Published : 17 Jun 2025, 02:14 PM
ইরান ও ইসরায়েলকে কেন্দ্র করে মধ্যপ্রাচ্যের সংকটের জন্য দায়ী কে—সেটি নির্ণয়ের কোনো গাণিতিক সূত্র নেই। কারণ একক কোনো ঘটনা এই সংকটের জন্য দায়ী নয়। দশকের পর দশক ধরে ইসরায়েলকেন্দ্রিক পশ্চিমা রাজনীতি ও ইরানকেন্দ্রিক মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এই সংকট তৈরি করেছে।
ধর্মীয় সহমর্মিতা ও মতাদর্শিক ঐক্য কাজে লাগিয়ে একদিকে ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলকে দমন করার জন্য ইয়েমেনের হুতি, লেবাননের হিজবুল্লাহ ও গাজার হামাসের মতো সংগঠনকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সামরিক এবং আর্থিক সহায়তার মাধ্যমে ‘রিং অব ফায়ার’ তৈরির অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে ইসরায়েল তার পশ্চিমা মিত্রদের সহায়তায় এই বহিরাগত শত্রু মোকাবেলায় গড়ে তুলেছে শক্তিশালী মৈত্রী ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।
এই অঞ্চলের বিবদমান দুই পক্ষ শক্তি ও সামর্থ্যের প্রদর্শন ও পরীক্ষার জন্য দীর্ঘদিন ছায়াযুদ্ধ পরিচালনা করে আসছে, যার বয়স প্রায় ৪০ বছর। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েলে হামলার মাধ্যমে এই ছায়াযুদ্ধ শীর্ষবিন্দুতে পৌঁছে যায়। এতে দুই দেশের মধ্যে সরাসরি যুদ্ধের প্রবল আশঙ্কা তৈরি হয়। কারণ, হামাসের ওই হামলা ছিল ইরানের ছায়াযুদ্ধের একটি ঐতিহাসিক ভুল। এর প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েল প্রথমে হামলা চালায় হামাস-নিয়ন্ত্রিত গাজা উপত্যকায়। প্রতিশোধমূলক এই যুদ্ধে ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য ছিল হামাসকে নিরস্ত্রীকরণ বা নিশ্চিহ্ন করা।
এরপর একে একে ইসরায়েল রিং অব ফায়ারের অন্য শক্তিগুলোকেও আক্রমণ করে—প্রথমে লেবাননের হিজবুল্লাহ, এরপর যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় ইয়েমেনের হুতিদের ওপর হামলা চালানো হয়। লক্ষ্য ছিল পুরোপুরি নিরস্ত্রীকরণ না হলেও অন্তত তাদের সামরিক সক্ষমতা হ্রাস করা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইসরায়েল অনেকটা সফল হয়। এসব ঘটনার ধারাবাহিকতায় ধারণা করা হচ্ছিল, পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে এই রিং অব ফায়ারের তথাকথিত ‘মদদদাতা’ ইরান।
২০২৪ সাল থেকে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সরাসরি বড় ধরনের যুদ্ধের আতঙ্ক তৈরি হতে থাকে। গত ১৩ জুন ইসরায়েলের ইরান আক্রমণ সেই আতঙ্ককে সত্যে পরিণত করেছে।
এই ধরনের হামলার লক্ষ্য—ইরানের পরমাণু ও সামরিক স্থাপনা এবং উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের কাছে আগেই অনুমিত ছিল এবং বাস্তবেও তাই ঘটেছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার এই যুদ্ধ বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক রাজনীতিতে কী ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে?
বৈশ্বিক প্রভাব তুলনামূলকভাবে সহজে অনুমানযোগ্য হলেও, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর ওপর এই যুদ্ধের প্রভাব অনেক বেশি জটিল হতে পারে।
যদি এই যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হয়, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক সংকট, কূটনৈতিক চাপে ভারসাম্য হারানো, ধর্মীয় উত্তেজনা এবং শরণার্থী সংকটের মতো জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধে হরমুজ প্রণালী বন্ধ হয়ে গেলে বিশ্বের আরও অনেক দেশের মতো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোও জ্বালানি সংকটে পড়বে। তুলনামূলকভাবে এই দেশগুলোতে জ্বালানি সরবরাহ বিঘ্নিত হবে সবচেয়ে বেশি। দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নশীল অর্থনীতিগুলো ব্যাপকভাবে মধ্যপ্রাচ্যের জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল।
বিশেষ করে ভারত ও পাকিস্তানের অপরিশোধিত তেলের একটি বড় অংশ আসে সরাসরি ইরান থেকে। যুদ্ধ দীর্ঘ হলে হরমুজ প্রণালীর স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হতে পারে, ফলে তেলের দাম বৈশ্বিকভাবে বেড়ে যাবে, যা দক্ষিণ এশিয়ার জ্বালানি নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে। অনিবার্যভাবে বাংলাদেশও ওই সংকটের মধ্যে পড়বে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের মতো তুলনামূলকভাবে কম সামর্থ্যসম্পন্ন দেশ—শ্রীলঙ্কা, নেপাল ও আফগানিস্তান—প্রতিরক্ষামূলক নীতির বাইরে তেমন কিছু করতে পারবে না।
এই সংকট ভারতের জন্য বড় রকমের কূটনৈতিক অস্বস্তি তৈরি করবে। ভারত দীর্ঘদিন ধরে ইরান ও ইসরায়েল—উভয়ের সঙ্গেই ইতিবাচক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। ইরানের সঙ্গে জ্বালানি ও অবকাঠামোতে, আবার ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা ও প্রযুক্তিতে ঘনিষ্ঠতা বাড়ছে দেশটির। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই ভারসাম্য রক্ষা করা ভারতের পক্ষে কঠিন হবে। পাকিস্তানও উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে। যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে পাকিস্তানও জটিল কূটনৈতিক সংকটে পড়বে, বিশেষ করে যদি যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ইউরোপ এতে জড়িয়ে পড়ে।
যুদ্ধ যদি পুরো মধ্যপ্রাচ্যে ছড়িয়ে পড়ে, তাহলে তা দক্ষিণ এশিয়ার ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে পারে। বিশেষ করে মুসলিমপ্রধান দেশগুলোতে—পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান—শিয়া-সুন্নি উত্তেজনা রাজনৈতিক রূপ নিতে পারে। পাকিস্তানে ধর্মীয় উগ্রবাদ তুলনামূলকভাবে শক্তিশালী হওয়ায় সেখানে এই সংঘাত সবচেয়ে প্রকট হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয় এবং যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি জড়িয়ে পড়ে, তাহলে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে নতুন করে শরণার্থী স্রোত তৈরি হতে পারে। এই দুই দেশে ইতিমধ্যেই লাখ লাখ বাস্তুচ্যুত মানুষ বসবাস করছে। নতুন করে শরণার্থী ঢল এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতা আরও দুর্বল করে তুলবে। বিশেষ করে মুসলিম প্রধান পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মতো বাংলাদেশেও ধর্মীয় গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বসংঘাত শুরু হতে পারে। এই দেশগুলোতে যেহেতু শিয়া ও সুন্নি সম্প্রদায়ের মধ্যে বিরাজমান একটি অস্বস্তি রয়েছে, ফলে এই যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়লে তা অস্বস্তিকে রাজনৈতিক সংকটে পরিণত করতে পারে।
ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যকার চলমান সংঘাতের প্রভাব পড়েছে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে। নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগের কারণে তুরবত, পাঞ্জগুর ও গোয়াদার জেলায় ইরানের সঙ্গে থাকা সব সীমান্ত ও ক্রসিং পয়েন্ট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেছে প্রাদেশিক সরকার।
এছাড়া, যদি ইরানকেন্দ্রিক শরণার্থী সংকট উপসাগরীয় দেশগুলোতেও ছড়িয়ে পড়ে, তবে সেখানে থাকা দক্ষিণ এশীয় অভিবাসী শ্রমিকদের ওপর চাপ তৈরি হবে এবং অনেককে দেশে ফিরিয়ে দেওয়ার ঝুঁকি থাকবে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা নির্ভর অর্থনীতিগুলো—বিশেষ করে বাংলাদেশ ও নেপাল—গুরুতর ক্ষতির মুখে পড়বে।
চীন দক্ষিণ এশিয়ায় একটি বড় রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি। এই অঞ্চলে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষী প্রকল্প—যেমন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ ও চায়না-পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর—যুদ্ধের ফলে ব্যাহত হতে পারে। চীনের তৎপরতা বাড়লে, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য বিশ্বশক্তিও এই অঞ্চলে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করতে চাইবে। ফলে দক্ষিণ এশিয়া পরিণত হতে পারে বৈশ্বিক ভূরাজনীতির একটি নতুন কেন্দ্রবিন্দুতে।
ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধ যদি দীর্ঘায়িত হয়, তবে দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক সংকট, কূটনৈতিক চাপ, ধর্মীয় উত্তেজনা ও শরণার্থী সমস্যার পাশাপাশি ভূরাজনৈতিক প্রতিযোগিতাও বেড়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে অঞ্চলটির দেশগুলোর এখন থেকেই সক্রিয় কূটনৈতিক ভূমিকা রাখা উচিত, এবং সম্ভাব্য প্রভাব মোকাবেলার প্রস্তুতি গ্রহণ করা জরুরি।