Published : 26 Jan 2025, 09:37 PM
ভিক্টোরিয়ান যুগের ইংরেজ কবি এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং (১৮০৬-১৮৬১)। তাকে তার বন্ধু মেরি রাসেল মিটফোর্ড ‘ফ্লাশ’ নামে একটি লাল রঙের ককার স্প্যানিয়েল প্রজাতির কুকুর উপহার দেয়। এলিজাবেথ তখন অবিবাহিত ও অসুস্থ, লন্ডনের উইম্পোল স্ট্রিটে তার বাবার বাড়িতে বেশিরভাগ সময় শয্যাশায়ী থাকেন। ‘ফ্লাশ’ তার নতুন মালিকের সঙ্গে দ্রুত মানিয়ে নেয়।
শিগগিরই এলিজাবেথের পায়ের কাছে আরামের জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায় ‘ফ্লাশ’। তবে এ সুখ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। এলিজাবেথের জীবনে আরেকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ইংরেজ কবি ও নাট্যকার রবার্ট ব্রাউনিং (১৮১২-১৮৮৯) প্রবেশ করে। ‘ফ্লাশ’ এতে হিংসা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতার নতুন অনুভূতি পেতে শুরু করে।
এলিজাবেথ ও রবার্ট যখন পালিয়ে ইতালিতে চলে যান, ‘ফ্লাশ’-ও তাদের সঙ্গে যায়। সেখানেই এলিজাবেথ বাবার কঠোর শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে নিজের স্বাধীনতা আবিষ্কার করেন, আর ‘ফ্লাশ’ আবার তার হারানো মুক্ত জীবনের কিছুটা স্বাদ পায়।
১৯৩৩ সালে প্রকাশিত এ উপন্যাসটি লিখেছেন উনিশ শতকের ব্রিটিশ আধুনিকতাবাদী লেখকদের মধ্যে অন্যতম ভার্জিনিয়া উলফ (১৮৮২-১৯৪১)। সাধারণ কোন উপন্যাস নয় এটি, এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিংয়ের পোষা কুকুর ‘ফ্লাশ’-এর জীবন নিয়ে লেখা, বাস্তব এবং কল্পনার মিশ্রণ।
‘ফ্লাশ’-এর দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা হলেও ঔপন্যাসিক উলফ তাতে এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিংয়ের কবিতা, চিঠি এবং তার জীবনের কিছু তথ্যও যুক্ত করেছেন। ফলে এটি একটি সৃজনশীল ও পরীক্ষামূলক কাজ, যা জীবনী ও কাল্পনিক গল্পের মধ্যে সীমানা মুছে ফেলেছে। যদিও ‘ফ্লাশ’ উলফের অন্যান্য কাজ, যেমন ‘মিসেস ডালোওয়ে’, ‘অরল্যান্ডো’ বা ‘টু দ্য লাইটহাউস’ এর তুলনায় কম আলোচিত, এটি তার সাহিত্যিক কর্মে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
‘ফ্লাশ’ উপন্যাস ছিল উলফের সাহিত্যিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার অংশ, যেখানে তিনি জীবনী লেখার প্রচলিত ধারাকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এবং নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কাজ করেছিলেন। উলফ সবসময় গল্প বলার প্রচলিত কাঠামো ভাঙতে পছন্দ করতেন। এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিংয়ের কুকুর ‘ফ্লাশের’ চোখ দিয়ে একটি গল্প বলা ছিল সেই সৃজনশীলতারই অংশ। এটি তাকে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জীবনী লেখার সুযোগ দেয়।
তার লক্ষ্য ছিল ব্যঙ্গাত্মক উপস্থাপনা। জীবনীর সীমাবদ্ধতাকে মজার ছলে বর্ণনা করেছেন। উলফ দেখিয়েছেন, একটি কুকুরের জীবনকেও গুরুত্ব দিয়ে লেখা সম্ভব, যেটি মানুষের জীবনের মতোই আকর্ষণীয় হতে পারে। উলফ ‘ফ্লাশের’ মাধ্যমে সমাজে শ্রেণি বিভাজনের প্রতিফলন দেখিয়েছেন। লন্ডনে বিভিন্ন শ্রেণির কুকুরের পার্থক্য তুলে ধরে তিনি তৎকালীন সামাজিক অবস্থাকে ইঙ্গিত করেছেন।
উলফ এই উপন্যাসে নারীদের অবস্থান নিয়েও বার্তা দিয়েছেন। ‘ফ্লাশ’ নামে একটি কুকুরের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে এলিজাবেথ ব্যারেট ব্রাউনিং তার বাবার কঠোর শাসনের মধ্যে থেকেও নিজের জীবনের পথ খুঁজে পেয়েছিলেন।
এছাড়া মানুষ ও প্রাণীর গভীর সম্পর্ক তুলে ধরতে এ বইটি ভূমিকা রেখেছে। ফ্লাশের বিশ্বস্ততা, অনুভূতি এবং মালিকের প্রতি তার ভালোবাসা উলফ সংবেদনশীলভাবে তুলে ধরেছেন। উলফ নিজেও কুকুর ভালোবাসতেন এবং মাঝেমধ্যে তার গম্ভীর কাজের ফাঁকে হালকা মেজাজের কিছু লেখার প্রয়োজন অনুভব করতেন।
১৯০৫ সালে লেখা ‘অন অ্যা ফেইথফুল ফ্রেন্ড’ শিরোনামে ভার্জিনিয়া উলফের একটি প্রবন্ধ রয়েছে, যেখানে মানুষের সঙ্গে তাদের কুকুর সঙ্গীর সম্পর্ক নিয়ে আবেগপূর্ণ ও অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন আলোচনা করেছেন তিনি। এ লেখায় উলফ কুকুরের বিশ্বস্ততা, বন্ধুত্ব ও তাদের অসাধারণ গুণাবলী তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে কুকুর তাদের নিঃশর্ত ভালোবাসা ও বোঝাপড়ার মাধ্যমে মানুষের জীবনে এক বিশেষ স্থান অধিকার করে।
‘ফ্লাশ’ উপন্যাসটিও সেইরকম একটি কাজ, যা তার মেধা ও রসবোধের পরিচয় দেয়। একসময় প্রাণীপ্রেমীদের কাছে এ বইটি বেশ জনপ্রিয় ছিল, বিশেষ করে যারা আরেক ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক আনা সেওয়েলের (১৮২০-১৮৭৮) ‘ব্ল্যাক বিউটি’ উপন্যাসটি পছন্দ করতেন।