Published : 31 Jul 2019, 02:34 PM
রক্তের ঋণও যখন পরিশোধের তাগিদ থাকে না, তখন রাষ্ট্রকে রাষ্ট্র বলে চেনা দায়। রাষ্ট্র নামে যা টিকে থাকে তা আর যা-ই হোক, মানুষের ভরসাস্থল হয় না। ভুক্তভোগীর প্রতিকার না পাওয়াই রেওয়াজে দাঁড়িয়ে যায়; ওয়াদার বরখেলাপই তখন দস্তুর। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের নিষ্ফল এক বছর (২৯ জুলাই ২০১৮ থেকে ২৯ জুলাই ২০১৯) যেন সেই কথার ওপর আরেক দফায় আনুষ্ঠানিক সিলমোহর।
হররোজ অগণন অকাল মৃত্যুর কালেও মিম-রাজীবের প্রাণহানি অন্তত ওদের মতো কচিকাঁচাদের প্রাণে বেজেছিল। দেশব্যাপী হাজারো-লাখো স্কুল-কলেজপড়ুয়া তাই রাজপথে নামে। তাদের ঐক্যবদ্ধ লাগাতার আন্দোলনের মুখে সরকারও 'নতমুখে' সব দাবি পূরণের আশ্বাস দেয়। সড়কের স্বাভাবিকতা ফেরানোর হাতেকলম নজির স্থাপন করে ক্লাসে ফিরে যায় ওরা। এরপর?
মাঝখানে আর কিছু নেই; সিধা বছরপার। না, ভুল বললাম, মাঝখান থেকে নিভৃতে ঝরছে মিমের মায়ের চোখের জল, রাজীবের স্বজনদের বুকউজারি আহাজারি। আপনজন হারানোর এই অতল বেদনা অবশ্য সমাজ-সংসারকে ছোঁয় না; সন্তানহারা মা-বাবার বুকভাঙনের শব্দ রাষ্ট্রের কানে পৌঁছায় না!
রাষ্ট্র কি তবে বধির? না, আলবাৎ না। তবে রাষ্ট্র শোনে তার সুবিধামতো— সবকিছু 'ফিল্টার' করে। একই মাত্রা বা হাটর্জের দুটি ভিন্ন কথার একটি হয়তো শোনে, অন্যটি কানেও তোলে না। বিজ্ঞানে যতই একে অবাস্তব দাগিয়ে দেওয়া হোক, ব্যবহারিকভাবে এমন কায়দা-কৌশলই রাষ্ট্রের রপ্ত। এ কারণে পীড়িতের কাতর স্বর কর্ণকুহরে না পৌঁছালেও সামান্যতম সমালোচনার আওয়াজও রাষ্ট্রের কান এড়ায় না। এমন চমৎকারিত্বের মাফলার আঁটা সরকারের কানে।
মাঝখানে আরও আছে: আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে দায়ের ৬০টি হয়রানিমূলক মামলা আইন মোতাবেক দিব্যি চলছে। এরই মধ্যে ৫২ শিক্ষার্থীসহ ৯৯ জনকে জেলেও রাত কাটাতে হয়েছে। মাসে মাসে আদালতে চক্কর কাটতে হচ্ছে অনেককে। সবই আইনি ব্যবস্থার নজির!
অথচ সহপাঠীর রক্তের মর্যাদা প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে সড়কে নেমেছিল তারা শৃঙ্খলা ফেরাতে, নৈরাজ্য বন্ধে। অন্যায়ের প্রতিকার চাওয়ার এই তাগিদ কি স্যালুটযোগ্য নয়? ন্যায় প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা তো শিক্ষার্থীদের আগামীদিনের মস্ত মানুষ হওয়ার নির্ভেজাল লক্ষণ। তবু তা সত্ত্বেও সরকারদলীয় ছাত্রসংগঠনের হেলমেট বাহিনীর নির্মম হামলার শিকার হতে হয়েছিল তাদের। এমনকি হামলা চালানো হয় তখন কর্তব্যরত সাংবাদিকদের ওপরও। এ ঘটনায় কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, এমন কথা কেউ শোনেনি। তবে সরকার যে এ ক্ষেত্রেও বুদ্ধসম হাত তুলে ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়েছিল, তা অবশ্য দেশবাসী দেখেছে।
আর 'দুর্ঘটনা' নামের যে 'দায়মুক্তির হত্যা'র প্রতিবাদে এই নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, তাও আগের মতো 'নির্বিঘ্নে' জারি আছে! বুয়েটের সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) হিসাবে, ২০১৮ সালের ১ জুলাই থেকে চলতি বছরের ১ জুলাই পর্যন্ত ঢাকায় সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ২৯৭ জন। ২০১৭ সালে এ সংখ্যা ছিল ২৭৬। অর্থাৎ ক্যালেন্ডারে হিসাবে দিন গেছে, 'সময়' বদলায়নি।
রাষ্ট্র কি তবে দেখতেও পায় না? আলবাৎ পায়। তবে যতটুকু দেখতে চায়, ঠিক ততটুকুই দেখে। দরকার মাফিক চোখে ঠুলি পরা রাষ্ট্রের সাবেকি অভ্যাস। তাই সময়মতো নজরের এস্তেমাল শেষে ফের ইচ্ছেমাফিক ঘুম। তবে এই ঘুমকে বিজ্ঞানের পরিভাষায় সংজ্ঞায়িত করা যায় না, এটুকুই যা ফারাক।
না শুনুক, না দেখুক; তাই বলে গন্ধও কি পাবে না? নিঃশ্বাস তো আর নিয়ন্ত্রণ করা যায়, বিষয়টি বেঁচে থাকার সঙ্গে সম্পৃক্ত। তার মানে, শত শত মিম-রাজীবের রক্তের গন্ধ রাষ্ট্রের নাসারন্ধ্রে ঠিক পৌঁছায়। তবে হররোজ একই গন্ধ— একটু গা-সওয়া তো হয়ই! আর ষড়যন্ত্রের গন্ধ তালাশে ব্যস্ততাও বেহদ। তাই ভুলে যাওয়াটা দোষের কিছু নয়!