারি সংবাদমাধ্যম একাত্তর টিভিকে বাজেট প্রতিক্রিয়ায় মাসরুর রিয়াজ বলেন, “ভালো উদ্যোগের মধ্যে রয়েছে- এ মুহূর্তে ব্যবসা বাণিজ্যের বড় সমস্যা হল গ্যাসের সংকট। এলএনজির জন্য সাবসিডি বাড়িয়ে ৯ হাজার কোটি টাকার ওপরে নেওয়া হয়েছে- এটা ইতিবাচক।”
তবে অনলাইন প্লাটফর্মে ভ্যাট বাড়ানোর প্রস্তাবের সমালোচনা করেছেন তিনি।
বলছেন, “ভ্যাট বাড়িয়ে দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা ব্যবসার প্রসারের ক্ষেত্রে বৈষম্য কমানো এবং নারী উদ্যোক্তাদের ব্যবসা বাণিজ্যের ‘চমৎকার’ সুযোগে বাধা হয়ে দাঁড়াবে।”