ভ্রমণগদ্য
Published : 25 Jun 2025, 03:18 PM
প্রবাস জীবনের একটি বড় অংশই কাটালাম সিঙ্গাপুর তথা ‘স্মার্ট সিটি’ নামের এই শহরে। হঠাৎ হাতে কয়েকদিন ছুটি পাওয়াতে গিন্নীকে নিয়ে বেড়িয়ে আসলাম ‘রোমান্টিক আইল্যান্ড প্যারাডাইস’ নামে খ্যাত মালদ্বীপ। ধারাবাহিকভাবে তিনটি খণ্ডের আজকের শেষ খণ্ডে থাকছে মাফুসি দ্বীপের গল্প। এছাড়া থাকছে সেই দেশের গা ছমছম করে দেওয়ার পৌরাণিক কিছু গল্প ও কীভাবে একজন পীর এসে ইসলাম প্রচার করেছিল এই দেশটিতে।
এই দ্বীপে এসেছি মূলত সূর্যোদয় দেখার জন্য। তাই ঘড়িতে অ্যালার্ম দিয়েই তৈরি হয়ে নিলাম। খুব ভোরে উঠেই দেখি চারদিক অন্ধকার। একটু পরই সূর্য উঠবে বলে আমরা সমুদ্রতটে এসে বসলাম। খুব সকালে যখন সূর্যের আলো কম, তখন সমুদ্র কালচে নীল বা ধূসর দেখায়, আর সূর্য যত ওপরে ওঠে, রং হয় উজ্জ্বল ফিরোজা বা সবুজাভ নীল। ভোর বেলাতে সমুদ্রের পানি একেবারেই পরিষ্কার। একটু পর কোথাও একটি মোরগ ডেকে দিয়ে উঠলো, জানান দিল ভোর হয়ে গেছে।
‘আইল্যান্ড হপিং’ বা একটি দ্বীপ থেকে আরেকটি দ্বীপে লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুরতে পর্যটকরা পছন্দ করে। যেহেতু মালদ্বীপে অনেকগুলো দ্বীপ, তাই আমরা ঠিক করলাম একটি মাত্র দ্বীপ ভ্রমণ করবো। মাফুসি দ্বীপে যাওয়ার জন্য হোটেল থেকে বেরিয়ে বাসে করে মালে দ্বীপে গেলাম। বাসে আমরা দুজন বাংলাদেশি ভাইকে পেয়ে গেলাম। তারা কয়েক দশক ধরে এখানে আছেন। তাদের কাছেই জানলাম যে, মালদ্বীপে প্রচুর বাংলাদেশি শ্রমিক আছেন। একজন তো বলেই ফেললেন, “এই মালদ্বীপে যে বিল্ডিংগুলো দেখছেন, তার বেশিরভাগই আমরা বাংলাদেশিরা তৈরি করেছি।”
প্রবাসী ভাইদের সাথে কথা বলতে বলতে আমরা মালে শহরে পৌঁছে গেলাম। বাস থেকে নেমে তাদেরকে বিদায় দিয়ে স্পিডবোট টার্মিনালের দিকে রওনা দিলাম। একটু পরে মাফুসি দ্বীপে আসার স্পিডবোট আসলে আমরা সেটিতে উঠে গেলাম। যাওয়ার জন্য ২৫ ডলার গুণতে হলো। স্পিডবোটগুলো বেসরকারি প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হওয়ার কারণে দাম একটু বেশি। তবে সরকারি ফেরিগুলিতে যাতায়াত খরচ দুই-এক ডলার। কিন্তু শুক্রবার ছুটির দিন বলে সেইগুলো বন্ধ। উপায় নেই দেখে আমরা স্পিডবোডে উঠে গেলাম। স্পিডবোট চলা শুরু করলো এবং সমুদ্রের বুকে পথ কেটে দ্রুত চলতে থাকলো।
আমরা ছুটে চললাম সবুজ-নীল পানির বুক চিরে। পানির এমন রং আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি। কোথাও গভীর নীল, কোথাও এতটাই স্বচ্ছ ফিরোজা যে নিচের প্রবালপ্রাচীরের আভাস মেলে। দুপাশে মাঝে মাঝে বালুকাবেলা ভেসে উঠছে, কোথাও আবার সবুজ বৃক্ষরাজি ঘেরা দ্বীপ, কোনোটিতে সুউচ্চ একটি বর্ণিল বাতিঘর নজরে এলো। বাতাসে লবণের স্বাদ, জলীয় বাষ্পে চুল ভিজে আসছে একটু একটু করে।
এ দেশটির প্রতিটি দ্বীপই মূলত প্রবালের তৈরি প্ল্যাটফর্মের উপর গড়ে ওঠা সমতল ভূমি। প্রবাল দ্বীপ বলেই এদের উচ্চতা খুব কম, অনেক দ্বীপের মাটি সাগরপৃষ্ঠ থেকে মাত্র দেড়-দুই মিটার উঁচু। ভাবতে অবাক লাগে, এত নাজুক ভূখণ্ডের উপরও মানুষের সভ্যতা কত সুন্দরভাবে গড়ে উঠেছে! মনে হচ্ছিল, যেন আমরা এক জীবন্ত রূপকথার দ্বীপে এসেছি, যেখানে মৃত প্রবালের উপর গড়ে উঠেছে জীবনের আশ্চর্য নকশা, আর সূর্যের আলোয় সেই নির্মাণ এখন ঝলমল করে জলের আয়নায়।
সমুদ্রের উপর দিয়ে যেতে যেতে সকালের সূর্যের আলোতে সমুদ্রের পানি ঝিকমিক করছে। মাঝিদের দেখলাম একটি বিশেষ নৌকাতে করে মাছ ধরছে। স্থানীয় এই নৌকাগুলোর নাম ‘ধোনি’। নারিকেল গাছের কাঠ দিয়ে তৈরি এই ধোনির তৈরি প্রণালি যুগের পরে যুগ তাদের বংশপরম্পরায় বাহিত হয়। কাগজে কোন নকশা নেই, কিন্তু তারা নিজেরাই যুগের পরে যুগ পরবর্তী প্রজন্মকে হাতেনাতে শিখিয়ে দেয়। ঐতিহাসিকদের মতে এই ডিজাইন এসেছে আরব ‘ধাউ’ নৌকার নকশা থেকে। আরব ব্যবসায়ী ও ধর্মপ্রচারকরা তাদের সাথে এই নৌকা নিয়ে এনেছিল, সম্ভবত সেখান থেকেই স্থানীয়রা এই ‘ধোনি’ তৈরির কৌশল শিখে। ধোনির পেছনের অংশ সামান্য উঁচু এবং সামনের অংশটি বাঁকা থাকে, যেন সমুদ্রের ঢেউ মাঝে পথ তৈরি করে চলতে পারে।
মাত্র আধঘণ্টার মধ্যে সবুজে ঘেরা ছোট্ট দ্বীপ মাফুসির ঘাট দেখা দিল। এখানে চকচকে জেটির বদলে কাঠের ছোট পন্টুনের সাথে আমাদের স্পিডবোটটি বেঁধে ফেলা হলো। পা রাখতে মনে হলো, একেবারে আলাদা জগতে প্রবেশ করেছি। এখানে পর্যটকদের কোলাহল নেই, আছে স্থানীয় জীবনধারার সহজ সরল ছন্দ। বালির রাস্তা, দুপাশে নারকেল, সুপারি আর প্যান্ডানাস গাছের ছায়া। উজ্জ্বল দিনের সোনালি আলোতে দ্বীপটি ঝকঝক করছে। চারদিকে অপার শান্তি, শুধু নারকেল পাতার মৃদু সরসর আর দূরে প্রবাল প্রাচীরে ঢেউ ভাঙার নরম গর্জন শুনতে পাচ্ছি। বালুকাবেলায় পা রাখতেই টের পেলাম, বালির দানাগুলো কী অসম্ভব সূক্ষ্ম আর সাদা। প্রবালের গুঁড়ো থেকে তৈরি বলে তুলোর মতো নরম লাগে পায়ে।
মাফুসি দ্বীপটি বেশ ছোট, চারদিকে আমরা হেঁটেই ঘুরে এলাম। দ্বীপের চারদিকে কোনোকিছু নেই, শুধু সমুদ্রের নীল পানি। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি আর পানি। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই দ্বীপে বসে সমুদ্রের বাতাস উপভোগ করলাম। সমুদ্রের পাড়ে বসে থেকে হঠাৎ পিপাসা লাগলে, পাশেই একটি ছোট খুপরির মতো একটি দোকানে কিছু পানীয় এর অর্ডার দিলাম। দোকানে স্থানীয় লোকজন কিছু পর্যটকদের সাথে মালদ্বীপের গল্প করছিলেন।
স্থানীয় একজন বৃদ্ধ লোক বললেন, “লোককথায় বলে, মালদ্বীপের প্রথমদিকের বাসিন্দারা অনেকেই কোন এক মহামারিতে মারা গিয়েছিলেন। তখন এক মহাতান্ত্রিক, এখানে যাকে ‘ফান্ডিতা’ মানুষ বলা হয়। তিনি জাদুবলে সেই মৃত মানুষের খুলিগুলো থেকে নারকেল গাছ জন্ম দেন। একটি একটি করে প্রতিটি সমাধিতে নারকেল গাছ গজালো, মাথার খুলি থেকে জন্ম নিল নতুন গাছ। তাই আমাদের মানুষের সঙ্গে নারকেল গাছের এক অদ্ভুত আত্মীয়তা। মালদ্বীপের কাহিনিতে বলা হয় নারকেল গাছের মধ্যে মানুষের আত্মার অংশ রয়েছে।” আমি বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেলাম এই গল্প শুনে। সত্যিই, মালদ্বীপের জাতীয় প্রতীকেও নারকেল গাছের চিহ্ন রয়েছে, তার পেছনে এমন কিংবদন্তি লুকিয়ে আছে জেনে অবাক হলাম।
উনার গল্প শুনতে আশপাশে আরো কিছু পর্যটক এসে জমা হলো। গল্পের আসর জমে উঠল। আমি আরেকটা গল্প বলার অনুরোধ করলাম। স্থানীয় লোকটি বললেন, “আমাদের দ্বীপে ছোটবেলায় শুনতাম রাতবিরাতে সমুদ্রের ধারে সুন্দরী রূপ ধরে কিছু জিন ঘোরে; ওদের দেখা পেলে ভুলেও পেছনে ডাকতে নেই।” উনি গলা নামিয়ে যোগ করলেন, “সে সব পুরনো কথা। তবে একটা বড় কাহিনি আছে দেশের। রান্নামারি নাম শুনছো?” আমি মাথা নেড়ে ‘না’ বললাম। উনি বলতে লাগলেন, “এই দ্বীপদেশের রাজা-বাদশাহদের আমলে সমুদ্রের তলে এক ভয়ানক দানব ছিল, নাম রান্নামারি। এই দৈত্যটি ছিল এতটাই ভয়ংকর যে, তার হাতের আকার পায়ের আঙুল পর্যন্ত পৌঁছাত এবং তার রঙ ছিল পিচকালো। প্রতি মাসে পূর্ণিমার রাতে একটি কুমারী মেয়েকে তার জন্য উৎসর্গ না করলে সে নাকি রোষে ফেটে পড়ত। রাজা বা তার লোকেরা দ্বীপের কোনো মেয়েকে বেছে নিয়ে মালের মন্দিরের পাশে সাগরতীরে বেঁধে রাখত রাতে, সকাল হলে পরিবার এসে শুধু মেয়েটির মৃতদেহ পেতো। এভাবে চলছিল অনেকদিন।”
স্তব্ধ হয়ে আমরা শুনছি। উনি একটু নাটকীয় বিরতি নিয়ে আবার বললেন, “বারশ শতকে, মরক্কোর এক মুসলিম ব্যবসায়ী ও সাধক, আবু আল-বারকাত ইউসুফ আল-বারবারি, মালদ্বীপে আগমন করেন। তিনি স্থানীয় এক পরিবারের আতিথ্য গ্রহণ করেন, যাদের কন্যা রান্নামারির বলির জন্য নির্বাচিত হয়। আবু আল-বারকাত এই প্রথায় মর্মাহত হয়ে, কন্যার পরিবর্তে নিজেই মন্দিরে রাত কাটানোর সিদ্ধান্ত নেন। রাতে, তিনি কুরআনের আয়াত পাঠ করতে থাকেন। রান্নামারি সমুদ্র থেকে উঠে এসে কুরআনের শব্দে কষ্ট পেয়ে সাগরে ফিরে যায় এবং আর কখনো ফিরে আসেনি।”
এই অলৌকিক ঘটনার পর, মালদ্বীপের রাজা ধোভেমি ইসলাম গ্রহণ করেন এবং সুলতান মুহাম্মদ আল-আদিল নামে পরিচিত হন। তিনি দেশের সর্বত্র ইসলাম প্রচার করেন। আবু আল-বারকাত মালদ্বীপে বসবাস করেন এবং ইসলাম শিক্ষা দেন। তার মৃত্যুর পর তাকে মালের হুকুরু মিসকিয়ের পাশে মেধু জিয়ারায়িতে সমাহিত করা হয়। এই ঘটনাটি আজও মালদ্বীপের ইসলামিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। তার মাধ্যমেই মালদ্বীপের মানুষেরা এই নরবলি প্রথা থেকে মুক্তি পায়।
গল্পটা শুনে আমাদের কারোরই কথা সরছিল না। কী ভয়ঙ্কর এক উপকথা, অথচ এর মধ্যেই লুকিয়ে আছে মালদ্বীপে ইসলামের আগমনের ইঙ্গিত। ছোট্ট দ্বীপদেশের লোকবিশ্বাসের রূপকথা যেন রোমাঞ্চ উপন্যাসকেও হার মানায়। গল্পের সূত্রে জানতে পারলাম মালদ্বীপের সংস্কৃতিতে জাদুটোনা খুব প্রচলিত ছিল। বৃদ্ধ লোকটি বললেন, “আগে গ্রামের বড়-বুড়োরা অনেক ঝাড়ফুঁক জানতো, সাগর শান্ত করতে মন্ত্র পড়তো, কেউ অসুস্থ হলে নারকেল তেল পড়া পানি খাওয়াতো, এসব এখন অনেক কমে গেছে।”
আরো শোনা গেল, কিছু কিছু জায়গা আছে যেসব পাশ দিয়ে রাতে কেউ যায় না। কোনো পুরনো কুয়া বা বনবাদাড়, যেখানে নাকি আত্মারা ঘোরাঘুরি করে। আমি ভাবলাম, প্রতিটি সংস্কৃতির মতো এখানেও দৈনন্দিন জীবনের সাথে কত অলৌকিক বিশ্বাস জড়িয়ে আছে।
দ্বীপের একটি কোণায় একটি বড় হোটেল আছে, সেখানে বিদেশি পর্যটকদের ভিড়। তার পাশেই একটি স্থানীয় বাজার চোখে পড়লো। সেখানে স্থানীয় একটি ফলের জুস বিক্রি করছে, নামটি বেশ চমৎকার ‘স্ক্রু পাইন জুস’, স্থানীয় ভাষায় এর নাম ‘কাশি কেয়ো’। কাঁঠালের মতো বড় এই বিশাল স্ক্রু পাইন ফল দেখে অবাক হওয়ার জোগাড়। সেটি কেটে ভেতরের নরম অংশটি কেটে চিনি ও বরফ মিশিয়ে তা দিয়ে জুস তৈরি করে দিলো। মালদ্বীপে এটি শুধু পানীয় হিসেবেই নয়, বরং হালকা জ্বর, ক্লান্তি বা হজমের সমস্যায় প্রাকৃতিক ঘরোয়া চিকিৎসা হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।
একটু পর বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে আসছে। জলের ধারে এসে বসতেই দেখলাম অদ্ভুত এক দৃশ্য। সমুদ্রের ঢেউগুলো যেন নীল আলো নিয়ে তীরে এসে আছড়াচ্ছে। প্রথমে ভাবলাম চোখের ভুল, এরপর বুঝলাম পানির ভেতর অগণিত জ্বলজ্বলে বিন্দু, ঠিক যেন আকাশের তারারা নেমে এসেছে সাগরের বুকে। জীবন্ত প্ল্যাঙ্কটনের জৈব-দীপ্তির এই খেলা, যাকে ‘সি অব স্টারস’ বলা হয়। মালদ্বীপের কিছু দ্বীপে মাঝেমধ্যেই এটা দেখা যায়। নরম ঢেউ যখন তীরে মিলিয়ে যাচ্ছে, প্রতিটি তরঙ্গে অসংখ্য নীল আলো জ্বলে উঠছে আর নিভছে।
একটু পরই মাফুসিকে বিদায় দেওয়ার পালা। আমরা স্পিডবোটের দিকে হাঁটা শুরু করলাম। এই দ্বীপের ভ্রমণটি এক অদ্ভুত অনুভূতি দিলো। পথে ছোট ছোট কিছু দ্বীপ চোখে পড়লো। আর তার নামগুলোও অদ্ভুত- গুলহি, অনন্তারা দিঘু, ক্রসরোড, বলিফুসি, আরো কত নাম না জানা দ্বীপ। দ্বীপের দেশ। কিছু কিছু দ্বীপের বালুতটে আলো ঠিকরে এসে এক অদ্ভুত দৃশ্য তৈরি করছে। অন্ধকারের যে একটি অন্যরকম সৌন্দর্য আছে, তা টের পেলাম।
কিছু দ্বীপের বালির কিনারায় রাতে দেখতে পাওয়া যায় নীলাভ ঝিলমিল, এই দৃশ্যকে বলে ‘সি অফ স্টারস’। এটি মূলত কিছু মাইক্রো অর্গানিজম বা প্ল্যাঙ্কটনের কারণে হয়। এসব ভাবতে ভাবতে ফিরে এলাম মূল শহরে, সেই দ্বীপে যেখানে মালদ্বীপের আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, হুলুলে। এরপর বাসে করে আমরা হোটেলে পৌঁছে গেলাম। এবার সিঙ্গাপুরে ফেরার প্রস্তুতি। শরীর ক্লান্ত, মনে নীল জলরঙে আঁকা এক টুকরো স্বপ্ন।