Published : 26 Nov 2019, 01:02 PM
দেশের ছোটোবড়ো প্রায় সবগুলো রাজনৈতিক দলে দেখা দিয়েছে, সংকট, অস্থিরতা। ধরে নেওয়া যায়, দেশের সবচেয়ে বড়ো রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ। এই ধরে নেওয়ার কারণ এই দলটি এখন ক্ষমতায় আছে। শক্তি সামর্থ বেশি না হলে তো তাদের ক্ষমতায় থাকার কথা না। বড়ো এবং ক্ষমতায় থাকা দল হিসেবে আওয়ামী লীগে কোনো সমস্যা নেই, সেটা মনে করা ঠিক হবে না। তবে যারা সরকারে নেই, তাদের চেয়ে সরকারে থাকাদের সমস্যা একটু আলাদা হওয়ারই কথা। আওয়ামী লীগে এখন সবচেয়ে বড় সমস্যা টানা ক্ষমতায় থেকে দলটিতে এখন সুবিধাবাদী এবং সুযোগসন্ধানীদের সংখ্যা বেড়েছে। যারা সব সময় সরকারি দল করেন তারা সবাই এখন আওয়ামী লীগমুখী। তাই নবাগত, বহিরাগতদের নিয়ে আওয়ামী লীগ সংকটে আছে। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের নিজেই একাধিকবার দলে 'কাউয়া' এবং 'হাইব্রিড' সমস্যার কথা উল্লেখ করেছেন। দলের মধ্যে আবার 'পাওয়া' এবং 'না-পাওয়া' দ্বন্দ্বও আছে। দল ক্ষমতায় থাকায় দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মী কেক-সমুচার ভাগ পেয়েছেন অথবা সমানভাগে আখের গোছানোর সুযোগ পেয়েছেন তা-ও নয়। অন্যদিকে দল এবং সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলন নিয়মিত না হওয়ায় এবং একবার কেউ কোনো পদ পেলে তা আর জীবনকালে ছাড়তে না চাওয়ায় পদ-পদবি নিয়েও ক্ষোভ-অভিমান আছে। দলে এমন অনেকেই আছেন, যারা নিজেদের 'ত্যাগী' মনে করেন এবং দল এতোদিন ক্ষমতায় থাকার পরও যথাযথভাবে 'মূল্যায়িত' না হওয়ায় হতাশায় ভুগছেন। ফলে দলের ঐক্য এখন সংহত নয়। ভোট এলে প্রার্থী বাছাইয়ে এবং সম্মেলন এলে নেতৃত্ব নির্বাচনে হিমশিম খেতে হয়। দলের ভেতরের 'বিদ্রোহ' দমন করা যায় না। আওয়ামী লীগই আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ, এমনকি কোথাও কোথাও শত্রুতে পরিণত হয়েছে। আগামী ২০-২১ ডিসেম্বরের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ কতোটুকু শুদ্ধ এবং ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।
ধরে নেওয়া যায় দেশের দ্বিতীয় বড়ো রাজনৈতিক দল হলো বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি। তবে অনেকেই হয়তো বিএনপিকেই সবচেয়ে বড়ো দল বলে মনে করেন। তাদের কথা, বড়ো বিএনপিকে আওয়ামী লীগ সরকার চাপে ও তাপে ছোটো করে রেখেছে। বিএনপির জন্য সরকার পরিবেশ প্রতিকূল করে রেখেছে। অনুকূল জল-হাওয়া পেলে ম্রিয়মাণ বিএনপি দ্রুত ফুলেফেঁপে উঠবে। বিএনপি এখন নানাবিধ সংকটে জর্জরিত। দলের প্রধান দুই নেতা– চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে বিএনপির এখন বেহাল দশা। নেতৃত্বের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাসের সংকট প্রবল। দলের শীর্ষ নেতাদের কে কার অনুসারী তা নিয়ে আছে সন্দেহ ও বিতর্ক। শীর্ষ নেতারা তারেক রহমানকে মানতে না চাইলেও বিএনপিতে তারেকের অনুসারীই বেশি। খালেদা জিয়ার বয়স হয়েছে, তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ। বিএনপি নেতারাই বলছেন, তিনি স্বাভাবিকভাবে হাঁটাচলাও করতে পারেন না। এই অবস্থায় তিনি কারাগার থেকে মুক্তি পেলেও দলকে গতিশীল রাখার মতো 'গতি' বা চলৎশক্তি তার নিজেরই থাকবে না। সেক্ষেত্রে বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে গেলে তারেক রহমানের বিকল্প নেই। আবার বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকতে তারেক দেশে ফিরে রাজনীতি করতে পারবেন বলেও মনে হয় না। তাছাড়া তারেকের ইমেজ এতোটাই নেতিবাচক যে বিএনপির বিদেশি মিত্ররাও তাকে নিয়ে স্বস্তি বোধ করে না।
আওয়ামী ক্ষমতায় থাকার যে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে তাতে বিএনপি নেতাদের অনেকেই সুড়ঙ্গের শেষে কোনো আলোর রেখা দেখতে পাচ্ছেন না। তাই কেউ দল ছাড়ছেন, কেউ অবসর গ্রহণ করছেন। কেউ নতুন কোনো নিরাপদ ঠিকানা খু্ঁজছেন। আওয়ামী লীগ জায়গা দিলে সেখানে যাওয়ার পরিকল্পনাও কারো কারো আছে। বিএনপি এখন কার নেতৃত্বে, কার নির্দেশে চলছে সেটা সবার কাছে স্পষ্ট না হলেও এটা স্পষ্ট যে, বিএনপির দুঃসময় সংক্ষিপ্ত হওয়ার কোনো লক্ষণ কোথাও নেই।
বিএনপির পরই সম্ভবত জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান। জামায়াত গত কয়েক বছর ধরেই খারাপ সময় অতিক্রম করছে। জামায়াতের কয়েকজন শীর্ষ নেতা মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত হয়ে ফাঁসিতে ঝুলেছেন। নির্বাচন কমিশন জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করেছে। সরকার জামায়াতকে প্রশ্রয় না দিলেও জামায়াত খুব খারাপ অবস্থায় নেই। বিএনপির কাছ থেকে জামায়াত সব সময় আনুকূল্য পেয়েছে। এখন চরম খারাপ সময়েও ভালো অবস্থায় আছে জামায়াত। বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষীরা দলটিকে জামায়াত ছাড়ার পরামর্শ দিলেও দলের নীতিনির্ধারকরা তাতে সায় না দেওয়ায় বিএনপি-জামায়াতের মৈত্রী বন্ধন ছিন্ন হচ্ছে না।
জামায়াতের এককভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের শক্তি বা অবস্থা কতো দিনে হবে– এই প্রশ্নের উত্তর কোনো রাজনৈতিক জ্যোতিষী দিতে পারবেন না। তবে জামায়াত যে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি হাইফেন হয়ে থাকার সক্ষমতা অর্জন করেছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। জামায়াতকে আগে যেমন একশিলা দল মনে করা হতো, এখন তা নেই। জামায়াতেও মতভিন্নতার খবর এখন পাওয়া যায়। জামায়াত একটি রাজনৈতিক শক্তি। তার একটি সংগঠিত এবং অত্যন্ত নিষ্ঠাবান কর্মী বাহিনী আছে। এরা অনেক অঘটন ঘটন পটিয়সি। জামায়াতের শক্তিসামর্থ বাড়িয়ে কিংবা কমিয়ে দেখানোর কিছু নেই। জামায়াত প্রকাশ্যে না থেকেও আছে। জামায়াত কখনো নিষ্ক্রিয় থাকে না।
জাতীয় পার্টিও এক সময় ক্ষমতার দল ছিল। কিন্তু এখন এই দল আছে বহুবিধ সংকটে। দলের নেতৃত্ব নিয়ে আছে অনৈক্য। এই দলের প্রতিষ্ঠাতা হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ নিজেই দলের ভবিষ্যৎ শেষ করে গেছেন। এখন জাপার রাজনীতি নির্ভর করছে আওয়ামী লীগের ওপর। আওয়ামী লীগ যেভাবে চাইবে জাতীয় পার্টির রাজনীতি সেভাবেই চলবে। এরমধ্যে এরশাদের পারিবারিক বিরোধও গিয়ে ধাক্কা দিচ্ছে জাতীয় পার্টির গায়ে। এই দলটি আগে বহুবার ভেঙেছে। আরেক দফা ভাঙনের প্রস্তুতি নীরবেই চলছে বলে মনে হয়। পুত্র এরিকের অধিকারের সঙ্গে সঙ্গে জাতীয় পার্টির মালিকানার দাবিও করবে কিনা সেটাও দ্রুতই স্পষ্ট হবে।
দেশের আরো বেশ কয়েকটি ছোটো দলও ভাঙছে। ভাঙছে বা ভেঙেছে বিএনপির মিত্র বা জোটে থাকা একাধিক দল। আবার আওয়ামী লীগের মিত্রদের ঘরেও ভাঙনের তাপ। ভাঙছে আ স ম আব্দুর রবের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল বা জেএসডি। সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক রতন এবং রব আর একসঙ্গে থাকতে পারছেন না। কয়েক দিনের মধ্যে বিভক্তি চূড়ান্ত হবে।
এক সময়ের বিএনপি নেতা কর্নেল (অব) অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি বা এলডিপি'ও ভেঙেছে। আব্দুল করিম আব্বাসীকে আহ্বায়ক এবং শাহাদত হোসেন সেলিমকে সদস্য সচিব করে এলডিপির আলাদা কমিটি গঠন করা হয়েছে। অলি অবশ্য দাবি করেছেন, তিনিই আসল এলডিপি। বারো বছর ধরে তিনি দলের প্রধান হিসেবে আছেন। তার পরিচয়েই এলডিপি পরিচিত।
মেজর জেনারেল (অব) ইব্রাহীমের কল্যাণ পার্টিও এক থাকতে পারছে না। কল্যাণ পার্টির মহাসচিব এম আনিসুর রহমান দল থেকে পদত্যাগ করে নতুন কিছু করার কথা হয়তো ভাবছেন।
১৪-দলীয় জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টিও ভাঙছে। রাশেদ খান মেননের প্রতি অনাস্থা এনে দলের কয়েকজন নেতা পৃথক কংগ্রেস করছেন। মেননের বিরুদ্ধে নানা ধরনের অভিযোগ। রাজনৈতিক নীতি-কৌশল নিয়ে যেমন ভিন্নমত আছে, তেমনি মেননের ব্যক্তিগত সততাও হয়েছে প্রশ্নবিদ্ধ। ক্যাসিনো-কাণ্ডের সঙ্গে মেননের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় ওয়ার্কার্স পার্টিও দলগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
১৪-দলের একটি ছোটো শরিক গণতন্ত্রী পার্টি। এই পার্টিতেও দেখা দিয়েছে সংকট। দলের সাধারণ সম্পাদক ডা. শাহাদাত হোসেনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। এখন ডা. শাহাদাত কি অন্যদের বহিষ্কার করে একাই গণতন্ত্রী পার্টির একাংশের মালিক হবেন। মানুষ জমির মালিকানা সহজে ছাড়তে চায় না। সামান্য একটি জমির জন্যও মানুষ লাঠালাঠি করে, রক্তারক্তি ঘটায়। এখন দেখা যাচ্ছে রাজনৈতিক দলের মালিকানাও কম লোভনীয় নয়? আহা, কী মধু এই রাজনীতিতে?
এই যে ছোটো দলগুলো আরো ছোটো হয়ে দেশে রাজনৈতিক দলের সংখ্যা বাড়াচ্ছে, তাতে কার কী লাভ হচ্ছে? দেশের রাজনীতিতে কি এতে করে সুস্থতা ফিরে আসবে? কী আশায় এই ছোটো দলের নেতারা রাজনীতি করছেন? দলাদলি করছেন? ভাঙাগড়ার খেলায় শরিক হচ্ছেন? তাদের তো সরাসরি ক্ষমতায় যাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। তারা কি বড় দলের সঙ্গে থেকে উচ্ছিষ্টভোগী হওয়ার জন্যই রাজনীতি করছেন? ছোটো দলগুলোর ভাঙনের শব্দ শুনে একটি পুরনো বাংলা গানের কথা মনে পড়ছে।
নীড় ছোটো ক্ষতি নেই, আকাশ তো বড়ো
হে মন বলাকা মোর অজানার আহ্বানে
চঞ্চল পাখা মেলে ধরো।