Published : 12 Jun 2023, 03:59 PM
৩
ঝন্টুদের অ্যাডভেঞ্চার ক্লাব থেকে প্রতি শীতে কোথাও না কোথাও যায়। এবারের গন্তব্য সাগরকন্যা কুয়াকাটায়। বাংলাদেশের একমাত্র এখান থেকেই সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়। অ্যাডভেঞ্চার ক্লাবের লিডার টুটুল ভাইয়ের সবকিছুতেই অ্যাডভেঞ্চার চাই। ভ্রমণটাও ভ্রমণের মতই হবে। যাত্রাপথ হবে উপভোগ্য। উপভোগ ও খরচ দুই বাঁচাতে এক দঙ্গল ছেলে নিয়ে টুটুল ভাই সদরঘাটে উপস্থিত হলো।
টুটুল ভাইয়ের উপর অভিভাবকদের অতিরিক্ত আস্থা থাকায় কেউ আর জ্যাম ঠেলে সদরঘাটে এলো না। এলে লঞ্চের ডেকে ঢালাও বিছানা চাদর পাততে দেখে অ্যাডভেঞ্চারের ওখানেই পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে দিত। ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে একগোত্রীয় সদস্যরা নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করতে থাকায় ডেকের যাত্রা কারো মন্দ লাগল না। বাংলা সিনেমা দেখারও ব্যবস্থা আছে। গ্রুপ করে করে টুটুল ভাইয়ের নেতৃত্বে লঞ্চের কেবিন থেকে মোটা চালের ভাত ও টাটকা ইলিশের লম্বা ঝোল খেয়ে আসা। আজ ইলিশ মাছ খেতে ঝন্টুর গলায় কাঁটা বিঁধল না। বিঁধলে খবর ছিল। লঞ্চে বিড়াল আছে কিনা আল্লাই জানে!
ঝন্টুরা চারবন্ধু। পলাশ, কিসলু আর ভুটোও এসেছে। ওরা টুটুল ভাইকে না জানিয়েই ছাদে চলে গেল। খবরের কাগজ বিছিয়ে চারজন চিৎ হয়ে শুয়ে আকাশভরা তারা দেখতে লাগল। লঞ্চের বেগের সাথে শীতের কাঁপনে চারজন গুটিসুটি হয়ে গেল। খবরদারি করা রোভার স্কাউট টুটুল ভাই এসেই গর্জে উঠলেন, শয়তানের দল, আমারে নাকাল না করলে তোদের শান্তি হয় না? ঘুমে একটু চোখ লেগে আসার জো নেই। সাথে সাথেই চার মূর্তি হাওয়া। কুয়াকাটায় যদি অমন কিছু করিস চারটেরই গলা কেটে কুয়ায় ফেলে দেব। কুয়াকাটার নাম সার্থক হবে। চল নিচে চল। ঘুম দিবি। না হলে জায়গামত গিয়ে সব পড়ে পড়ে ঘুমাবি।
বরিশাল নেমে সস্তার হোটেলে দলবেঁধে নাস্তা খাওয়া হলো। তারপর পটুয়াখালীর উদ্দেশ্যে যাত্রা। বাই বাস। কুয়াকাটা সহজ পথ নয়। টুটুল ভাইয়ের মতো লোকও অস্থির হয়ে পড়ল। এই বাস বদল, ব্যাগ টানাটানি আর একুশজন ছেলের উপর নজর রাখা। একবার আক্ষেপ করে বলেই ফেলল, নাহ, ওর চেয়ে ঢাকা থেকে সরাসরি প্যাকেজ সিস্টেমে বাসে চলে আসতে হতো। ফেরার পথে আর এ ভুল করব না।
ঝন্টুরা চার মূর্তিই সাঁতারে পটু। কাজেই তারা পানিতে নেমে তরতর করে ঢেউয়ের দিকে এগিয়ে গেল।
পথে চৌদ্দগন্ডা ফেরি পড়ল। পটুয়াখালী এসে কিছুটা যাত্রা বিরতি। শীতের সিজন বাঙালির ভ্রমণের সিজন। দলবেঁধে লোক সূর্যাস্ত দেখতে চলেছে। পটুয়াখালী থেকে বাস পেতে বেগ পেতে হলো। শেষে লক্করঝক্কর মার্কা একটা বাসে তারা ঠেলেঠুলে উঠে পড়ল। কুয়াকাটায় আসতে আসতে দুপুর হয়ে গেল। ভাগ্য ভালো টুটুল ভাই আগেই হোটেল বুকিং দিয়ে রেখেছিল। না হলে সিবিচেই শুয়ে থাকতে হতো। সবগুলো হোটেলই ভর-ভরান্ত।
টুটুল ভাইয়ের পয়সা বাঁচানোর ধান্দায় হোটেলটা সুবিধের নয়। এখনও কোন নেমপ্লেটই লাগায়নি এরা। কনস্ট্রাকশনের কাজ এখনও শেষ হয়নি। নিচতলা শেষ হয়েছে। ভাড়া দিয়ে দিয়েছি। এখন গ্রিল ট্রিল লাগানো হয়নি। বাথরুম, পানির ব্যবস্থাও নেই। একটা টিউবওয়েল আছে উঠোনে। আছে একটু দূরেই গণবাথরুম। সিনিয়র ক্লাসের ভাইয়েরা একটু গাইগুই করলেও টুটুল ভাইয়ের ধমকে ঠান্ডা হয়ে গেল। অতো খুঁতখুঁতানি কেন তোদের? হ্যাঁ। যা দেখতে এসেছিস তাই মন ভরে দেখে যাবি। নাকি সারাদিন বাথরুমেই পড়ে থাকার প্লান করেছিস? বাথরুমের চিন্তায় ঘুম হচ্ছে না। চল সব সাগর থেকে গোসল দিয়ে আসি।
সাথে সাথে রৈ রৈ পড়ে গেল। সবাই এটাই চাইছিল। বাথরুম আর চাপকলের চিন্তা মাথায় রইল না। যার যার রুমে ব্যাগ রেখে জামাকাপড় খুলে হাফ প্যান্ট, থ্রি কোয়াটার প্যান্ট পরে সবাই ছুটল টুটুল ভাইয়ের পেছনে, যেন টুটুল ভাই হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালা। পেছনে কচিকাঁচার দল। টুটুল ভাইয়ের বয়ান চলছে একঘেয়ে স্বরে। সেই পুরনো রেকর্ড। আমি একা মানুষ। এতগুলো দুরন্ত ছেলে নিয়ে এসেছি। তোরা যদি নিজেরা নিজেদের সামলে-সুমলে না রাখিস তাহলে আমি একা কীভাবে পারব বল! আমার অনুমতি ছাড়া শুধু ক্লাস নিউ টেন আর ওল্ড টেন পানিতে নামবি। বাকিদের আমি নামাবো। তবে যারা সাঁতার জানে তাদের একটু ছাড় আছে।
ঝন্টুরা চার মূর্তিই সাঁতারে পটু। কাজেই তারা পানিতে নেমে তরতর করে ঢেউয়ের দিকে এগিয়ে গেল। টুটুল ভাই ক্লাস এইটের ছাত্রদের সামলে ব্যস্ত। এখানকার হোটেলও অদ্ভুত। নাকি টুটুল ভাইয়ের ব্যবস্থাপনার কারণে? শুধু তাদের কজনের জন্য টুটুল ভাই ছাপড়া টাইপের একটা খাওয়ার হোটেলের ব্যবস্থা করেছে। স্কুলের বেঞ্চের মতো বেঞ্চে বসে খাওয়া। পেছনের দরজা দিয়ে হোটেল মালিক ও তার পরিবারের ঘরসংসার রান্নাবান্না খেতে বসেই দেখা যায়।
খাওয়ার রকমও অন্যরকম। ভাত আর সবজি ফ্রি। শুধু মাছ অথবা মুরগির দাম দিতে হবে। তার চেয়ে বড় ব্যাপার হলো ওরা যা খেতে চায় তাই রান্না হবে। এ ব্যবস্থায় দেখা গেল একেকজনের একেক খাবার পছন্দ। কেউ মুরগি। কেউ মাছ। সমুদ্রের ধারে এসে সামুদ্রিক মাছে আগ্রহ দেখা গেল অনেকের। শেষমেষ লিডারের হস্তক্ষেপ। এবেলা মুরগি। রাতে রূপচাঁদা। পরের দুপুরের কোরাল।
সূর্যোদয় দেখার জন্য সিবিচে এই সাত সকালেও লোকে লোকারণ্য। যেন হোটেলের সব লোক চলে এসেছে। শুধু টুটুল ভাইয়ের দল বাদে।
দুপুরের খাওয়া শেষে টুটুল ভাই হোটেল রুমে শুয়ে রেস্টের কথা বললে সবাই একবাক্যে নাকচ করে দিল। সিনিয়ররা টুটুল ভাইয়ের মুখের উপর টুটুল ভাইয়ের কথা ফেরত দিল, আমরা যেরকম বাথরুম করতে এখানে আসিনি সেরকম শুয়ে রেস্ট নিতেও আসিনি। টুটুল ভাই বাংলা পাঁচের মতো মুখ করে বলল, চল তাহলে আদিবাসি পাড়া দেখে আসি। ওদের হাতের কাজ দেখতে পাবি। কুটিরশিল্প। ওখানে নাকি সন্ধের পরে ঢুকতে দেয় না।
সিনিয়র রোমেল ভাই বলল, আর সূর্যাস্ত দেখার পর কিন্তু আমরা মার্কেটে যাবো। গাইগুই করতে পারবেন না।
বৌদ্ধমন্দির আছে দেখতে যাবি না?
যাবো না কেন? অবশ্যই যাবো। আমরা কালকের দিনতো আছি।
তাহলে কালকে মার্কেটে যাস।
মার্কেটে প্রতিদিন যাবো।
পৃথিবীর অত বড় মার্কেট ঢাকা ছেড়ে এসেও তোদের মাথা থেকে মার্কেটে ঘোরার পোকা গেল না। জানিস না দুনিয়ার সবচেয়ে নিকৃষ্ট জায়গা হচ্ছে বাজার!
আদিবাসীদের ছোট ছোট তাতে বোনা গামছা চাদর তৈরি দেখতে দেখতে সন্ধে নেমে গেল। প্রথমে কেউ কিছু কিনছিল না। তারপর একজনের দেখাদেখি প্রায় সবাই ছোট ছোট তোয়ালে কিনে ফেলল। সিবিচে এসে সূর্যাস্ত দেখা। খ্যাচ খ্যাচ ক্যামেরার সাটার। ডিজিটাল। মার্কেট নিকৃষ্ট জায়গা বললেও সেখান থেকে টুটুল ভাইকে নাড়ানো গেল না। যেটা দেখে সেটাই পছন্দ হয়। দামে বনে না বলে আফসোস করে। গজরায়। শেষমেষ সস্তার কিছু কেনে।
৪
পরদিন খুব ভোরে ঝন্টুর ঘুম ভেঙে গেল। সূর্যোদয় দেখার নেশায় রাতে তার ভালমত ঘুমই হয়নি। সে উঠে দেখল তার রুমের কেউ দূরে থাক অন্য রুমেরও কেউ ঘুম থেকে জাগেনি। সব ঘুমে এলিয়ে আছে। সে মোটাসোটা ভুটোর গায়ে ধাক্কিয়ে জাগিয়ে তুলল। কী? কী? কী হয়েছে রে? ধাক্কাচ্ছিস কেন?
মড়ার মতো যে ঘুমাচ্ছিস। সূর্যোদয় দেখতে যাবিনে?
হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাতো যাবোই। সেজন্যই তো আসা। সবাই কি চলে গেছে নাকি?
নারে গাধা। কেউ ঘুম থেকে জাগেনি। চল আমরা সবাইকে টেক্কা দেই। ওদের দুজনকে ডেকে তুলে চারজনে চুপিচুপি কেটে পড়ি।
কোথায় কেটে পড়বি?
কেন সিবিচে? সূর্যোদয় দেখে এসে ওদের তাক লাগিয়ে দেবো। তখন সবাই ঘুমিয়ে থাকার জন্য আফসোস করবে।
কিসলু আর পলাশকে ডেকে তুলে পরিকল্পনা জানাল ওরা। ওদের উৎসাহ আরো বেশি। পলাশ বলল, এক কাজ করি। টাকা পয়সা নিয়েই বের হই। রুমে থাকলে হারাতে পারে। আর সূর্যোদয় দেখে আমরা নাস্তা করে নিজেদের মতো ঘুরবো। টুটুল ভাইয়ের শিক্ষা হবে।
জ্যাকেট ট্যাকেট চাপিয়ে যার যার নিজস্ব টুকিটাকি জিনিস, টাকা পয়সা নিয়ে ওরা বেরিয়ে পড়ল। আগত পর্যটকদের অনেকেই সূর্যোদয় দেখার জন্য বেরিয়ে পড়েছে। পথ চিনতে ওদের কোন অসুবিধে হলো না। হেঁটে চলা এক দলের সাথে ভিড়ে গেল। বাচ্চা কাচ্চাওয়ালা মহিলারা তিনচাকার ভ্যানগাড়িতে চড়েছে।
সূর্যোদয় দেখার জন্য সিবিচে এই সাত সকালেও লোকে লোকারণ্য। যেন হোটেলের সব লোক চলে এসেছে। শুধু টুটুল ভাইয়ের দল বাদে। সবাই হা করে তাকিয়ে আছে সমুদ্রের পানে। কিছুই দেখা যায় না। পানি যেন ধোঁয়া ধোঁয়া। কুয়াশায় ঢেকে আছে আকাশ। অন্ধকার কেটে সকালের আলো ফুটতে শুরু করেছে। সূর্যের কোন হদিস নেই। পূর্ব দিগন্তের কুয়াশার চাদর ফ্যাকাশে লাল থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। সাগরের পানি ফুঁড়ে সূর্য উঠছে না।
চলবে…