Published : 03 Jun 2025, 02:11 AM
বছর কয়েক ধরে নানা টানাপড়েনে চাপে থাকা মানুষ সংস্কারের পথ ধরে হালকা হওয়ার আশা করেছিল; তবে ইতিহাস গড়ে অর্থ উপদেষ্টার ব্যয় কমানোর প্রথম বাজেট তাদের আশাহত করল।
মূল্যস্ফীতির উত্তাপ থেকে মুক্তির উপায় তো তারা দেখতে পেলেন না; উল্টো মধ্যবিত্তের ওপর বাড়ল বাড়তি করের চাপ।
ব্যবসাকে সহজ করতে কর কাঠামোর শর্ত শিথিলসহ একগুচ্ছ পদক্ষেপে বৈষম্য ঘোচানোর কথা বলা হলেও রাজনৈতিক অস্থিরতা থেকে অর্থনীতিকে টেনে তোলার দিক নির্দেশনা মিলল না।
সোমবার বিকালে টেলিভিশনের মাধ্যমে দেশের ৫৫তম বাজেট দিতে এসে অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের যে হিসাব-নিকাশ মেলালেন, তাতে দেখা গেল সংযত ভাব। তবে সংস্কারের প্রত্যাশা পূরণে জোরালো পদক্ষেপ দেখতে পেলেন না বিশ্লেষকরা। বিপরীতে সমালোচনা সইতে হল অতীতের ছাঁচে ফেলে গতানুগতিক বাজেট দেওয়ার জন্য।
বিগত আমলের অপশাসন ও দুর্নীতি থেকে মুক্ত হয়ে নতুন দেশ গড়ার আশার বাণী শুনিয়েছেন সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন। আগেরবারের ‘টেকসই উন্নয়নের পরিক্রমায় স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’র বদলে তার প্রথম বাজেটে ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়’ ঘোষণা করেছে।
আশাবাদী অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, “আমি স্বস্তি এবং আনন্দের সাথে জানাতে চাই, মাত্র ১০ মাসেরও কম সময়ে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে সে লক্ষ্য পূরণে অনেকদূর এগিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থান এর পর যে আশায় আমরা বুক বেঁধেছিলাম তা খুব শীঘ্রই আমরা পূরণ করতে সক্ষম হবো ইনশাল্লাহ।”
তবে খাদের কিনারা থেকে অর্থনীতিকে এগিয়ে নিতে বছর দুই ধরে ৯ এর ঘরে থাকা মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ শতাংশে কমিয়ে জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৫ শতাংশে বাড়ানোর বিবরণ দিলেন তার ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতায়। পাশাপাশি রাজস্ব আদায় আর বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে যে লক্ষ্যের আশা শুনিয়েছেন তিনি তাকে ‘উচ্চাভিলাসী’ সংখ্যাই মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
অপেক্ষাকৃত ছোট আকারের বাজেটে জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশের সমান ঘাটতি পূরণে অর্থ উপদেষ্টা দেশীয় উৎস থেকে কম ঋণ নেওয়ার কথা বলেছিলেন। তার পরও লাখ টাকার বেশি ব্যাংক ঋণ নেওয়ার যে ছক তিনি কষেছেন, তা বেসরকারি বিনিয়োগে বাধা হয়ে দাঁড়াবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষক ও ব্যবসায়ীরা।
বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন বলেন, “এখন ধরেন আগামী বছরে ব্যাংকের আমানত যদি ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকাও বাড়ে, তার মধ্যে ১ লাখ ৪ হাজার কোটি টাকা যদি সরকারই নিয়ে যায় (ঘাটতি মেটাতে সরকারের ব্যাংক ঋণ) তাহলে ব্যক্তি খাতের জন্য তো খুব একটা টাকা থাকে না।”
করের বোঝা
আসছে অর্থবছরে ব্যয় করার পরিকল্পনায় কিছুটা কাটছাঁট করা হলেও রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যে চাপ বেড়েছে এনবিআরের ওপর। বহু বছর ধরে করজাল বাড়াতে গিয়ে সফল হতে না পারা দেশের রাজস্ব আদায়কারী প্রধান সংস্থাটি বেছে নিয়েছে সহজ পন্থা। করহার বাড়িয়ে এবং অনেক নিত্যপণ্যের ওপর করভার বাড়াতে তারা নিশানা করেছে সীমিত আয়ের মধ্যবিত্তকে। ছাড় দিয়েছেন আয় যারা বেশি করে এমন ব্যক্তিদের।
উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়ে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর চাপ ছিল। সীমিত আয়ের মানুষের ওপর যাতে করের খড়গ না চাপে সেজন্য প্রত্যক্ষ কর না বাড়ানোর তাগিদ ছিল। অথচ চলতি অর্থবছরের আয়ের ওপর একজন করদাতা যখন আগামী অর্থবছরে আয়কর রিটার্ন জমা দেবেন তখন তিনি হতাশই হবেন। তার জন্য কোনো ছাড় নেই।
পরের ২০২৬-২৭ অর্থবছরে তিনি ছাড়ের দেখা পাবেন ঠিকই তবে তার জন্য গুনতে হবে বাড়তি করও। বর্তমানে থাকা সর্বনিম্ন ৫ শতাংশ করহার তুলে দিয়ে এটিকে আগামী অর্থবছরের আয়ের ওপর করা হয়েছে ১০ শতাংশ।
কর ছাড়ের তকমা তুলে ধরতে গিয়ে অর্থ উপদেষ্টা বলেছেন, ব্যক্তিশ্রেণির আয় পরিগণনার ক্ষেত্রে তার মোট আয়ের তিন ভাগের এক ভাগ বা যে সাড়ে ৪ লাখ টাকা ছিল এটিকে বাড়িয়ে ৫ লাখ করা হয়েছে। এটির সুবিধা পাবেন তারাই যাদের বার্ষিক আয় ১৫ লাখ টাকার ওপরে।
চাল, ডাল, গম, আলু, পাটের মত একদম নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যে কিছুটা স্বস্তির দেখা মিললেও জীবনযাপনের আনুষঙ্গিক ব্যয় মেটাতে তাকে হিমশিম খেতেই হবে।
মোবাইল ফোন, লিফট ব্যবহার, এলপিজি সিলিন্ডার, ওয়াশিং মেশিন, মাইক্রোওয়েভ ওভেন ও ইলেকট্রিক ওভেন, ব্লেন্ডার, জুসার, মিক্সার, গ্রাইন্ডার, ইলেক্ট্রিক কেটলি, আয়রন, রাইস কুকার, মাল্টি কুকার ও প্রেসার কুকার, সাবান, শ্যাম্পু, রেফ্রিজারেটর ও ফ্রিজার, এয়ারকন্ডিশনার ও তাদের কম্প্রেসর, পলিপ্রোপাইলিন স্ট্যাপল ফাইবারের মত বিষয় তাকে গুনতে হবে বাড়তি টাকা। তাতে সবচেয়ে বেশি চাপেই পড়বেন নিম্ন ও সীমিত আয়ের মানুষ।
ওটিটি প্লাটফর্মে সিনেমা ও সিরিজ দেখায় খরচ বাড়বে; খরচের হাত বাড়বে নারীর প্রসাধনী পণ্যেও।
সর্বনিম্ন আয়কর এলাকাভেদে ৫ হাজার, ৪ হাজার ও ৩ হাজার টাকা থাকলেও নতুন আইনে এটিকে সকল এলাকার জন্য ৫ হাজার টাকা করে চাপ বাড়িয়েছে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর।
অন্যদিকে বেশি আয়ে মানুষকে সরকার ছাড় দিয়েছেন নানাভাবে; ফ্লাট, জমি বা অ্যাপার্টমেন্ট কেনায় তার জন্য খরচ কমছে ৪০ শতাংশের মত। করহার বাড়লেও তার জন্য রয়েছে কালো টাকায় বিনিয়োগ করে সাদা করার সুযোগও।
ব্যক্তি করদাতার ক্ষেত্রে টার্নওভার করের আওতামুক্ত সীমা তিন কোটি টাকা হতে বাড়িয়ে চার কোটি টাকা করা হয়েছে। সম্পদের সারচার্জের ক্ষেত্রেও বিধানে শিথিলতা এসেছে।
একাধিক গাড়ির ক্ষেত্রে যে পরিবেশ সারচার্জ দেওয়ার বিধান ছিল সেখানে একাধিক ইলেক্ট্রিক গাড়ি কেনা হলে তার বেলায় এ আইন পরিপালিত হবে না বলা হয়েছে।
বেসরকারি চাকরিতে যেসব কর্মকর্তা মূল বেতনের বাইরে সুবিধা পান তাদের জন্য নিয়োগকর্তা এতদিন ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ’পারকুইজিট’ হিসেবে আয়কর মুক্ত ছিল, এটা বাড়িয়ে ২০ লাখ টাকা করা হয়েছে।
ট্রাম্প-আইএমএফকে ঠান্ডা রাখার চেষ্টা
অর্থ উপদেষ্টা যে বাজেট নিয়ে হাজির হলেন তাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পকে ঠান্ডা করার বিষয়টি নিজেই তুলে ধরেছেন।
বাজেট বক্তৃতায় তিনি বলেন, “আমদানি পণ্যের শুল্ক-কর হার পর্যায়ক্রমে হ্রাস করা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য সংলাপের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে ১১০টি পণ্যের আমদানি শুল্ক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার, ৬৫টি পণ্যের আমদানি শুল্ক হ্রাস, ৯টি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহার এবং ৪৪২টি পণ্যের সম্পূরক শুল্ক হ্রাস করার প্রস্তাব করা হয়েছে।”
এতে দেশি অনেক শিল্পের যে সুরক্ষা নীতি বন্ধ হয়ে যাবে বা অনেক শিল্প খাতে যে আগের কর ছাড় সুবিধা কমবে বা একেবারেই বাদ দেওয়া হয়েছে সেটির কারণ ব্যাখ্যা করেননি।
ট্রাম্প প্রশাসনকে খুশি করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) এর শর্ত মেনে রাজস্ব আদায়ের আকাশচুম্বী লক্ষ্য নির্ধারণ ও কর ছাড় কমানোর প্রচেষ্টাও দেখা গেছে অর্থ উপদেষ্টার পরিকল্পনায়।
আয়করের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, যেসব খাতে জুন ২০২৫ এ অব্যাহতির মেয়াদ শেষ হবে তার ক্ষেত্রে আর সময় বাড়ানো হয়নি।
মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটের ক্ষেত্রে অনেক দেশি শিল্পের ক্ষেত্রেই তাদের বর্তমান সুবিধা বাদ বা কমানো হয়েছে। ৮০ টিরও অধিক পণ্যের মিনিমাম ট্যারিফ ভ্যালু প্রত্যাহার করা হয়েছে। আমদানি শুল্ক এভাবে কমানোয় এবং ট্যারিফ ভ্যালু প্রত্যাহারে চাপ বাড়বে দেশি শিল্পে।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে যেসব পণ্যে শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে সেগুলোর খুব কমই দেশি শিল্প উৎপাদন করে থাকে। শুল্ক কমানোর তালিকায় আছে যুদ্ধের অস্ত্র, উড়োজাহাজের মত বিষয় যা কেবল সরকারই আমদানি করে থাকে।
‘উচ্চাভিলাসী’ কোথায়?
বিদায়ী ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাজেট দিতে গিয়ে ’স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নযাত্রা’র প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তবে সেই বাজেট বাস্তবায়নের সুযোগ তার সরকার পায়নি। বাজেট কার্যকরের এক মাসের মাথায় ৫ অগাস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের শাসনের অবসান ঘটে।
পট পরিবর্তনের পর নতুন পরিস্থিতিতে অনেক কিছু সামাল দিয়ে নতুন অর্থবছরের বাজেটের ছক করতে হয়েছে অর্থ উপদেষ্টাকে। আইএমএফসহ অনেক চাপ ও দাবি দাওয়া সামলাতে হয়েছে তাকে।
এরপরও অর্থ উপদেষ্টা জিডিপির বিচারে বাজেটের আকারে সংযম দেখালেও বেশ কিছু ক্ষেত্রে তিনি উচ্চ লক্ষ্যমাত্রা নিয়েছেন।
বাজেট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নতুন অর্থবছরে ৫ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্য ধরার পরামর্শ দিয়েছিল আইএমএফ। তবে প্রস্তাবিত বাজেটে তা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এই অঙ্ক বিদায়ী অর্থবছরের সংশোধিত রাজস্ব আয়ের চেয়ে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি।
এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে কর হিসেবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা আদায় করা যাবে বলে আশা করছেন সালেহউদ্দিন। ফলে এনবিআরের কর আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ছে ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশের বেশি।
আরও পড়ুন-
'গতানুগতিক' বাজেটে কর্মসংস্থান 'সুযোগ কই
'গুণগত' তফাৎ দেখছে না বিএনপি, সিপিবি-জামায়াতের চোখে 'গতানুগতিক'
বাজেটে আশাহত ডিসিসিআই, ফিকিরও উদ্বেগ
আগের সরকারের ধারাবাহিকতা থেকে বের হয়নি বাজেট: আমীর খসরু
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের যে ধারা দেখা যাচ্ছে তাতে এটিকে ‘উচ্চাভিলাসী’ দেখছেন অনেকে। চলতি অর্থবছরে ৪ লাখ কোটি টাকা এনবিআর রাজস্ব আদায় করতে পারলেও সেটি ‘উল্লেখযোগ্য অর্জন’ হবে বলে মনে করেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।
আসছে অর্থবছরের জন্য নতুন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে এনবিআরকে ২৫ শতাংশের মত রাজস্ব আদায়ে প্রবৃদ্ধি করতে হবে। অথচ অর্থনীতির খুব ভালো সময়েও ১৫ শতাংশের আশপাশে প্রবৃদ্ধি রাখতে পেরেছে সংস্থাটি। চলতি অর্থবছরে এ হার থাকছে ৪ শতাংশের আশপাশে।
অর্থনীতির শিক্ষক সেলিম রায়হানও মনে করছেন এ লক্ষ্য ‘যৌক্তিক না’।
টানা তিন বছর ধরে উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে ভুগতে থাকার মধ্যে আসছে অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির লক্ষ্য ধরা হয়েছে সাড়ে ৬ শতাংশ। বারবার সুদের হার বাড়িয়ে তা কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে কিছুটা সাফল্য মিললেও মে মাসেও এ হার রয়েছে ৯ শতাংশের ওপরে।
সেক্ষেত্রে হঠাৎ কোন জাদুতে এটি একেবারে সাড়ে ৬ শতাংশে নেমে আসবে সেই পরিকল্পনা নেই অর্থ উপদেষ্টার বক্তৃতায়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়েমা হক বিদিশা বলেন, “মূল্যস্ফীতিটাকে যখন লাগামে আনার কথা বলি তখন আসলে মুদ্রানীতি এবং রাজস্বনীতি দুটোই একসঙ্গে কাজ করা দরকার। মুদ্রানীতির কিন্তু সংকোচনমূলক রয়েছে, এ সংকোনচনমূলক মুদ্রানীতি যদি আরও সংকোচন করা হয় তখন কিন্তু এটা বিনিয়োগের উপর একটা নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।
”যেটা বারবার বলছি, বিশেষ করে খাদ্য মূল্যস্ফীতির বিষয়ে যখন বলি, সেটি কিন্তু এখনও উচ্চ পর্যায়ে রয়েছে। সেক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতিটাকে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনাটা অত্যান্ত জটিল বলে আমার মনে হয়।”
আরও পড়ুন-
বাজেটে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ রাখাও 'বৈষম্যমূলক'
আবাসনে কালো টাকা বিনিয়োগের সুযোগ থাকছে, দিতে হবে বাড়তি কর
অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটে ব্যয় বাড়ল ৬%
বাজেট ঘাটতি: ব্যাংক ঋণ ২৪ শতাংশ কমানোর প্রস্তাব
জিডিপির প্রবৃদ্ধিতেও অর্থ উপদেষ্টা আশার ঝলক দেখিয়েছেন; লক্ষ্য ঠিক করেছেন সাড়ে ৫ শতাংশ। অথচ রাজনৈতিক ‘অনিশ্চয়তায়’ বিনিয়োগের পরিবেশ না থাকায় কমেছে বেসরকারি খাতে ঋণে, বিনিয়োগেও রয়েছে খড়া। তাতে কোনো ধরনের উন্নতি দেখা না গেলেও জিডিপির প্রবৃদ্ধিতে এতটা আশাবদী তিনি কীভাবে হলেন তা ভাবাচ্ছে অর্থনীতিবিদদের।
অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, “সাড়ে ৫ যে প্রবৃদ্ধির হার ধারণা করা হচ্ছে অথবা মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৬ নেমে আসবে এটা আমার কাছে উচ্চবিলাসী মনে হচ্ছে।”
শিক্ষা-স্বাস্থ্যে ‘হতাশা’, সামাজিক সুরক্ষার কী হাল?
সংস্কারের এ সময়ে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক সুরক্ষা খাতের মত বিষয়গুলোতে বরাদ্দ বাড়ার আশা করেছিলেন অনেকেই।
তবে এক্ষেত্রে ‘হতাশ’ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা। নতুন অর্থবছরের জন্য যে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে সেখানে শিক্ষা ও প্রযুক্তি খাতে বরাদ্দ জিডিপির অনুপাতে কিছুটা কমায় বাজেটে শিক্ষায় বরাদ্দকে ‘হতাশার’ বলে আখ্যায়িত করেছেন শিক্ষাবিদরা।
শিক্ষা বাজেটে ‘জুলাই গণঅভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন হয়নি’ বলেও ভাষ্য তাদের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুল হালিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এ বাজেটে কি আমরা জুলাই অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন পেলাম? অবশ্যই না।
“শিক্ষা মানের দিকে যখন সবাই জোর দিচ্ছে, তখন জিডিপির অনুপাতে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কমা হতাশার। কারণ যে কোনো উদ্যোগের মেরুদণ্ড হল ফাইন্যান্স। বরাদ্দ না থাকলে শিক্ষার মানোন্নয়নের উদ্যোগ আমরা কীভাবে আশা করব?”
আরও পড়ুন-
ঘাটতি বাজেটে সরকারি কর্মচারিদের পেছনে 'প্রশ্নবিদ্ধ ব্যয়'
সংযত বাজেটে ৫.৫% জিডিপি প্রবৃদ্ধির আশা
সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াতে কী আছে বাজেটে?
সরকারি কর্মচারীদের 'বিশেষ সুবিধা' বাড়ছে
শিক্ষার মত নতুন অর্থবছরের জন্য স্বাস্থ্য খাতের বরাদ্দ নিয়েও প্রত্যাশা পূরণ হয়নি।
অর্থনীতিবিদ সেলিম রায়হান বলেন, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সামাজিক সুরক্ষা- এই তিন খাতে কাঠামোগত কোনো পরিবর্তন হয়নি।
”সুতরাং বাজেট যেটা ঘোষণা করা হল জাতীর স্বার্থে বড় গ্যাপ রয়ে গেল। ”
তবে অর্থ উপদেষ্টা সামাজিক নিরাপত্তা খাতের ‘ব্যাপ্তি এবং গুরুত্ব‘সরকার বিবেচনায় নিয়েছে তুলে ধরে তিনি আগামী ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করেন।
এক্ষেত্রে পেনশন ছাড়া সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর জন্য তিনি ৯১ হাজার ২৯৭ কোটি টাকার বরাদ্দ প্রস্তাব করেন, যাতে কিছু ক্ষেত্রে ভাতার হার বাড়ানোর প্রস্তাব করেন। তবে খোলা বাজারে বিক্রির আওতা বা সুবিধাভোগীর সংখ্যা বাড়ানো হবে কি না বা সুবিধাভোগীর নাম তৈরির ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় যে অনিয়ম হয়েছে তা নিয়ে বিস্তারিত কিছু বলা হয়নি বাজেটে।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির অধীনে ১৪০টির মত কার্যক্রম একসঙ্গে চলত, সেগুলো কমিয়ে ৯৫টি করা হয়েছে এবং সেখানে অর্থ বরাদ্দ কম করা হয়েছে। খুব কম না কিন্তু বাজেটের তুলনায় ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ এবং মোট বাজেটের ১ লাখ ১৬ হাজার কোটি টাকার মত।
পুরোনো কাঠামোর বাজেটের ’নতুনত্ব’ নেই
সানেমের নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান বলেন, ”পুরোনো কাঠামোর মধ্যে রেখেই একটা আমাদের যে আশা এবং জন আকাঙ্ক্ষা সেটার একটা প্রতিফল করার চেষ্টা করা হয়েছে। কিন্তু আমরা জানি পুরোনো কাঠামোর মধ্যে রেখে করতে গেলে তার অনেক সমস্যা আছে। ”
ব্যবসায়ী নেতা ও বিএনপির সহসভাপতি আব্দুল আউয়াল মিন্টু ‘এখানে কোনো নতুনত্ব খোঁজার চেষ্টাও করব না’ বলে নিজের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন। বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারও অতীতের সরকারকেই অনুসরণ করেছে।
তার ভাষ্য, “স্বাস্থ্যখাতে বলেন, দুর্নীতি কমাতে বলেন, শিক্ষা খাতে বলেন অনেক সংস্কার কিন্তু বাজেটের মাধ্যমেও আনা যায়। আমরা যেটা প্রত্যাশা করি এ মুহূর্তে অত বেশি প্রত্যাশা না করাই ভালো আমাদের জন্য।
“ওনারা আগেরটাই ফলো করেছেন বলে আমার বিশ্বাস। কারণ ব্যয় কমানো হলেও রাজস্ব আহরণের নির্ধারিত মাত্রা কিন্তু কমানো হয়নি, বাড়ানো হয়েছে। সেজন্য আমি মনে করি এটা অর্জন হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ ব্যবসা-বাণিজ্য যদি প্রসারিত না হয়, বিনিয়োগ বাড়ানো না হয়, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যদি ব্যপকভাবে বিস্তৃত না হয় তাহলে আপনার রাজস্ব আহরণ তো এমনি কমে যায়।”
বিনিয়োগ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “বিনিয়োগের জন্য প্রথমে দরকার সামাজিক শৃঙ্খলা। বাংলাদেশে বর্তমান সামাজিক শৃঙ্খলা যদি আপনি চিন্তা করতে যান তাহলে সেটা কোনভাবেই বিনিয়োগের জন্য সহায়ক পরিবেশ নাই। রাজনৈতিক অস্থিরতা যদি বাড়ে একটা সমাজে তাহলে সেখানে বিনিয়োগের পরিস্থিতি থাকে না।“
আরও পড়ুন-
করমুক্ত আয়সীমা বাড়ল, সঙ্গে বাড়ল করদাতার ওপর করের চাপ
যুক্তরাষ্ট্রকে 'মানাতে' ৬২৬ পণ্য আমদানিতে শুল্ক ছাড়
কী বলছেন অর্থনীতিবিদরা
মূল্যস্ফীতি ও জিডিপি নিয়ে যে লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে, সেটা কোনো বিশ্লেষকের কাছে ‘উচ্চাভিলাসী’ ঠেকছে; ‘জটিলও’ ভাবছেন কেউ কেউ। কারো কারো মতে, নতুন বাজেটে কর্মস্থানের খুব বেশি ‘উপাদান’ নেই।
উন্নয়ন ব্যয়কে ‘গতানুগতিক’ মন্তব্য করে বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক লিড ইকোনোমিস্ট জাহিদ হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ‘‘এডিপির কিছু প্রকল্পে তো অর্থায়ন করা হবে না; সুযোগও নাই। কিছু তো বাদ দিতে হবে গুরুত্ব না থাকায়। যা কমানো হয়েছে, তা খুব একটা তাৎপর্যপূর্ণ না।’
“বাজেট পরিকল্পনায় আয়ের জায়গায় সরকার কিছু ‘সাহসী’ ও ‘উদ্যোমী’ পদক্ষেপ নিয়েছে। চলতি মাসে কয়েকটি খাতের প্রণোদনার মেয়াদ শেষ হচ্ছে। সরকার তার মেয়াদ বাড়ায়নি। আরও কিছু খাত থেকে প্রণোদনা কমিয়েছে। এতে সরকারের রাজস্ব আদায় বাড়বে।
তবে প্রণোদনা তুলে নেওয়ায় বাজেট বাস্তবায়নে ব্যবসায়ীদের একটি অংশ বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন তিনি।
নতুন বাজেটে কর্মসংস্থান তৈরির কোনো ‘উপাদান’ আছে কিনা, সেই প্রশ্ন তুলেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, ‘‘একটা টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামো তৈরির কথা বলা হয়েছে বাজেটে। কিন্তু এজন্য উদ্যোগ লাগবে।
“বাজেটে কি কর্মসংস্থান তৈরির কোনো উপাদান আছে? কর্মসংস্থানের জন্য বিনিয়োগটা লাগবে। বিনিয়োগ তো বাড়ছে না। এজন্য পরিবেশটা লাগবে; অর্থনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশটা আগে লাগবে।”
বিনিয়োগ টানতে সরকারের প্রতিশ্রুতি মোতাবেক ‘সংস্কার’ কর্মসূচির যে কথা বলা হয়েছে, তা বাজেটে ‘ছোটো ছোটো পরিসরে’ আছে বলে মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান- বিআইডিএসের সাবেক এ মহাপরিচালক বলেন, ‘‘এটা তো অন্তবর্তীকালীন সরকার। সংস্কারের একটা সুযোগ আছে। এজন্য শক্ত পদক্ষেপ লাগবে। সে সুযোগটা তো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিতে পারে।’’