ভ্রমণগদ্য
Published : 24 Jun 2025, 01:46 PM
প্রবাস জীবনের একটি বড় অংশই কাটালাম ‘স্মার্ট সিটি’ নামে পরিচিত সিঙ্গাপুর শহরে। হঠাৎ হাতে কয়েকদিন ছুটি পাওয়ায় গিন্নীকে নিয়ে বেড়িয়ে আসলাম ‘রোমান্টিক আইল্যান্ড প্যারাডাইস’ খ্যাত মালদ্বীপ। ধারাবাহিকভাবে তিন খণ্ডের আজ পরিবেশন করছি তার দ্বিতীয় খণ্ডটি, হুলহুমালে দ্বীপ ভ্রমণের গল্প। আরো থাকছে মালদ্বীপের নামটি কেমন করে হলো? তারই কিছু পৌরাণিক রূপকথা।
বিমানবন্দর থেকে বের হয়েই আমরা মূল রাজধানী মালে দ্বীপ ভ্রমণ করেছিলাম। তার বিস্তারিত গল্প বলেছি প্রথম খণ্ডে। মালদ্বীপ দেশটি গড়ে উঠেছে হাজার খানেক দ্বীপের সমন্বয়, তবে প্রায় দুইশত দ্বীপটিতে মানুষ বসবাস করে। আমরা যে হোটেলটি নিয়েছি তা রয়েছে হুলহুমালে দ্বীপে। মূল রাজধানী শহর মালে দ্বিপের সাথে এই হুলহুমালে দ্বীপটি একটি ব্রিজের মাধ্যমে সংযুক্ত যার নাম ‘সিনামালে ব্রিজ’। এটি ২০১৮ সালে উদ্বোধন করা হয়। পরে জানলাম যে ‘সিনা’ মানে হলে চীন, আর ‘মালে’ হল মালদ্বীপের রাজধানী। চীন সরকারের সহায়তায় এই ব্রিজটি তৈরি বলে চীনের নাম সংযুক্ত করে ‘সিনামালে’ নামকরণ করা হয়েছে।
হোটেলে আসার পথে ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে গল্প শুরু করলাম। তার কাছে জানতে চাইলাম মালে শহরের কথা। তিনি বললেন, অনেক অনেক বছর আগে, মালদ্বীপের বর্তমান রাজধানী মালে ছিল একটি নির্জন স্যান্ডব্যাঙ্ক, মানে বালির ছোট দ্বীপ। এখানে শুধু গিরাভারু নামে পরিচিত কিছু জেলে মাছ ধরত এবং তাদের ধরা মাছ এই জায়গায় পরিষ্কার করত। ফলে, পানি লাল হয়ে যেত মাছের রক্তে। এই কারণেই স্থানটির নাম হয় ‘মালে’, যার অর্থ রক্তে ভেজা।
একদিন এক রাজপুত্র এই দ্বীপে এসে পৌঁছান। তার নাম ছিল কোইমালা। তিনি মূলত ভারতীয় উপমহাদেশ থেকে এসেছিলেন। গিরাভারুর মানুষজন তাকে অতিথি হিসেবে স্বাগত জানায় এবং এখানে বসবাস করতে দেয়। ধীরে ধীরে এখানে গাছপালা লাগানো হয়, একটি প্রাসাদ তৈরি হয়, এবং কোইমালা এই দ্বীপের রাজা হন। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি মালদ্বীপকে একীভূত করেন এবং মালেকে রাজ্য শাসনের কেন্দ্র বানান। আজকের আধুনিক মালে শহরের শিকড় সেই কোইমালার গল্পে রয়ে গেছে।
ট্যাক্সি ড্রাইভারের সাথে গল্প করে জানলাম, বিমানবন্দর ও আমরা যে হোটেলে রয়েছি তার নাম হুলহুমালে দ্বীপ। তবে মজার ব্যাপার হলো, এই দ্বীপটি কিন্তু প্রাকৃতিক নয়। এটি মানবসৃষ্ট কৃত্রিম দ্বীপ। সমুদ্রের তলদেশ থেকে বালু তুলে ভরাট করা হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। ১৯৯৭ সালে শুরু হয় প্রকল্পটি এবং ২০০৪ সালে প্রথম দিকের কিছু মানুষ এখানে বসবাস শুরু করেন। হুলহুমালে পরিকল্পিতভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে একটি ‘স্মার্ট সিটি’ হিসেবে, যেখানে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি, হাইটেক অবকাঠামো, ও আধুনিক জীবনের সব সুবিধা থাকবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে মালদ্বীপের অনেক দ্বীপ ভবিষ্যতে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই ভবিষ্যতের কথা ভেবে এবং জনসংখ্যার চাপ কমানোর জন্য হুলহুমালে তৈরি করা হয়েছে। এটি মালদ্বীপের ভবিষ্যতের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে পরিকল্পিত।
কোথাও বেড়াতে গেলে ট্যাক্সি ড্রাইভারদের কাছে দেখেছি অনেক স্থানীয় তথ্য পাওয়া যায়, যা গাইড বইয়ে পাওয়া যায় না। তাই আমি সবসময় চেষ্টা করি ড্রাইভার কিংবা স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলতে। হোটেলে চেক ইন করবার সময়েই আমাদের জন্য হোটেলের বেয়ারা ওয়েলকাম ড্রিংক নিয়ে আনলো। ফলের রসের শরবত, বেশ ভালোই লাগলো এবং তাদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ হলাম। তৃতীয় তলায় একটি ছোটখাট রুম নিয়েছিলাম। রুমটি ছোট হলেও সবকিছুই আছে তাতে।
হোটেলের রুমের সাথে রয়েছে একটি বারান্দা, যেখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়। এই সমুদ্রের দিকের রুম নেওয়ার জন্যই খরচটা একটু বেশিই পড়ে গিয়েছিল। তারপরও রাতের বেলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে সমুদ্র দেখবার লোভেই এই রুমটি নিয়েছিলাম। মিতুও বেশ পছন্দ করল হোটেলের রুমটি। বারান্দায় দাঁড়িয়ে পাশেই সমুদ্রটি দেখে মুগ্ধ হলাম। হোটেলটি একেবারেই সমুদ্রতটের পাশে। সামনেই সমুদ্রের সৈকত দেখে মিতুকে বললাম, চল তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নাও, সমুদ্র ডাকছে আমাদের।
হোটেল থেকে বেরিয়েই সামনের সৈকতের নীলচে সবুজ জলে ঝাঁপ দিলাম আমরা দুজনেই। সেই মুহূর্তে মনে হলো, চারপাশের শব্দ যেন থেমে গেছে। শুধু ঢেউয়ের ছলাৎছল, আমাদের হাসির রেশ, আর উষ্ণ নোনাজলের মাঝে এক অদ্ভুত মুক্তির অনুভূতি। এত সুন্দর সমুদ্র এবং এর পানি এত সুন্দর যে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। সমুদ্রের পানি এতটা পরিষ্কার আর স্নিগ্ধ, যেন কোনো রঙের প্যালেট থেকে স্বর্গের জলকে তুলে এনে ঢেলে দেওয়া হয়েছে এখানে। একেক জায়গায় একেক রঙ। কোথাও হালকা ফিরোজা, কোথাও গাঢ় নীল, আবার কোথাও একদম স্বচ্ছ। মনে হচ্ছিল, আমরা কোনো পোস্টকার্ডের ছবির মধ্যে হেঁটে যাচ্ছি।
সমুদ্রের ধার ঘেঁষে আমরা অনেকদূর হেঁটে এলাম। কখনো পায়ে পানি ছুঁয়ে যাচ্ছে, কখনো বালি একটু দিচ্ছে পায়ে গেঁথে যাওয়ার অনুভূতি। একসময় ফিরে এলাম হোটেলের দিকে, কিন্তু মনে হচ্ছিল এই সমুদ্র, এই হাঁটা, যেন চিরকাল আমাদের সঙ্গী হয়ে থাকবে। এই দ্বীপের বালি আসলে সাধারণ বালি নয়, এটি ‘প্রবালজাত বালি’, যা গঠিত হয় ভাঙা প্রবাল, সামুদ্রিক শামুকের খোলস ও সামুদ্রিক জীবের সূক্ষ্ম কণিকা থেকে।
সেদিন রাতে আমরা বের হলাম স্থানীয় খাবার খেতে। হাঁটতে হাঁটতে একটি রেস্তোরাঁর জানালার পাশে লেগে থাকা তাজা মাছের গন্ধ বাতাসে ছড়িয়ে আছে। ভেতরে ঢুকতেই দেখি কয়েকজন বাংলাদেশি ভাই রান্না করছেন। এমন পরিচিত ভাষা আর হাসিমুখ দেখে মনটা হালকা হয়ে গেল। আমরা বললাম, “কিছু স্থানীয় খেতে চাই, ভাই।” ভাই হেসে বললেন, “চিন্তা কইরেন না, আমরা দিলাম মাফাহু, গারুধিয়া, আর বানাস।”
খুব একটা চিনতাম না নামগুলো, তবে খিদের তাড়নায় সাহস নিয়ে খেলাম। প্রথমেই দিলো ‘গারুধিয়া’। এটা এক ধরনের স্বচ্ছ টুনা ফিশ স্যুপ। লেবু, পেঁয়াজ আর মরিচ দিয়ে মিশিয়ে খেতে হয়। পরিশ্রান্ত শরীরে গরম এই স্যুপ যেন প্রশান্তির মতো লাগলো। এরপর খেলাম ‘মাস হুনি’, এটা এক ধরনের নরম ডালপুরির মতো রুটি, যার স্থানীয় নাম ‘রোশি’। আর সঙ্গে টুনা মাছ, নারিকেল কোরানো, পেঁয়াজ আর লাল মরিচ মিশিয়ে বানানো একটি শুকনো মিশ্রণ। এটা নাকি মালদ্বীপিদের প্রাতঃরাশের প্রধান খাবার! আরও খেলাম ‘ফিহুনু মাস’, আগুনে গ্রিল করা টুনা মাছ, লাল ঝাল মশলায় মাখানো। খেতে খেতে সেই ভাই বললেন, “মালদ্বীপে কিছুই তৈরি হয় না ভাই, সবকিছু আমদানি করতে হয়, এমনকি পেঁয়াজও!” তবে তিনি গর্ব করে বললেন, “এই মাছগুলো কিন্তু একদম স্থানীয়, সকালে ধরা!”
রাতে হোটেলের বারান্দায় বসে সামনের নিঝুম সমুদ্র আর আকাশের মিলনরেখার দিকে তাকিয়ে রইলাম। দূরে কোনো মাছধরা ট্রলারের আলো দুলছে। মালদ্বীপের জেলেরা রাতে সাধারণত সবুজ বা নীল আলো ব্যবহার করেন মাছ আকর্ষণের জন্য। গভীর জলে এই আলো ফ্লাইং ফিশ বা টুনা মাছকে টেনে আনে। সেই আলো ঢেউয়ের সঙ্গে দুলে যেন সমুদ্র নাচে। মাথার উপর নারকেল পাতার ফাঁক দিয়ে অনেক তারা দেখতে পেলাম। মালদ্বীপের আকাশে দূষণ কম থাকায় খালি চোখে অনেক বেশি তারা দেখা যায়। যারা স্টারগেজিং পছন্দ করেন, তাদের জন্য মালদ্বীপ এক আদর্শ স্থান।
ঢেউয়ের মৃদু শব্দ আর দূরের কোনো রাতচরা পাখির ডাকের মধ্যে আমি ঘুমিয়ে পড়লাম, পরদিনের অভিযানের স্বপ্ন চোখে নিয়ে। বিজ্ঞানীরা সমুদ্রের ঢেউয়ের মৃদু শব্দকে ‘পিংক নয়েজ’ বলেন, এবং তাদের মতে এটি মানুষের মস্তিষ্ককে শিথিল করে, গভীর ঘুমে সহায়তা করে। আসছে তৃতীয় খণ্ডে থাকবে মাফুসি দ্বীপ ভ্রমণের গল্প।
চলবে…