Published : 27 May 2025, 04:48 PM
ঈদের সাজে যখন ঐতিহ্য ও সময়ের ধারার মেলবন্ধনের কথা আসে, তখন আদিবাসী গয়না হয়ে ওঠে ব্যক্তিত্বের অনন্য প্রকাশ।
ঈদের ফ্যাশনের নতুন ধারায় প্রাচীন ঐতিহ্য— ‘ট্রাইবাল গয়না’ একটু ভিন্নভাবেই উপস্থাপন হচ্ছে। অর্থাৎ এ ধরনের গয়নার নকশায় এখন দেখা মিলছে আধুনিকতার উন্মেষ।
ফলে বহু শতাব্দীর সংস্কৃতি ও আদিবাসী জীবনের চিহ্ন বহনকারী এই গয়নাগুলো শহুরে ফ্যাশনে বিশেষ স্থান করে নিচ্ছে আনায়াসেই।
ট্রাইবাল গয়নার ইতিহাসের শেকড় গাঁথা পৃথিবীর বিভিন্ন আদিবাসী সংস্কৃতিতে। বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড, নেপাল, আফ্রিকা কিংবা লাতিন আমেরিকার আদিবাসী জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে গয়না ছিল শুধু সাজ নয়, ছিল আত্মপরিচয়ের প্রতীক।
কারও ধর্মীয় আচার, কারও পারিবারিক মর্যাদা, কারও দৈনন্দিন জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছিল এই গয়নাগুলোতে।
বাংলাদেশে পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, মুরং-সহ অনেক জাতিগোষ্ঠীর নারী ও পুরুষদের পরিধেয় গয়না যুগ যুগ ধরে আভিজাত্য ও নিপুণ কারুশিল্পের নিদর্শন।
ঐতিহ্য আর শিকড়ের টান থেকেই ট্রাইবাল গয়না ধীরে ধীরে উঠে এসেছে আধুনিক ফ্যাশনের কেন্দ্রবিন্দুতে। প্রায় গত এক দশক ধরে আন্তর্জাতিক ফ্যাশন হাউজ থেকে শুরু করে দেশীয় ডিজাইনারদের হাত ধরে ট্রাইবাল গয়না পৌঁছে গেছে বিভিন্ন ফ্যাশন র্যাম্প থেকে ঈদের বাজার পর্যন্ত।
বিশেষ করে গত চার-পাঁচ বছর ধরে তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই ধরনের গয়নার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে অনেকটাই।
‘ট্রাইবাল ক্রাফটস’ এমনই একটি উদ্যোগ যারা বেশ কয়েক বছর ধরেই ট্রাইবাল গয়নার জগতে বেশ পরিচিত নাম।
বর্তমানে এই উদ্যোগটির প্রধান হিসেবে আছেন কুঁড়ি চিসিম।
তিনি বলেন, "উদ্যোগটি মূলত ১৯৯৯ সালে প্রথম শুরু করেন আমার মা মিলন চিসিম। আদিবাসী গয়না, পোশাক যেন দেশের সব স্থানেই এবং সবাই মাঝেই উদযাপন হয়, শুধুমাত্র পাহাড়েই সীমাবদ্ধ না থাকে সেই চিন্তা থেকেই মা উদ্যোগটি নিয়েছিলেন।”
“আমরা যেহেতু বাংলাদেশরই অংশ তাই আমি উদ্যোগটি ধরে রেখেছি। এখন অনলাইন মাধ্যমে অনেকের কাছেই সহজে ভিন্নধর্মী আদিবাসী গয়না পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে। যদিও শুরুতে বনানীতে একটি শোরুমের মাধ্যমে যাত্রা চালু হয়েছিল”- বলেন কুঁড়ি।
‘ট্রাইবাল ক্রাফটস’য়ে রয়েছে নারী, পুরুষ ও ‘ইউনিসেক্স’ গয়নার সমারোহ।
‘ইউনিসেক্স’ বলতে মূলত এমন নকশাকে বোঝানো হয় যা নারী এবং পুরুষ সবাই ব্যবহার করতে পারবেন। ট্রাইবাল ক্রাফটেও কিছু গয়না এমনভাবে নকশা করা হয়েছে যা অনায়াসেই নারী, পুরুষ সকলের জন্যই প্রযোজ্য।
এক সময়ে আদিবাসী গয়নায় শুদ্ধ রূপা, হাতির দাঁত, ফুল, গাছের বিভিন্ন অংশ ব্যবহার হতে। তবে এর বদলে এখন রূপার মিশ্রণ, পিতল, কাঠ, মেটাল, বিডস, পুঁতি, মাটিসহ বিভিন্ন উপাদানের গয়না রাখা হয়।
গয়নার মধ্যে রয়েছে দুল, আংটি, চোকার, নেকপিস, ব্রেসলেট, কাঁকন, কোমড়বন্ধন-সহ অনেক ধরনের আদিবাসী ঐতিহ্যের আমেজ মেশানো গয়না।
সাধারণত ট্রাইবাল গয়নার ধরন ও উপাদান মূলত তৈরি হয় স্থানীয়ভাবে সংগ্রহযোগ্য উপকরণ দিয়ে। যেমন- কাঠ, নারিকেলের খোল, বীজ, শাঁস, মাটি, কাঁসা, পিতল, কাপড়, চামড়া, পাথর কিংবা রূপা।
গয়নার গড়নে দেখা যায় মূর্তি, জীবজন্তু, প্রকৃতির মোটিফ, এমনকি আদিবাসী প্রতীকী নকশা।
এই গয়নাগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে বড় আকৃতির দুল, হাতের চোরা, চোকার নেকলেস, কোমরবন্ধ, নোজপিন (নাকফুল) এবং মাথার গয়না।
রংয়ের বৈচিত্র্য ও নকশার রীতিবেশির ভাগ ট্রাইবাল গয়নায় থাকে জমকালো রংয়ের ছোঁয়া। লাল, কালো, সবুজ, হলুদ, কমলা ইত্যাদির মতো গাঢ় ও উজ্জ্বল রংয়ের সংমিশ্রণ খুঁজে পাওয়া যায় ঐতিহ্যবাহী গয়নায়।
যদিও এখন আবার অনেকেই ‘মিনিমাল’ বা অল্প নকশা ও রং গুরুত্ব দেন। যার অন্যতম কারণ ‘মিনিমাল’ নকশা ও রংয়ের মাধ্যমে ট্রাইবাল ঐতিহ্যের সঙ্গে আধুনিকতার সামঞ্জস্য রাখা সম্ভব।
এছাড়া সহজ পোশাকের সঙ্গেও এই গয়নাগুলো পরলে ব্যক্তিত্বে আসে এক ধরনের দৃষ্টিনন্দন ভারসাম্য।
ঈদের সাজে ট্রাইবাল গয়নার ব্যবহার ঈদের দিন সকালে হালকা মসলিন, জামদানী, খাদি, মরিপুরী, সুতি সালোয়ার-কামিজ বা শাড়ির সঙ্গে পরা যায় রঙিন ট্রাইবাল দুল ও চোকার।
বিকেলে যদি লম্বা গাউন বা কুর্তি পরা হয়, সঙ্গে মানানসই ট্রাইবাল নেকপিস, ব্রেসলেট ও ছোট বা আঙুল জোড়া আংটি পরলে তৈরি হবে ‘বোহেমিয়ান ফিউশন লুক’।
পুরুষরাও চাইলে পাথরের মালা, চামড়ার ব্রেসলেট বা কাঠের চেইন দিয়ে তাদের ঈদের সাজে আনতে পারেন স্বতন্ত্রভাব।
‘ট্রাইবাল ক্রাফটস’-এ যেমন পাওয়া যায় কাঠের দুল ও রিং, হ্যান্ডপেইন্টেড ব্রেসলেট যা ছেলেমেয়ে দুইয়ের জন্য উপযুক্ত।
ঐতিহ্যবাহী ট্রাইবাল গয়না ও আধুনিক
ফিউশন পাহাড়িদের মধ্যে প্রচলিত রয়েছে যেসব গয়না, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হাজাপাত (গলার হার), নাখামা (নাকের অলঙ্কার), চামপা (চুলের গয়না), বান্দা (হাতের বালা), পাক্কাল (কোমরের চেইন), কাংখু (কানের দুল), রাদাং (মাথার পট্টি), তাংনাই (বাহুর গয়না), মুঝু (আঙুলের আংটি) এবং বেলখু (পায়ের নূপুর)।
হাজাপাত মূলত গলার হার যা সাধারণত পিতল, রুপা অথবা রঙিন পুঁতির মাধ্যমে তৈরি হয়। অনেক সময় একাধিক স্তরের পুঁতি দিয়ে লম্বা মালাও তৈরি করা হয়, যার কেন্দ্রস্থলে ঝুলানো থাকে বিশাল এক পাথরের টুকরা বা ধাতব লকেট।
নাখামা সাধারণত বৃত্তাকারে তৈরি হয় এবং নাকে ছিদ্র করে পরা হয়। কারও কারও নাখামায় ঝুলন্ত ছোট ঘুঙরু বা পুঁতির ব্যবহারও দেখা যায়।
চামপা চুলের বিশেষ গয়না হিসেবে ব্যবহৃত হয় যা মূলত রূপা বা ধাতব পাত দিয়ে তৈরি করা হয়। এটি চুলের খোঁপায় আটকিয়ে রাখা হয় এবং পেছন থেকে এক ধরনের রাজকীয় সৌন্দর্য দেয়।
হাতের মোটা বালা বা ব্রেসলেট বান্দা কখনও পিতলের মোটা ফিতার মতো আবার কখনও পুঁতির সাজে তৈরি হয়।
কিছু বান্দা জোড়া হাতে পরে এক ধরনের ভারি অথচ দৃষ্টিনন্দন আবহ তৈরি করে।
আবার কোমরের চেইনের মতো পাক্কাল নামের গয়না সাধারণত নাচ-গানের সময় বা উৎসবেই বেশি পরা হয়। পুঁতি, ধাতব ঝুমকা ও ছোট ঘণ্টার শব্দ মিলিয়ে পাক্কাল এক ধরনের ছন্দ তৈরি করে।
এই গয়নাগুলোকেই এখন আধুনিক ফ্যাশনে রূপান্তর করে বানানো হচ্ছে হালকা ধাতুর গয়না। হাজাপাতের অনুপ্রেরণায় এখন তৈরি হচ্ছে রূপালি বা পিতলের পাতলা চোকার। এগুলোতে আদিবাসী মোটিফ বা পশুপাখি, পাতার নকশা ফুটিয়ে তোলা হয় খোদাইয়ের মাধ্যমে।
আবার জিওমেট্রিক জ্যামিতিক নকশার ‘নেকপিস’ বা কণ্ঠহার পাহাড়িদের গলার গয়নাগুলোর প্যাটার্ন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তৈরি হয়।
ত্রিভুজ, গোলাকৃতি বা আয়তাকার কাঠামোয় রঙিন পুঁতি বা ধাতব প্যাঁচ থাকে। বান্দা’র সহজ ও নান্দনিক রূপ এখন দেখা যায় রংবেরংয়ের পুঁতির ব্রেসলেট বা হাতের মালায়। এগুলো হালকা, রঙিন এবং যে কোনো পোশাকের সঙ্গেই মানানসই।
নাখামা বা চামপা গয়নার নকশা অবলম্বনে তৈরি বোহেমিয়ান স্টাইলের ঝুলন্ত দুল যেখানে রঙিন পুঁতি, ছোট ঘণ্টা, চামড়া ও কাঠের উপাদান একত্রে ব্যবহৃত হয়।
নকশাকররা আদিবাসী মোটিফগুলোকে ধরে রেখে রূপা বা পিতলের ওপর হালকা ‘মেটালিক ফিনিশ’ দিয়ে এক নতুন মাত্রা যোগ করেন।
ট্রাইবাল গয়না শুধু যে গয়না তা কিন্তু নয় বরং প্রতিটি গয়নাই একটি গল্প। একটি জাতিসত্তার, একটি শিল্পের, একাধিক সংস্কৃতির মিলনের গল্প পাওয়া যায় এই গয়নাগুলোতে।
তাই ঈদের সাজে একটি ট্রাইবাল চোকার, একটি কাঠের আংটি বা রঙিন দুলে নিজেকে রাঙালে শুধু সাজাই হবে না বরং বহন করা হবে ঐতিহ্য আর ফ্যাশনের এক অসাধারণ সংমিশ্রণ।
আরও পড়ুন