Published : 16 Jun 2025, 05:16 PM
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য ক্যান্সারের মতো হলো ব্যাংকখাতের খেলাপি ঋণ। এ নিয়ে যতটা খেলামেলা আলোচনা হয়েছে, অন্য কোনো ইস্যুতে ততটা হয়নি বলে মনে হয়। কমবেশি সব সরকারের আমলেই খেলাপি ঋণ ছিল। ব্যবসায়িক কার্যক্রমে এই ঋণ স্বাভাবিক। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এক শ্রেণির ব্যবসায়ী নামধারী আত্মসাৎকারী গড়ে উঠেছিল, যাদের উদ্দেশ্য ছিল ব্যাংক থেকে ঋণের নামে টাকা বের করে নেওয়া। তারা এই কাজটি করেছে সরকারের মৌন সমর্থন ও রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়।
ফলে বিগত সরকারের ১৫ বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ১৯ গুণ। এই টাকা দেশে কাজে লাগলে অর্থনীতি উপকৃত হতো। কিন্তু বেশিরভাগই বিদেশে পাচার হয়েছে। সম্প্রতি এর কিছু প্রমাণ আমরা দেখছি। খেলাপি টাকা ফেরত না আসায় ব্যাংকগুলো থেকে বেরিয়ে যাওয়া অর্থের শূন্যস্থান পূরণ হচ্ছিল না। ফলে অনেক ব্যাংক নগদ টাকার তীব্র সংকটে পড়ে। এমন অবস্থা হয়েছে যে, ১০ হাজার টাকা তুলতে এসে গ্রাহককে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে।
ব্যাংক খাতকে বলা হয় একটি দেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। অথচ এই খাত খেলাপি ঋণের মতো ক্যান্সারে আক্রান্ত। ফলে অনেক ব্যাংক দেউলিয়া হওয়ার দশায় পৌঁছেছে। যদিও অন্তর্বর্তী সরকার ওই পথে হাঁটবে না, কারণ দেউলিয়া ঘোষণা করলে যে আতঙ্ক তৈরি হবে, তা সামলানো প্রায় অসম্ভব। তাই দুর্বল ব্যাংকগুলোকে একীভূত করার উদ্যোগের কথা বলছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর।
যারা এই ক্যান্সারের জন্য দায়ী, তারা বিগত সরকারের সময় কোনো শাস্তি পায়নি। বরং তাদের নানাভাবে ছাড় দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদেশ ভ্রমণ থেকে শুরু করে ব্যাংকের পরিচালক বা চেয়ারম্যান হয়েছেন তারা। কেউ কেউ রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংকের লাইসেন্সও পেয়েছেন। বারবার ঋণ পুনঃতফসিল বা মাত্র ২ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিয়ে খেলাপির তালিকা থেকে নাম কাটিয়ে কেউ কেউ এমপি, মন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাও হয়েছেন। এসব অনিয়ম কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অগোচরে হয়নি।
বরং এগুলো যাতে বাইরে প্রকাশ না পায়, সেজন্য সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছিলেন তৎকালীন গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। সরকার পরিবর্তনের পর তিনিই সম্ভবত বিশ্বের ইতিহাসে একমাত্র পলাতক গভর্নর। খেলাপি ঋণ লুকিয়েও রাখা হতো। এ কারণে আইএমএফ যখন খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৪ লাখ কোটি টাকার কথা বলেছিল, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেখাত ২ লাখ কোটি টাকার কিছু বেশি।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রকৃত চিত্র বের হতে শুরু করেছে। চলতি বছরের মার্চে খেলাপি ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ২০ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা, যা মোট বিতরণ করা ঋণের ২৪.১৩ শতাংশ। আগে এটি ১০ শতাংশের কাছাকাছি দেখানো হতো। খেলাপি ঋণের মধ্যে ৩ লাখ ৪২ হাজার ৬৪ কোটি টাকা বা ৮১.৩৮ শতাংশ মন্দ ঋণ। সরকারি ব্যাংকগুলোতে এই মন্দ ঋণের হার ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ, সরকারি ব্যাংকে ১০০ টাকা খেলাপি হলে তার ৯০ টাকাই মন্দ। সব ব্যাংক মিলিয়ে এর পরিমাণ ৮১ টাকার ওপর।
যখন ঋণ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে, তখন তাকে মন্দ ঋণ শ্রেণিতে ফেলা হয়। এ ধরনের ঋণ উদ্ধারে ব্যাংকগুলোকে আইনি প্রক্রিয়ায় ছুটতে হয়। এই প্রক্রিয়া কতটা দীর্ঘ, তা আমরা কমবেশি জানি। ব্যবসায় উত্থান-পতন থাকবে, তাতে খেলাপি হওয়া স্বাভাবিক। ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে ঋণ পুনঃতফসিল করে তা নিষ্পত্তি হতে পারে। কিন্তু খেলাপির প্রায় পুরোটাই মন্দ ঋণ হওয়া বুঝিয়ে দেয়, এক শ্রেণির অসাধু ব্যক্তি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ব্যবসার নামে ঋণ নিয়ে ব্যাংক লুটপাট করে অর্থনীতিকে পঙ্গু করেছে।
এসব ঋণের বিপরীতে যে জামানত রাখা হতো, তাও ছিল ভুয়া। এমনও দেখা গেছে, টিনের চালার ঘরের বিপরীতে হাজার কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দিয়েছে ব্যাংক। আবার, কোনো জামানত ছাড়াই বা নীতিমালা না মেনে ঋণ দেওয়া হয়েছে। এমন অনিয়ম বিশ্বের অন্য কোথাও সম্ভব নয় বলে গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেছিলেন।
তার এই আক্ষেপ জনগণকে উৎসাহিত করেছিল যে, এবার অন্তত ব্যাংক লুটপাটে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত মামলা করা হবে। কিন্তু এসব ঋণ এমনি বের হয়নি। এর পেছনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তা, স্ব স্ব ব্যাংকের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ও পরিচালনা পর্ষদের সদস্যরাও সমান দায়ী। তাদের বিরুদ্ধে এখনো কোনো উল্লেখযোগ্য ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
পাচার হওয়া টাকা ফেরাতে গভর্নরের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। আগের সরকারের সময় কার্পেটের নিচে লুকিয়ে রাখা ঋণ বের করতেও তিনি তৎপর। কিন্তু তা আদায়ে লক্ষণীয় উদ্যোগ কেন নেই, তা বোধগম্য নয়। আসছে অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও এ বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। আমরা আশা করেছিলাম, জ্বালানি সমস্যা সমাধানে অর্থ উপদেষ্টা যেমন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার কথা বলেছেন, খেলাপি ঋণ আদায়েও তেমন কোনো পথনকশা থাকবে।
মামলার কারণে আটকে থাকা বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ উদ্ধারে চলমান মামলা নিষ্পত্তি বা নতুন মামলা দায়েরের জন্য আদালত, বিচারক ও সরকারি আইনজীবী নিয়োগের বিষয়টি বাজেটে থাকতে পারত। বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির আলোচনাও আসতে পারত। কিন্তু তা হয়নি। বাজেটে শুধু খেলাপি ঋণের প্রকৃত পরিমাণ বের করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
তবে, গত মার্চে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করে বলেছে, ইচ্ছাকৃত খেলাপিরা বিদেশ যেতে পারবেন না। তাদের নামে ট্রেড লাইসেন্স ইস্যুতেও নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, তারা কোনো রাষ্ট্রীয় পুরস্কার বা সম্মাননার যোগ্য হবেন না। গাড়ি, জমি, বাড়ি, ফ্ল্যাট নিবন্ধনেও বাধার মুখে পড়বেন। কার্যত খেলাপি ঋণ আদায় হচ্ছে না বললেই চলে। যেটুকু আদায় হয়েছে, তা ঋণের সমুদ্রে বিন্দুসম জল ঢালার মতো।
কিন্তু এসব ব্যবস্থা যাদের বিরুদ্ধে, তাদের তালিকা কি তৈরি হয়েছে? রাজনৈতিক টানাপোড়েন না থাকায় এই সরকারের সুযোগ আছে নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য তালিকা তৈরি করে জনগণের সামনে প্রকাশ করার। ১৯৯১ সালের ১৯ মে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের প্রধান সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন আকারে খেলাপিদের তালিকা প্রকাশ করেছিল। এটাই ছিল প্রথম। বিগত সরকারের সময় দুই অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত ও আ হ ম মুস্তফা কামালও তালিকা প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত বড় খেলাপিদের নাম তালিকায় না থাকায় অনেকে হতাশ হয়েছিলেন তখন। তালিকা প্রকাশের পর তাদের বিরুদ্ধে কোনো দৃশ্যমান ব্যবস্থাও দেখা যায়নি। সব মিলিয়ে সেসব তালিকার গ্রহণযোগ্যতা ছিল না।
বর্তমান সরকারের উচিত, যেহেতু তারা প্রকৃত খেলাপির চিত্র বের করছে, তা উদ্ধারে আইনি, প্রশাসনিক ও অন্যান্য পদক্ষেপের বিস্তারিত প্রকাশ করা। গঠিত কমিটিগুলোকে দ্রুত রিপোর্ট দিতে তাগিদ দেওয়া। বড় খেলাপিদের বিরুদ্ধে মামলা করে জনগণকে আশ্বস্ত করা যে, সরকার কঠোর অবস্থানে আছে। এতে ব্যাংকের প্রতি জনআস্থা বাড়বে, যার সুফল মিলবে বেশি আমানত জমার মাধ্যমে।