Published : 19 Jun 2012, 07:01 PM
আশুলিয়া আবার ফুঁসে উঠেছে। গত কয়েক দিন ওখানে ব্যাপক হাঙ্গামা হয়ে গেল। শ্রমিকরা সড়ক অবরোধ করে আর মালিকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ ঘোষণা করে শক্তি প্রদর্শন করে চলেছে। তবে মালিকপক্ষের যথাযথ প্রতিনিধি থাকলেও শ্রমিকদের কোনো নির্বাচিত প্রতিনিধি নেই। সব পক্ষের প্রকৃত প্রতিনিধির অভাবে সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে সিদ্ধান্ত নেওয়াও কঠিন। এবার আশুলিয়ায় একটি পোশাক কারখানায় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে মালিক -শ্রমিকদের সমঝোতা বৈঠক চলাকালে বাইরে অশান্ত পরিস্থিতি দেখা যায়। পোশাক শ্রমিকদের সমস্যার জের ধরে ভাংচুরের শিকার হয়েছে যানবাহনের মালিকরা।
পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি আন্দোলন নতুন নয়। তবে সার্বিক বিচারে মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে শেষ পর্যন্ত শ্রমিকরা জয়ী হন না। এ সফলতা শেষ বিচারে তেল মাখানো বাঁশে চড়ার মতোই ফলদায়ক। শ্রমিক রাজ কায়েমে বিশ্বে যারা কাজ করেছেন সে সব মনীষীরা বরং উল্টো কথাই বলেন। শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়নবাদী আন্দোলন বরং শ্রমিক রাজ কায়েমে প্রতিবন্ধক বলে মত প্রকাশ করেন। তাই যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিন্টন শ্রমিক নেতার হত্যাকাণ্ডকে সামনে নিয়ে আসলে বা যুক্তরাষ্ট্র পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের ওপর জোর দিলে তা অভিনব কোনো ব্যাপার হবে না। কিন্তু বাংলাদেশে পোশাক শিল্পের মালিকরা ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠায় ঘোর বিরোধী! আশ্চর্যজনকভাবে একই সুরে কথা বলেন সরকারের মন্ত্রীরাও! কিন্তু ভেবে দেখা দরকার পোশাক শিল্পের সমস্যাকে কিভাবে মোকাবেলা করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশে পোশাক শিল্প সত্তর দশকের শেষে শুরু হয়ে কয়েক ধাপে বিশাল আকার ধারণ করেছে। বলা হয়ে থাকে এ শিল্পে ৩০ লাখ শ্রমিক কাজ করছেন। পশ্চিমা দেশগুলো শিল্পে অনুন্নত দেশ থেকে পোশাক আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়ায় বাংলাদেশে এ শিল্পের বিকাশের প্রধান কারণ। জিএসপি, কোটা ইত্যাদি নানা সুযোগ সুবিধাদানের ভেতর দিয়ে এ শিল্প খাতের বিকাশ হয়েছে। ফলে এ বিকাশের জন্য পোশাক কারখানার উদ্যোক্তাদের বাজার সৃষ্টির নিজস্ব কৃতিত্বের চাইতে পশ্চিমা দেশের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তই প্রধান ভূমিকা রেখেছে। আশি ও নব্বই দশকে যারা পোশাক কারখানা করে ধনাঢ্য হয়েছেন তাদের অধিকাংশই নব্য কারখানা মালিক। এই দুই দশক জুড়ে আমরা দেখি ক্ষমতাশালীদের ছত্রছায়ায় অজস্র প্রকল্প ঋণ, ঋণপত্রের কারসাজি, ঋণ খেলাপি, আগুনে পুড়ে কারখানার কয়লা হওয়া আর শ্রমজীবীদের দগ্ধ লাশের মিছিল। তবে, কারখানা পুড়ে যাওয়ায় দিশেহারা কোনো মালিককে আত্মহত্যা করার খবর ছাপা হতে দেখি না। শেয়ার বাজারে কয়েক লাখ টাকা খোঁয়ানোয় যেমনটি দেখি।
এ কথা সত্য যে গত তিন দশকে পোশাক কারখানার পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। দুর্ঘটনায় শ্রমিকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া শুরু হয় বিগত শেখ হাসিনার সরকারের আমলে। শুরু হয় বিকল্প সিঁড়ি তৈরির এবং সেটি ব্যবহারের প্রশিক্ষণের। বেশ কিছু কারখানা তার কর্মীদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকে যা অবশ্য সব কারখানায় দেওয়া হয় না। তবে, পোশাক কারখানার মালিকরা প্রথম থেকেই কতকগুলো বাক্য আউড়ে চলেছেন- 'আমরা বৈদেশিক মুদ্রা আনি', 'সস্তা শ্রম ছাড়া বাজার হারাবো', 'অসন্তোষের পেছনে বিদেশী ষড়যন্ত্র' , 'ভর্তুকি দাও' ইত্যাদি।
কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে ইউরোপ ও আমেরিকার বাজারে জিএসপি, কোটাসহ বিভিন্ন নীতিই এদেশের পোশাক শিল্পের গতি প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণ করেছে। এসব আন্তর্জাতিক কলাকৌশল পোশাক কারখানার পশ্চাদ সংযোগ শিল্প গড়তেও সহযোগিতা করেছে। আশির দশকের গোড়ায় ৩০/৪০টা সেলাইকল নিয়ে একখানা কারখানা ফেঁদে বসা গেলেও এখন আর তা লাভজনক কী?
এ শিল্পের বিকাশেই শুধু নয় এদেশে পোশাক কারখানার যতটুকু গুণগত পরিবর্তন এসেছে তার পেছনেও প্রধান কৃতিত্ব ওই আন্তর্জাতিক মহলের। শিশু শ্রম, কারখানার পরিবেশ এসব নিয়ে তারা যখন যে শর্ত বেঁধে দিয়েছে তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে প্রতাপশালী এইসব উদ্যোক্তারা। কিন্তু শ্রমিকরা মজুরি বাড়ানোর কথা বললে তাদের ভাতে মারতে একযোগে কারখানা বন্ধ করে দিতে কসুর করেন না এরা।
পোশাক শিল্প নিয়ে গবেষণাগুলোতে বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে 'লিড টাইম' বা অর্ডার নিয়ে পোশাক রপ্তানি করতে যে সময় লাগে, সাধারণ মানের পোশাক থেকে বিশেষ মানের পোশাক বানানোয় উত্তরণ, সংযোগ শিল্পের বিকাশ, নতুন বাজার সন্ধান ইত্যাদিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে অনেক আগেই। এক গবেষণায় দেখা যাচ্ছে ২০০০ সালের পর থেকে চীনসহ বেশ কিছু দেশ তাদের তৈরি পোশাকের রপ্তানি মূল্য ব্যাপকভাবে কমিয়েছে কিন্তু বাংলাদেশ তা পারেনি। ২০০১ থেকে ২০০২ সালের মধ্যে চীন ৪৬ শতাংশ রপ্তানি মূল্য কমিয়ে ফেলে যেখানে অন্যরা মাত্র দুই শতাংশ দাম কমাতে সক্ষম হয়। বোঝাই যায় এই দাম কমানোর প্রতিযোগিতা মজুরি কম দেওয়ার ওপর নির্ভরশীল নয়। দামই শুধু নয় লিড টাইমসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও চীন যে সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ তা দেখায়নি। এক হিসেবে দেখা যায়- ১৯৯৩ সালে বাংলাদেশ, ভারত ও চীনে পোশাক শিল্পে ঘণ্টায় গড় মজুরি ছিল যথাক্রমে ০.১৬, ০.২৭ ও ০.২৫ ডলার। ২০০২ সালে তা দাঁড়ায় ০.৩৯, ০.৩৮ ও ০.৬৮ ডলারে।
পাশাপাশি অন্য খাতের প্রসঙ্গ আনা যায়। '৮২ সালের পর থেকে এ দেশে ওষুধ শিল্পের ব্যাপক বিকাশ হয়েছে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত শিল্পে অনুন্নত দেশকে রয়েলিটি ফ্রি সুবিধা দেওয়ায় বাংলাদেশের এই শিল্প এতো বিকশিত হয়েছে। ৮৭টি দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। বিকিকিনিতে দাম সব ক্ষেত্রেই একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলেও ওষুধ শিল্পে মালিকদের পোশাক শিল্পের মালিকদের মতো লম্ফঝম্ফ করতে দেখা যায় না। শুধু তাই নয় এসব শিল্পে কর্মীদের ট্রেড ইউনিয়ন চালু থাকলেও শ্রমিক অসন্তোষের কোনো খবর চোখে পড়ে না।
সমস্যা সমাধানে পোশাক শিল্পের মালিকরা প্রথম থেকেই কারখানার ভেতরে ও বাইরে বল প্রয়োগের পন্থাই শ্রেয় মনে করেন। আশি নব্বই দশকে কয়েক মাসের মজুরি বকেয়া রেখে শ্রমিকদের ঠকানো যখন সাধারণ ঘটনা ছিল তখনও শ্রমিকরা রাস্তায় নামলে পুলিশ লাঠি পেটা করতো। সব কারখানা এ ধরণের কাজ না করায় এক সময় এই প্রবনতা প্রতিহত করা সম্ভব হয়।
সে সময় অমানুসিক শোষণ-নির্যাতনের মধ্যে দিয়ে গেলেও শ্রমিকরা তাদের দাবি নিয়ে কোনো কথা বলতে পারতো না। কিছু কিছু ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন গড়ার চেষ্টা করলেও সেগুলো খুব একটা কার্যকর হয়নি। সরকারও পোশাক শ্রমিকদের অধিকারের ব্যাপারটিতে গুরুত্ব কম দিতো। তবে, এই সময়কালেই পশ্চিমা ক্রেতা দেশের চাপে শিশু শ্রম, শ্রম পরিবেশ ইত্যাদি বিষয়ে অগ্রগতি হয়েছে। পুরো চিত্রটা দেখে মনে হতেই পারে পশ্চিমা শক্তি না চাইলে কী ভয়াবহ জুলুমই না চালু থাকতো পোশাক শ্রমিকদের ওপর।
লক্ষ্যণীয় বিষয়, আশি নব্বই দশকের মতো এখনও পোশাক শিল্পাঞ্চলগুলোতে সকালে রাস্তায় একই দৃশ্য দেখা যায়। শত শত গার্মেন্টকর্মী হেটে যাচ্ছে, অল্প বয়সী শ্রমিকরা দিন-রাত খাটছেন। মূল মজুরির সঙ্গে ওভার টাইমের নামে কিছু বাড়তি নিয়ে তারা হিসেব করেন তাদের আয়। একটা বয়স পর্যন্ত কাজ চালিয়ে নেওয়া সম্ভব হলেও শেষ পর্যন্ত তা ধরে রাখা তাদের সম্ভব হয় না। তবে কী পোশাক কারখানাকে স্বল্পকালিন কর্মক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করতে হবে?
এভাবে কী কখনো ভেবে দেখা হয়েছে যে বিদেশী কোম্পানিতে মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানরা চাকরি পেলে বর্তে যায়? কারণ সেখানে বেতনসহ সব সুযোগ সুবিধা বেশি। অথচ উন্নত বিশ্বের বাজারের জন্য পোশাক তৈরি করে নির্মম শোষণের শিকার হন কেন এই পোশাক কর্মীরা?
এবার আশুলিয়ায় অসন্তোষের সময় ব্যবসায়ী নেতা ও একটি বিশাল পোশাক কারখানা গ্রুপের মালিক এ কে আজাদ মজুরি বাড়ানোয় সম্মতি দেন। কিন্তু অন্য মালিকরা তা যে সমর্থন করেননি সেটি তাদের অনির্দিষ্টকালের জন্য কারখানা বন্ধ রাখার কর্মসূচিতে স্পষ্ট। ব্যবসাসফল পোশাক শিল্প মালিকরা যে শ্রমিকদের বেশি সুযোগ সুবিধা দিতে প্রস্তুত না তা এ থেকে বোধগম্য। অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে হাজার পাঁচেক মালিকের এসোসিয়েশনের দলবাজিই বাঁধা।
এছাড়া, আন্দোলন যেন কারখানাকেন্দ্রিক থাকে সেজন্য পোশাক শ্রমিকদের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। মালিক শ্রমিকদের অভ্যন্তরীণ সমস্যার জন্য পথের যানবাহন তার দায়বহন করতে পারে না। নিয়মতান্ত্রিক ট্রেড ইউনিয়ন থাকলে রাস্তায় দাঙ্গা-হাঙ্গামা নেমে আসার কথা নয়।
বাংলাদেশে পোশাক কারখানায় ট্রেড ইউনিয়ন করার পক্ষে যুক্তরাষ্ট্র, তাই বলতে দ্বিধা নেই, আজ হোক কাল হোক এ অধিকার শ্রমিকরা পাবে। যেমনটি এ শিল্পখাতে অন্যান্য ইস্যুগুলোতে হয়েছে। সরকারকে রাজনৈতিক দৃষ্টি নিয়েই নীতি নির্ধারণ করতে হবে। পোশাক শিল্পের মালিকদের ব্যবসায়িক দৃষ্টি দিয়ে বিষয়টা দেখা যাবে না। এরাই তো এক সময় তাদের শ্রমিকদের মজুরি সরকারকে দিতে হবে বলে কাণ্ডজ্ঞানহীন দাবি তুলেছিল।
সরকারকে জীবনযাত্রার ব্যয়ের ভিত্তিতে ন্যূনতম মজুরি ঠিক করার দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দীর্ঘ বঞ্চনার কারণে এ শিল্পখাত দিনে দিনে স্পর্শকাতর হয়ে উঠেছে। এটা স্পষ্ট আগের কায়দায় আর এসব কারখানার ব্যবস্থাপনা করা যাচ্ছে না। তাই নির্বাচিত প্রতিনিধি দিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন চালু করা দরকার।
এ কাজে মালিকদের কোনো পক্ষ যদি বাধা হয়ে দাঁড়ায়, যদি তারা কারখানায় তালা ঝুলিয়ে হুমকি দেয়, তবে সরকারকে দুষ্ট মালিকদের দমনে শক্তি দেখাতে হবে।