Published : 11 Jun 2025, 02:55 PM
শিশু শাসনের ব্যাপারে প্রজন্মের পার্থক্য নতুন কিছু নয়। বর্তমানের অনেক মা-বাবা যখন সন্তানকে আবেগ বোঝাতে সময় দেন, তখন হয়ত তাদের মা-বাবা বলেন, ‘আমাদের সময়ে প্রশ্ন করলে শাস্তি হত, না বললে বকা খেতে হত।’
তবে সময় বদলেছে, বদলেছে অভিভাবকত্বের ধরনও। এক সময়কার ‘চুপ করে থাক’, ‘আর একবার কাঁদলে দেখ!’- এসব নিয়মের পরিবর্তে এসেছে ‘জেন্টল প্যারেন্টিং’।
অনেকে এটাকে ‘নরম’ বা ‘অতিরিক্ত আদর’ হিসেবে ভুল ব্যাখ্যা করেন। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন— এটা ভুল বোঝাবুঝি।
জেন্টল প্যারেন্টিং আসলে কী?
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক মনোবিজ্ঞানি ডা. ব্রায়ান রাজ্জিনো সিএনএন ডটকম-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলছেন, “জেন্টল প্যারেন্টিং’ মানে ‘কোলে পুষে রাখা’ নয়, বরং এটি সন্তানকে প্রাপ্তবয়স্ক জীবনের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা শেখানোর একটি কৌশল।”
তিনি বলেন, “এতে অভিভাবকরা সহানুভূতির সঙ্গে সন্তানের আবেগ বোঝার চেষ্টা করেন এবং একই সঙ্গে সুস্পষ্ট সীমারেখা বজায় রাখেন।”
২০২৩ সালের ‘পিউ রিসার্চ সেন্টার’-এর এক জরিপে প্রায় অর্ধেক মার্কিন অভিভাবক জানিয়েছেন, তারা তাদের সন্তানদের আগের প্রজন্মের চেয়ে ভিন্নভাবে বড় করছেন। বেশি ভালোবাসা, খোলামেলা কথোপকথন, কম চিৎকার—এসব এখনকার প্রাধান্য।
চারটি প্রধান ‘প্যারেন্টিং স্টাইল’
আধুনিক মনোবিজ্ঞান চার ধরনের অভিভাবকত্ব চিহ্নিত করেছে।
নেগলেক্টফুল (উদাসীন) ভালোবাসা বা শাসন কোনোটিই নেই।
অথোরিটেরিয়ান (কঠোর শাসক) ‘আমি বলেছি, তাই হবে’ ঘরানার শাসন।
পারমিসিভ (নির্ভার) ভালোবাসা আছে, কিন্তু কোনো নিয়ম নেই।
অথোরিটেটিভ (সহানুভূতিশীল কিন্তু শৃঙ্খলাপরায়ণ) ভালোবাসা ও শৃঙ্খলার ভারসাম্য বজায় রাখা।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক পেশাদার কাউন্সেলর নিকোল জনসন সিএনএন ডটকমকে বলেন, “অথোরিটেটিভ অভিভাবকরা সন্তানের অনুভূতিকে গুরুত্ব দেন, একই সঙ্গে সীমারেখা পরিষ্কারভাবে স্থাপন করেন।”
ডা. রাজ্জিনোর মতে, “জেন্টল প্যারেন্টিং’ মূলত এই অথোরিটেটিভ ঘরানারই আধুনিক উপস্থাপন, যার লক্ষ্য সন্তানকে আবেগ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করা এবং সীমা অতিক্রম করলে যুক্তিসংগত পরিণতি দেওয়া।”
সোশ্যাল মিডিয়ার প্রভাব ও গবেষণা ফলাফল
২০২৪ সালের এক গবেষণায় মিনেসোটা’তে ‘ম্যাকালেস্টার কলেজ’য়ের অতিথি সহযোগী অধ্যাপক অ্যানি পেজাল্লা ও অ্যালিস ডেভিডসন অনুসন্ধান করেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ‘জেন্টল প্যারেন্টিং’ নিয়ে কী বোঝানো হচ্ছে।
পেজাল্লা বলেন, “এসব অভিভাবকরা আবেগ নিয়ন্ত্রণকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেন। শান্ত থাকা, সন্তানের আবেগ বোঝা এবং সীমা বজায় রাখা তাদের উদ্দেশ্য।”
তবে গবেষণায় দেখা গেছে, অনেকে যেভাবে ‘জেন্টল প্যারেন্টিং’ বাস্তবায়ন করছেন, তা পারমিসিভ বা নির্ভার অভিভাবকত্বের মতোও হয়ে যেতে পারে।
ব্যবহারিক দৃষ্টান্ত
ধরা যাক, একটি শিশু খাবার ছুড়ে ফেলছে। ‘পারমিসিভ’ অভিভাবক হয়ত শুধু বলবেন ‘করো না’, কিন্তু কিছু করবেন না।
‘অথোরিটেরিয়ান’ অভিভাবক হয়তো চিৎকার করে শিশুকে ‘টাইম-আউট’ দেবেন।
তবে ‘অথোরিটেটিভ’ বা ‘জেন্টল’ অভিভাবক বলবেন, ‘তুমি হয়ত খেলতে চাইছো, কিন্তু খাবার প্লেটেই থাকতে হবে। আবার ছুড়লে আমি প্লেট সরিয়ে নেব।’
এতে শিশুর আবেগকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়, আবার যুক্তিসংগত সীমারেখাও রাখা হয়।
ডা. রাজ্জিনো বলেন, “যুক্তিসংগত পরিণতি মানে এমন শাস্তি, যা আচরণের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। যেমন- তুমি বন্ধুকে আঘাত করলে, খেলাধুলা বন্ধ হবে।”
জেন্টল প্যারেন্টিং কি শিশুদের জন্য খুব নরম?
অনেকে মনে করেন, শিশুদের এমনভাবে বড় করলে তারা কঠিন বাস্তবতায় টিকতে পারবে না। তবে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘এই পদ্ধতির মূল উদ্দেশ্য শিশুকে দায়িত্বশীল করে তোলা।’
জনসন বলেন, “এটা কোনোভাবেই শাস্তি এড়ানো নয়; বরং সন্তানের আবেগ ও আচরণ নিয়ন্ত্রণের উপায় শেখানো।”
এই ধরনের প্যারেন্টিং শিশুর মানসিক স্বাস্থ্য, আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
যেমন, ২০২২ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, ‘অথোরিটেটিভ প্যারেন্টিং’ অনুসরণকারী শিশুদের প্রাতিষ্ঠানিক সফলতা তুলনামূলকভাবে বেশি।
২০২০ সালের আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, এই ঘরানার অভাব শিশুদের জীবনের অসন্তোষের অন্যতম কারণ।
অভিভাবকদের জন্য চ্যালেঞ্জ
তবে এ ধরনের ‘প্যারেন্টিং’ করা কঠিন। বিশেষ করে যদি কোনো অভিভাবক নিজের ছোটবেলায় ভালোবাসা বা সহানুভূতি না পেয়ে থাকেন, তাহলে এখন নিজের আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং শিশুকে বুঝে চলা এটা অত্যন্ত কঠিন।
পেজাল্লা বলেন, “অনেক অভিভাবক চেষ্টা করছেন সপ্তাহের সাতদিন, চব্বিশ ঘণ্টা আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে। ফলে তারা মানসিকভাবে ক্লান্ত হয়ে পড়ছেন।”
অনেক ‘সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার’ ‘না’ বলাও নিষিদ্ধ করে ফেলেছেন। আবার সুপারমার্কেটে সন্তান মাটিতে গড়াগড়ি করলে জড়িয়ে ধরার পরামর্শ দিচ্ছেন। এই অতিরিক্ত চাপে অনেক অভিভাবক নিজেকে ব্যর্থ ভাবেন।
তবে পেজাল্লা মনে করিয়ে দেন, চারটি জিনিস থাকলেই সন্তানের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঠিকভাবে হয়।
১. কাঠামো বা নিয়ম
২. উষ্ণতা বা ভালোবাসা
৩. শিশুকে স্বতন্ত্র ব্যক্তি হিসেবে দেখা
৪. ধৈর্য্য ধরে দীর্ঘমেয়াদে শিশু গড়ার মানসিকতা।
মানবিক হোন, নিখুঁত না হোন
সবচেয়ে বড় কথা- ডা. জনসনের মতে, সন্তান নিখুঁত মা-বাবা চায় না, চায় এমন একজন বড়কে যিনি চেষ্টা করেন, ভুল করলে ক্ষমা চান, এবং সহানুভূতিশীল নেতৃত্ব দেন।
সন্তান তখনই শেখে কীভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে হয়, সীমা মানতে হয় এবং জীবনের কঠিন বাস্তবতা মোকাবিলা করতে হয়, যখন তারা দেখে বড়রাও শেখার চেষ্টা করছে।
আরও পড়ুন
সন্তানের ফোনের ব্যবহার কমাবেন যেভাবে