Published : 05 Mar 2012, 08:30 PM
এখন ঠিক করে বলা যাবে না মাননীয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষিত ৪৮ ঘন্টার পর কত ৪৮ ঘন্টা গেছে। প্রথম দফায় পার হবার পর নানা কথা এসেছে পুলিশ ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তরফ থেকে। অনেক আশার বাণী শোনানো হলেও সুরাহা হয়নি। সন্দেহটা কেবল গণমাধ্যমের কর্মীদের নয় সাধারণ মানুষেরও বটে যে কিছু ঘাপলা ও ঘাটতি আছে যেটা ঢাকার চেষ্টা চলছে। এটা সত্য কিনা জানা নাই। তবে এই ধোয়াঁটে পরিবেশে এই ধরণের সন্দেহ থাকাটাই স্বাভাবিক।
এখন আরো কত ৪৮ ঘন্টা পার হবে তার অপেক্ষা খুনি ধরা পর্যন্ত। তারপর হয়ত যার যা ইচ্ছা সেরকম সাজানো কিছু সিদ্ধান্ত বা গোয়েন্দাগীরির ফল ঘোষণা করা হবে। আবার প্রকৃত তথ্য বের হতে পারে। কিন্তু সবার মনে যে সন্দেহ আর অবিশ্বাসের পাহাড় জমা হয়েছে সেটা ডিঙিয়ে শেষমেশ পুলিশের কথা কেউ বিশ্বাস করবে? আস্থা স্থাপনের সময়টা পার হয়ে গেছে। কিন্তু ৪৮ ঘন্টার মত সময় পার হোক আর না হোক, কথার উৎপাদন বাড়ছেই।
এই অতিকথনের প্রধান ভুক্তভোগী সাহারা খাতুন নিজেই। বিডিআর হত্যাযজ্ঞের সময় থেকেই তার অবস্থা সামলাবার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে এবং সেটা বর্তমানে গিয়ে বেশ দৃঢ় হয়েছে। কেনই বা তিনি এই কথা বলতে গেলেন সেটা জানা নেই তবে বাক্য ব্যবহারে অসংযমীর ওপর মানুষ আস্থা রাখে কম।
যদিও তিনি ও তার অধীনস্থ পুলিশের কাজের সাফাই বারবার গেয়েছেন সেটা পাবলিকের কানে খুব একটা পৌঁছায়নি। আর "৪৮ ঘন্টা" বক্তব্যটাই সবার মনে পড়ছে এবং ধারণা জন্মেছে যে খুনিদের এই সময়ের মধ্যে ধরা সম্ভব ছিল কিন্তু হয়নি।
মানুষ ভাবে পুলিশ ঘুষখোর, নানাভাবে অসৎ কিন্তু চাইলে ভীষণ যোগ্যতার সাথে কাজ করতে পারে। মানুষ আরো ভাবে তারা চাইলে প্রায় সর্বক্ষেত্রে অপরাধীকে চিহ্নিত করতে পারে কিন্তু হয়ত চাপের জন্য বা ইচ্ছা না থাকায় সনাক্ত অপরাধীকে ধরে না। সবাই মনে করে এই ক্ষেত্রেও এটা হয়েছে। মানুষ যাতে এরকম না ভাবে সেটার দায়িত্ব যাদের ছিল তারা বোধ হয় ভাবেননি যে সবার সামনে বিষয়টা এত বড় হবে। শেষ পর্যন্ত আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থার ওপর অনেক বড় একটা আঘাত এসে পড়লো ।
গোটা বিষয়টির জন্য অবশ্য কেউ কেউ গণমাধ্যমকে দোষ দিচ্ছেন। বাংলাদেশে মিডিয়ার ভূমিকা হচ্ছে নন্দ ঘোষের 'ভূমিকা' অর্থাৎ 'মিডিয়ার সব দোষ' তবে মিডিয়াকে দোষ দেওয়া নিরাপদ বটে। এর কোন দল নেই, এরা রাস্তায় হরতাল করে না, এদের নেতাদের কিনতে টুকটাক সুবিধা দিলেই চলে কারণ এরা দলীয় কর্মীও বটে। মালিকদের বিষয়টি অন্য রকম কারণ তারা সকল বাংলাদেশী ব্যবসায়ীর মত লাভের বাইরে খুব একটা কিছু জানে না, কৃষ্ণের মত যখন যার তখন তার।
অবশ্য মিডিয়ার নেতৃবৃন্দ তাদের অবস্থানের সমালোচনার প্রতিবাদ করেছেন এবং বলেছেন জনগণ ছাড়া তারা কারও কাছে দায়বদ্ধ নয়। এই বক্তব্যের সাথে আমরা সহমত।
বস্তুতপক্ষে, এই ঘটনায় গণমাধ্যমের ভূমিকা শুধু যে সমালোচিত হয়েছে তা নয়, তাদের নেতা-মালিকদের সম্পর্কেও কথা এসেছে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে যে একটি চ্যানেলের মালিকের ভাই এর সাথে জড়িত কিন্তু প্রভাব খাটিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়।
এই মালিকপক্ষ আবার ভয়ে আছে যে যদি নিহত সাংবাদিক দম্পতির ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে এমন কিছু উন্মোচিত হয় যেটা পাবলিক অপছন্দ করে তাহলে গণমাধ্যমের সাধারণভাবে এবং এই চ্যানেলের বিশেষভাবে ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে যার ফলে ঝামেলায় পড়তে হবে, যার ফলে লাভ কমতে পারে।
এই সব কথার কোন ভিত্তি নেই কিন্তু যখন সত্য উদ্ঘাটিত হতে দেরী হয় বা বাধাগ্রস্থ হয় তখন সর্বস্থানে এইরকম গুজবই বাড়ে।
তার মানে এই নয় যে গণমাধ্যমে যে সব নিয়ম-নীতিমালা-বহির্ভূত ঘটনা ঘটেছে তা কোনভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। এই ঘটনা ঘটার অন্যতম কারণ হচ্ছে মিডিয়া কী অবস্থায় কী ব্যবহার করবে, কী করবে না, তার কোন নীতিমালা নেই বা তা প্রয়োগযোগ্য নয়।
সেই কারণেই দরকার একটি স্বাধীন নীতিমালা ব্যবস্থাপনা যার কর্তৃত্ব থাকবে মিডিয়ার মানুষের হাতে, আমলা, বিচারক বা দলীয় বুদ্ধিজীবিদের হাতে নয়।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর প্রথম আলোতে যে লেখাটি লিখেছেন এই বিষয়ে তা প্রনিধানযোগ্য (http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-03-05/news/229909)।
কিন্তু এই ঝামেলায় কেবল মিডিয়ার লোক জড়িত নয়, ব্যবসায়ীদের নামও উঠে এসেছে। জনৈক মন্ত্রীর ভাইয়ের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম কয়েক বার এসেছে। বলা হচ্ছে এদের ব্যবসার কোন 'ডিল' -এর খবর এই দম্পতির কেউ পেয়েছিল এবং সেই খবর চাপা দেবার জন্য এই হত্যাকান্ড।
আমাদের অবশ্য মনে হয় না। এই গুজবের ভিত্তি নেই কারণ তাহলে এত দিনে সব ক্ষমতাবান রাঘব বোয়ালদেরই সব ডিল জানাজানি হবার কারণে কিছু না কিছু হতো। শেয়ার মার্কেট পতনের জন্য যে গোষ্ঠীকে একবার নয় বার বার দায়ী করা হয় তাদের কি কিছু হয়েছে? তারাও প্রধানমন্ত্রির ঘনিষ্ট কিন্তু এইসব খবর বার হবার পর কোন সাংবাদিককে গুম খুন করার প্রয়োজন হয়নি নিজেদের রক্ষা করতে।
এটা বেহায়ার দেশ। এমন কিছু কেউ করতে পারে না যাতে লজ্জা পেয়ে অন্যকে খুন করার প্রয়োজন হয়।
অবশ্য এই ধরনের গুজবে আগ্রহী ছিলেন বেগম খালেদা জিয়া যিনি কম বেশী এই লাইনেই কথা বলেন। তার বক্তব্য ছিল অত্যন্ত অবিবেচক ও মনগড়া যার ফলে আদালত তাকে ধমক দেয়। যদিও আদালতের ওপর মানুষের আস্থা অনেকটাই কম ইদানিং তবুও এই ধরনের বক্তব্যের জন্য তাকে ধমক দেওয়ার বিষয়টিকে সাধুবাদ জানাতে হয়।
তবে হাসিনা যেটা বলেছেন, অর্থাৎ বেড রুম পাহারা দেওয়া সম্ভব নয় সেটা বিষয়টিকে আরও নাজুক, ধোঁয়াটে করেছে। ব্যর্থতা স্বীকার করে নেওয়ার কথাও এটা বটে। শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে কী বোঝাতে চেয়েছেন তা পরিস্কার নয়।
আমরা আমাদের ঘরে তো বেডরুমেই থাকি, সেটাই আমাদের পারিবারিক ঠিকানা। সেটার নিরাপত্তা ছাড়া আর কোন নিরাপত্তা আমরা আশা করতে পারি বা চাই? তাহলে কি আমাদের শয়নকক্ষ নিরাপত্তা বলয়ের বাইরে থাকবে এখন থেকে?
তাহলে কিসের নিরাপত্তা চাইবো? নাকি তিনি অন্য কিছু বোঝাতে চেয়েছেন যার সাথে 'বেডরুমের" অন্য মানে বা বিশ্লেষণ আছে?
এই কথা বলে ধোঁয়াটে বিষয়টা আরও কুয়াশাচ্ছন্ন করেছেন তিনি।
সরকারের কেন এই মনোভাব কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না। কী এমন রহস্য থাকতে পারে? আর থাকলেও বা এমন ভয়ের কী আছে?
যে অপরাধী তার ফাঁসির আদেশ পাবার পরও শেষ পর্যন্ত আওয়ামী নেতার সন্তান হওয়ার সুবাদে রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পেতে পারেন তাহলে অপরাধী সনাক্ত করতে ভয় কোথায়? হোক না সে আপন লোক। ক্ষমা তো করাই যাবে শেষমেষ।
আফসান চৌধুরী: নির্বাহী সম্পাদক, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম।