Published : 02 Apr 2011, 09:02 PM
সমাজ বিজ্ঞান, আইন বিজ্ঞানের সূত্র অনুযায়ী সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত হচ্ছে আইন। আর আইনের উদ্ভব, বিকাশ, বিলয়ে প্রথা, সংস্কৃতি, জীবনাচার, দেশাচারের বড় ভূমিকা রয়েছে। যুগ যুগ ধরে মানুষের মুখে মুখে একটি প্রবাদ চালু রয়েছে, তা হলো,"হাকিম নড়েতো হুকুম নড়ে না।" লিখিত হোক কিম্বা অলিখিতই থাকুক–এ প্রবচনটি কিন্তু মানুষের মুখে মুখে অতিশয় প্রচলিত। ঠিক লিজেন্ড আর মিথের মতোই। কিন্তু সব কিছু ওলটপালট করে গত বৃহস্পতিবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের একজন বিচারক ওই প্রবচনকে মিথ্যা প্রমান করে নিজের দেয়া হুকুম পরিবর্তন করে কয়েক ঘন্টা পরেই একই মামলায় আবার হুকুম দেন। বিষয়টি সেই দিন এবং পরের দিন বিভিন্ন প্রকারের গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়।
ঘটনাটি ঘটে বর্তমান সরকারের নারীনীতি নিয়ে ইসলামী ঐক্য জোটের একাংশের চেয়ারম্যান ফজলুল হক আমিনীর বিরুদ্ধে ওই আদালতে দায়ের করা দুইটি পৃথক মামলার আদেশ নিয়ে। আদেশ দেয়ার কয়েক দন্ডের মধ্যেই আদেশ পরিবর্তন করেন ওই বিচারক।
নারীনীতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার হুমকি, তাঁকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদের চেষ্টা, সম্মানহানির অভিযোগে মুফতি ফজলুল হক আমিনী এবং আরো একজনের বিরুদ্ধে গত বৃহস্পতিবার দুইটি পৃথক মামলা হয়। বৃহষ্পতিবার ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের আদালতে এ মামলা করেন সম্মিলিত ইসলামী জোটের সভাপতি হাফেজ মাওলানা জিয়াউল হাসান এবং বাংলাদেশ জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী।
জিয়াউল হাসানের মামলার আরজিতে বলা হয়, গত ২১ মার্চে বাংলাদেশ ফটো জার্নালিষ্ট এসোসিয়েশন মিলানায়তনে ইসলামী ছাত্র মোর্চা আয়েজিত একটি আলোচনা সভায় " শেখ হাসিনা শূন্য হবে দেশ"– বর্তমান সরকারের নারীনীতির সমালোচনায় এ হুমকি দেন আমিনী। যা পরের দিন বিভিন্ন গনমাধ্যমে প্রচারিত, প্রকাশিত হয়। আমিনী এ বক্তব্যের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে হত্যার হুমকি দিয়েছেন। যা একটি রাষ্ট্রদ্রোহের অপরাধ। এ মামলার অপর আসামি হলেন, ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটির প্রচার সম্পাদক মাওলানা আহলুল্লাহ ওয়াছেল। পরের মামলায় আসামি করা হয় শুধুমাত্র আমিনীকে ।
এ মামলার আরজিতে বলা হয়, গত ১৮ এবং ২৫ মার্চ তারিখে রাজধানীর মুক্তমঞ্চে ইসলামী আইন বাস্তবায়ন কমিটি আয়োজিত সমাবেশে আমিনী বলেছিলেন, "শেখ হাসিনাকে ক্ষমতা থেকে টেনে হেঁচড়ে নামানো হবে," "হাসিনা টিকে থাকতে পারবে না"। গত ২২ মার্চে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সমাবেশে আমিনী বলেন, "হরতালে বাধা দিলে দেশ অচল করে দেয়া হবে।" যা কটুক্তি, মানহানিকর এবং হুমকিও বটে।
জিয়াউল হাসানের মামলায় এদিন সকাল ১১ টায় মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতের বিচারক হারুন অর রশিদ প্রকাশ্য আদালতে আমিনী এবং ওয়াছেলকে আগামি ২৬ এপ্রিল তারিখে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন। এর কিছুক্ষন পরে এ বি সিদ্দিকীর মামলায় আমিনীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানার আদেশ দেন। কিন্তু আদেশটি ঘোষনার পর এজলাসে উপস্থিত বাদি পক্ষের আইনজীবীসহ অপর আইনজীবী ,বিভিন্ন গনমাধ্যমের সাংবাদিক, সরকারী বিভিন্ন ধরনের গোয়েন্দা সংস্থার সদস্য, বিচারপ্রার্থীদের সামনেই সে আদেশ ফিরিয়ে নিয়ে আগামি ২৫ এপ্রিল আদেশ দেয়ার জন্য তারিখ ধার্য করেন ওই বিচারক। বাদি জিয়াউলের আইনজীবী ঢাকা বারের সভাপতি শেখ হেমায়েত হোসেন, দুই মামলার বাদিই বিভিন্ন বেসরকারী টেলিভিশন ও অনলাইন দৈনিকে সমন ও গ্রেফতারি পরোয়ানার আদেশের বিষয়টি নিশ্চিত করে সাক্ষাৎকারও দেন। তা বৃহষ্পতিবার বিকাল পর্যন্ত প্রচারিত, প্রকাশিতও হয়। ওই সাক্ষাৎকারের সবাকচিত্র (ভিডিও ফুটেজ)ইলেকট্রনিক মাধ্যমগুলোর আর্কাইভে জমা রয়েছে।
সবার সামনে প্রকাশ্যে যে ঘোষণা বিচারক দিলেন আবার তা প্রত্যাহার করলেন এমন বিষয়টি তিনি কীভাবে ও কোন আইন অনুযায়ী করলেন তা তিনি কেন, কেউই বলতে পারবেন না। এরকম কর্ম করার কোন সুযোগ বা অধিকার কোন বিচারকের নেই। 'ফৌজদারি কার্যবিধি' বা 'ফৌজদারি বিধি এবং আদেশ' (ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড, ক্রিমিনাল রুলস এ্যন্ড অর্ডারস )-এর কোথাও একবার আদেশ হয়ে গেলে আবার একই বিচারক ওই আদেশ পরিবর্তন করতে পারেন কোন পক্ষ থেকে কোন আবেদন ছাড়াই– এমন কোন আইন নেই। কিন্তু এ পোড়ার দেশে সবই সম্ভব। এই গর্হিত, অবিচারিক আচরনের জন্য ওই বিচারককে এখনো পর্যন্ত কারো কাছে কোন জবাবদিহিতাও করতে হয়নি। এহেন কর্মটি নিয়ে বিভিন্ন স্তরের অপর বিচারকদের সঙ্গে আলাপ করলে তারা জানান, এ রকম বিচারকদের কারনেই বিচার বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। ট্রান্সপারেন্সী ইন্টারন্যাশনালরা কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে। ওই মামলার আদেশ দিতে বিচারক তার জ্যেষ্ঠ বিচারকদের সঙ্গে পরামর্শ করে নিতে পারতেন। বাদির জবানবন্দী গ্রহন, শুনানি গ্রহনের পরপরই আদেশ না দিয়ে ভেবেচিন্তে একটু পরেও আদেশ দিতে পারতেন। কিন্তু বিচারক তা করেন নি। আর দূর্মুখরা বলছেন বিচারক সরকারকে খুশি করার জন্য অতিআগ্রহী হয়ে ওই আদেশ দিয়ে নিজেও নিজের বিপদ ডেকেছিলেন, অন্যদেরকেও বিপদে ফেলেছিলেন।
প্রকাশ বিশ্বাস : বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আদালত প্রতিবেদক।