অনূদিত গল্প
Published : 07 May 2025, 09:07 AM
কন্নড় ভাষার লেখক বানু মুশতাক। তার প্রথম ইংরেজি অনুবাদবই ‘হার্ট ল্যাম্প: সিলেক্টেড স্টোরিজ’ ২০২৫ সালের আন্তর্জাতিক বুকার পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় জায়গা করে নিয়েছে। দীপা ভাস্তির অনুবাদে প্রকাশিত এই বইটিতে আছে ১২টি ছোটগল্প, যেখানে দক্ষিণ ভারতের মুসলিম নারীদের জীবনসংগ্রাম, কষ্ট আর আত্মমর্যাদা তুলে ধরা হয়েছে।
বানুর গল্পে নারী শুধু নিপীড়িত নয়—প্রতিবাদী, সাহসী ও আত্মবিশ্বাসী। সমাজের গোঁড়ামি আর পুরুষতান্ত্রিক শৃঙ্খলের ভেতর থেকেও নারীরা কীভাবে নিজেদের শক্তি খুঁজে পায়, সেটাই তার লেখার মূল বিষয়। ‘হার্ট ল্যাম্প’ গল্পে এক স্বামীর অন্যত্র বিয়ের পর মেয়ের চোখে উঠে আসে মায়ের প্রতি গভীর ভালোবাসা। সরল ভাষায় লেখা হলেও বানুর গল্পগুলো গভীর আবেগ ছুঁয়ে যায়। আজ প্রকাশিত হল তার শেষ পর্ব।
১৯৪৮ সালে জন্ম নেওয়া বানু মুশতাক একজন আইনজীবী ও অধিকারকর্মী। তিনি কর্ণাটক সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার (১৯৯৯) এবং পেন ইংলিশ ট্রান্সলেশন অ্যাওয়ার্ড (২০২৪) পেয়েছেন।
বাবা ঘর ছেড়ে বেরোনোর সময় মেহরুনের চোখ ভিজে গিয়েছিল। বাড়িতে যেন বিষাদের পর্দা নেমে এলো। স্কুল থেকে ভাইবোনেরা ফিরেও তা সরাতে পারল না। কারও হাতে ছিল নিজের নিজের কাজ, কারও মনে নিজ নিজ চিন্তা। বিকেলের আলো ফুরোতে শুরু করল, বাড়ির কোণে কোণে দীপ জ্বালানো হলো। কিন্তু মেহরুনের বুকের প্রদীপ তো অনেক আগেই নিভে গিয়েছিল। সে কাদের জন্য বাঁচবে? কেন বাঁচবে?
ঘরের দেয়াল, ছাদ, থালা-বাসন, চুলা, খাট, হাঁড়িপাতিল, উঠোনের গোলাপগাছ, কেউ কোনো উত্তর দিতে পারল না। মাঝে মাঝে তার চারপাশে যে জোড়া নিস্তেজ চোখ ঘুরে বেড়াত, পাহারা দিত, সেটাও সে ঠিক টের পেত না। সালমা চাইছিল বইয়ের ভেতর ডুবে থাকতে; সামনেই তার এসএসএলসি পরীক্ষা। কিন্তু এক অজানা ভয়, এক নামহীন উদ্বেগ তাকে মায়ের চারপাশে বেঁধে রাখত। রাতের নিস্তব্ধতায় মেহরুন অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে ছিল। তেমনই কালো, যেমন তার জীবন। সন্তানরা ঘুমিয়ে পড়েছে। শুধু সালমা ড্রয়িংরুমে বসে পড়াশোনা করছে, কিন্তু তার দৃষ্টি ছিল মায়ের ঘরের দিকে।
মেহরুনের চোখে ঘুম আসছিল না। ভাবছিল, নিজের পিতৃগৃহে লড়াইগুলো কি কম ছিল? ইনায়াতের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার দ্বিতীয় বর্ষের বিকম পরীক্ষার ঠিক এক মাস আগে। কেঁদে-কেঁদে পরীক্ষায় বসার অনুমতি চেয়েছিল, কিন্তু কারও কানে কথা পৌঁছায়নি। বিয়ের সপ্তাহখানেক পর, সাহস করে স্বামীর কাছে আবার বলেছিল। ইনায়াত হেসে উঠেছিল, আদরের নামে ডেকেছিল, ‘প্রাণ’, ‘প্রিয়’, ‘আমার হৃদয়’। বলেছিল, ‘তুমি না থাকলে আমি কি বাঁচব?’ মেহরুন বিশ্বাস করেছিল, যদি সে না থাকে, ইনায়াত হয়তো সত্যিই বাঁচবে না।
তখন তার হৃদয় আনন্দে ভরে উঠেছিল। স্বামীর ইচ্ছাই ছিল তার ইবাদত; তার আলোয় আলোকিত ছিল সেই হৃদয়। শ্বশুর-শাশুড়ি মৃত্যুবরণ করার পর, প্রায় এক বছর আগে, মেহরুন প্রথমবারের মতো স্বামীকে পুরোপুরি নিজের করে পেয়েছিল। ননদরা স্বামীর ঘরে চলে গিয়েছিল, দেওররা নিজ নিজ গন্তব্যে। নিজের একটা সংসার, নিজের একটা ঘর, সেই বহু পুরোনো স্বপ্ন তখন সত্যি হয়েছিল। কিন্তু সেই ঘর যখন পেল, তখন তার মুখে ভাঁজ, হাতে ফুটে ওঠা শিরা, চোখের নিচে কালো ছায়া, পা ফেটে চৌচির, নখ ভেঙে-চিরে ময়লা জমে থাকা, সে কিছুই টের পায়নি। চুল পাতলা হয়ে গিয়েছিল, কোমলতার গন্ধ হারিয়ে গিয়েছিল, আর সে ছিল সবকিছুর প্রতি উদাসীন।
হয়তো ইনায়াতও টের পেত না, যদি না তার অ্যাপেন্ডিক্সের অস্ত্রোপচার হতো। আর যদি না হতো সেই নার্স, কম টাকায় খাটুনি খাটা, চোখে হাজারো স্বপ্নের ঝিলিক, সেই মেয়ে, যে হয়তো মাটিতে হাঁটত, আবার মনে হতো যেন বাতাসে ভাসে। চামড়ায় আলো, চোখে মধুরঙা টান, যেন চৌম্বক টানে টেনে নেয়। ত্রিশের শেষ প্রান্তে পৌঁছে আসা সেই নারী, যে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য, স্বপ্নপূরণের জন্য, সবকিছু করতে প্রস্তুত ছিল, সবকিছু।
ইনায়াত কখনো তাকে ‘সিস্টার’ বলে ডাকেনি। প্রথম দিন থেকেই, হাসপাতালের প্রতিটি দিনে, সে নার্সের নাম ধরে ডেকেছে। তারপর সে অপমান করেছিল সেই গর্ভকে, যে তাকে সন্তানের পিতা করেছিল। মেহরুনের ঝুলে পড়া শরীর, প্রসারিত পেট, সবকিছুর কটাক্ষ করেছিল, যে শরীর সন্তানদের ক্ষুধা মেটাতে দান করেছিল। তার আত্মাকেও নগ্ন করে দিয়েছিল ইনায়াত। একদিন ঠান্ডা গলায় বলেছিল, ‘তুমি আমার মায়ের মতো।’ আর সেই কথাই তাকে জীবন্ত নিক্ষেপ করেছিল নরকের মধ্যে।
কতকিছু বদলে গিয়েছিল সেই কয়েক মাসে। নিজেরই ঘরে প্রতিটি গাল খাবার তার কাছে পাপ মনে হতো। নিজের ভিটেতে নিজেকে পরবাসী মনে হতো। অপমানের আগুনে পুড়ে যেতে যেতে, সে তখন নিজের পরিবারের দ্বারস্থ হয়েছিল। রাত আরো ঘন কালো হয়ে উঠছিল। মেহরুনের বুকের ভেতরেও জমাট বাঁধছিল ব্যথা। এমন নিঃসঙ্গতা সে কখনো অনুভব করেনি। আর কোনো চাওয়া ছিল না তার। সে ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসে। কেউ ছিল না, যে এসে তাকে খোঁজ নেবে। কেউ ছিল না, যে ঠাট্টা করে বলবে কিছু, কিংবা জড়িয়ে ধরবে, ভালোবাসবে। যে করত, সে এখন অন্য কারও হয়ে গেছে।
জীবন যেন এক অনন্ত দুঃস্বপ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেছন থেকে ভেঙে পড়া ছবির আওয়াজেও সে নড়ল না। সে জানত, একটা ফ্রেম ভেঙে গেছে, কাচ ছড়িয়ে পড়েছে, ছবি মেঝেতে পড়েছে, কিন্তু তবুও কোনো উৎসাহ ছিল না তার সেই ভাঙাচোরা গুছিয়ে তোলার। ধীরে ধীরে বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। শিশুর