Published : 19 Oct 2010, 10:25 PM
ঢাকা শহরে যাদের নিজস্ব বাহন নেই, কিন্তু তা সত্ত্বেও মাটি কামড়ে পড়ে আছে তাদের মতো হতভাগ্য, অসহায় প্রাণী আর হয় না। নিত্য দিনের বাইরে যাবার ঝক্কি সে তো আছেই, যদি দ্রুত কোথাও যেতে হয় বা চিকিৎসার জন্য রুগী আনা নেওয়া করতে হয় তাহলে ভোগান্তি চরম আকার ধারণ করে। অটো রিক্সা ট্যাক্সি ক্যাবের চালকের সঙ্গে কথা বলার আগেই আমার বুক কাঁপতে থাকে। আমার বাবা এবং সন্তান দু'জনই গুরুতর অসুস্থ, ডাক্তার বা হাসপাতালে নেবার জন্য কখনও কখনও রাস্তার মোড়ে ঘন্টা ধরে দৌড়া দৌড়ি করেও কোন ক্যাব বা অটো রিক্সা যোগাড় করতে পারি না।
অগত্যা উচ্চ ভাড়ায় রিক্সায় যেতে হয়। যদিওবা কখনো দয়া করে ট্যাক্সি চালক সদয় সম্মতি জ্ঞাপন করে, এর জন্য যে ভাড়া দাবী করা হয় তার সঙ্গে সরকারী বিধি বা মিটারের কোন সম্পর্ক নেই। নগরবাসী শেষ কবে মিটারে অটো ট্যাক্সিতে চড়েছেন, তা কারও মনে থাকবার কথা নয়। তথাকথিত নিরাপত্তার নামে অটো রিক্সকে যে গৃহপালিত প্রাণী পোষার খাঁচায় পরিণত করা হলো তাতেও আমরা কিছু মনে করিনি। মনে বড় চোট লাগে, প্রয়োজনে যখন এই খাঁচাও দুর্লভ হয়ে যায়। বাংলাদেশের রাজধানী ব্যতীত এই খাঁচা-বাহন, বিশ্বের দ্বিতীয় কোন রাজধানীতে থাকা সম্ভব নয়। টিকেটের গাড়ী বা লোকাল বাসে উঠবেন? গুণগত পার্থক্য নেই, আর্থিক দন্ড ছাড়া।
এই অসহায়, নিরীহ প্রাণীগুলো এত দিন সদাশয় সরকারের প্রতি দু'হাত বাড়িয়ে দাড়িয়ে ছিল। গণ পরিবহনের উন্নয়নে গণতান্ত্রিক সরকার আলবৎ নানামুখি উদ্যোগ নেবেন। শিশু, নারী ও বয়স্ক লোকজন কত কষ্ট করে যাতায়াত করেন তা সত্যি পীড়াদায়ক। গণ পরিবহনের কোথাও কোন শৃঙ্খলা নিয়ম চোখে পড়ে না। লক্ষ লক্ষ নাগরিকের যাতাযাতের এই পরিবহন সেক্টর দেখভালের কেউ নেই। একজন অটো ট্যাক্সি চালক বা বাসের হেলপারের কাছে আমরা জিম্মি হয়ে আছি। সামান্য বিষয় নিয়ে বসচা, হাতাহাতি কখনও কখনও রক্তারক্তি কাণ্ড ঘটে যাচ্ছে।
গণ পরিবহনের বাকবিতন্ডার একটা বড় জায়গা জুড়ে আছে ভাড়ার হার। কোন দিন এই ভাড়ার হার ঠিক ছিল না। আর কোন দিন ঠিক হবে বলেও মনে হয় না। লোকাল বাসের ভাড়ার সঙ্গে দুরত্ব ও সরকার নির্ধারিত হারের সঙ্গে কোন সঙ্গতি নেই। সম্পূর্ণ কন্ডাকটরের খাম খেয়ালীর ওপর নির্ভর করে একজন যাত্রীকে কত ভাড়া দিতে হবে। প্রথমে তুমি, তারপর তুই, এরপর চৌদ্দ গোষ্ঠী সুদ্ধ গালাগাল-এই রকম পরিস্থিতিতে কোন ভদ্রলোকের পক্ষে বাসে অবস্থান করা অসম্ভব। পুরুষ যাত্রীরা ধাক্কাধাক্কি ঠেলাগুতা দিয়ে বাসে উঠতে পারলেও, মহিরারা জানেন, লোকাল টিকেটের বাসে ওঠা তাদের জন্য এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা।
বাসের হেলপার, চালক একযোগে বলবে মহিলাযাত্রীদের বাসে নেবে না। অজুহাত মহিলা সিট খালি নেই। সিট খালি না থাকলে কী পুরুষ যাত্রী নিচ্ছে না? নারী পুরুষ সবারই নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছানোর তাড়া থাকে। তাই বাঁধা উপেক্ষা করে নারীকেও জায়গা করে নিতে হয় বাসে। মজার ব্যাপার হলো যে সব পুরুষ যাত্রী নারীদের বাসে ওঠার বিরোধী। আবার তারাই মহিলা সহযাত্রীর কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকতে পছন্দ করেন। এতে করে বাসে ওঠার মুখে একটা জটলা পাকিয়ে যায্ আর সুন্দরী রমনী যদি দাঁড়িয়ে থাকেন তাহলে সে জটলা ক্রমে বৃদ্ধি পাবে। কোন কোন পুরুষ যাত্রী, তার গন্তব্যস্থলে নামতে ভুলে যান।
সরকার আসে, সরকার যায় কিন্তু গণ পরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে কার্যকর কোন উদ্যোগ, পরিকল্পনা দেখা যায় না। অটো রিক্সা, ট্যাক্সি ক্যাব তো এক প্রকার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। সীমাহীন ধৈর্য্য নিয়ে একের পর এক চালককে বিনীত ভঙ্গিতে অনুরোধ করতে হবে গন্তব্যে যাবার জন্য। কিন্তু মিটারে না যাওয়া এবং যাত্রীর ইচ্ছামতো গন্তব্যে বেশীর ভাগ চালকই যেতে চান না। আমরাই বাধ্য হয়ে বলি, ভাই ভাড়া বাড়িয়ে দেব, জরুরী প্রয়োজন তবুও নিয়ে চলেন। ধারে কাছেই ট্রাফিক পুলিশ, সার্জেন্ট থাকলেও তারা বিধাতার ন্যায় নির্বিকার হয়ে থাকেন। ১৯৯৮ সালের প্রণীত ট্যাক্সিক্যাব নীতিমালা বহাল আছে। কার্যকারিতা কিছুমাত্র আছে কি না জানি না। আমাদের দাবী দুটি, প্রথমত: মিটারের অতিরিক্ত ১ টাকাও ভাড়া দাবী করা যাবে না। প্রয়োজনে সরকারীভাবে মিটারের হার বাড়ানো যেতে পারে। দ্বিতীয়, চালকের পছন্দমত নয়, যাত্রীর প্রয়োজন অনুযায়ী কাছে দুরে যে কোন দূরত্বে অটো ট্যাক্সি যেতে বাধ্য থাকবে।
বর্তমান সরকার গণ পরিবহনে কোন বাড়তি সুবিধা যোগ করতে না পারলেও ভোগান্তি আর দুর্ভোগ বাড়িয়েছে কয়েক গুণ। ভাগ্যবান সুবিধাভোগী গাড়ীওয়ালারাও রেহাই পায়নি। সিএনজি স্টেশন বন্ধের সিদ্ধান্ত সবার জন্যই বড় রকমের ভোগান্তির কারণ হয়ে দাড়িয়েছে। সিএনজি স্টেসন বন্ধের সিদ্ধান্তে বিদ্যুৎ বা গ্যাস পরিস্থিতির কতটুকু উন্নতি হয়েছে বলা মুস্কিল। তবে এই সিদ্ধান্ত সাধারণ জনগণের প্রাত্যহিক জীবনে বিড়ম্বনা, ও ভোগান্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। কারণ সিএনজি স্টেশন বন্ধ থাকার মাশুল দিতে হয় আমাদের মত তৃতীয় সম্পদ্রায়ের (থার্ড এস্টেট) নাগরিকদের। এর আগে ট্যাক্সি ভাড়া যেখানে ছিল ১০০ টাকা এখন দিতে হচ্ছে ১৪০-১৫০ টাকা, কখনো কখনো ২০০ টাকা। আর গাড়ীর মালিক মাত্রই জানেন ৫-৬ ঘন্টার কমে গাড়ীতে গ্যাস নিতে পারেন না। এভাবে চলা সম্ভব? সরকারের দায়িত্ব সহায়ক শক্তি হিসেবে ভূমিকা পালন করা। ভাবতে অবাক লাগে যে, সরকারই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে। ক'দিন আগে চিকিৎসার প্রয়োজনে ভারতের চেন্নাই ভেলর ও কোলকাতায় গিয়েছিলাম। এই শহরগুলোর ট্রাফিক ব্যবস্থাও ঢাকার তুলনায় বহু উন্নত। হায় ঈশ্বর! আমরা কী ঢাকায় সাধারণ জনগণের উপযোগী গণ পরিবহন ব্যবস্থা দেখে যেতে পারবো?