Published : 03 Feb 2020, 07:36 PM
ছোটবেলায় একটা কথা খুব শুনতাম। কথাটি হচ্ছে 'হুজুগে বাঙালি আর হেকমতে চীন'। এই প্রবচনের সার কথা হলো বাঙালি অতি আবেগপ্রবণ আর চীনারা জ্ঞানে ও কর্মদক্ষতায় অনন্য। কথাটি যে কতখানি সত্যি তা বুঝেছি চীন দেশে গিয়ে। চীনারা জাতিগতভাবেই অত্যন্ত পরিশ্রমী ও কর্মকুশল। আর চীনের প্রশাসনও অত্যন্ত গতিশীল। বিশেষ করে কোন সংকটকালে তারা সময় নষ্ট করে না একেবারেই।
করোনা ভাইরাসের বিপদকালে সেকথা আরও বেশি করে প্রমাণিত হচ্ছে। করোনা ভাইরাস মোকাবেলায় চীন যেভাবে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে তাতে এই জাতির প্রতি শ্রদ্ধা না জন্মে উপায় নেই। করোনা ভাইরাসে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহর। এই সংক্রামক ব্যধি যেন অন্য অঞ্চলে না ছড়াতে পারে সেজন্য তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় সকল প্রকার জনসমাগমের স্থান, গণপরিবহণ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, আদালত সবকিছু।
এই সময়টায় চীনের সবচেয়ে বড় উৎসবের সময়। চায়নিজ নিউ ইয়ার বা চীনের বসন্ত উৎসব হলো এমন এক সময় যখন সারা চীনে চলাচল সবচেয়ে বেশি বেড়ে যায়। কারণ দেশে বিদেশে কর্মরত চীনারা এ সময় যার যার পরিবারের কাছে ফিরে আসে। এরা একসঙ্গে উৎসব পালন করে পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ সদস্যের সঙ্গে। এই সময়ে ট্যুরিজম ব্যবসাও থাকে তুঙ্গে। অথচ করোনাভাইরাস ঠেকাতে সকল প্রকার মাইগ্রেশন বা চলাচল তাৎক্ষণিক বন্ধ করে দেওয়া হয় যা কোনভাবেই মুখের কথা নয়। এজন্য চীনের অর্থনীতিকে চাপের মুখে পড়তে হয়েছে। প্রচুর আর্থিক ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু গণস্বাস্থ্যকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এই আর্থিক ক্ষতিকে স্বীকার করতে চীন সরকার পিছপা হয়নি। তদুপরি করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে।
করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে আক্রান্ত এলাকায়। সারাদেশেই প্রতিটি হাসপাতাল ও চিকিত্সা কেন্দ্রে চিকিত্সকরা ছুটি বাতিল করে সর্বশক্তিতে জনগণকে সেবা দিচ্ছেন। নিজেরা এই রোগে মৃত্যুবরণ করতে পারেন জেনেও কোন স্বাস্থ্যকর্মীই দায়িত্ব পালনে বিন্দুমাত্র অবহেলা করছেন না। দেশপ্রেম ও দায়িত্ববোধ প্রবল না হলে এটি সম্ভব হতো না। এরই মধ্যে উহান শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে কিছুটা দূরে সংক্রামক ব্যধি করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ হাসপাতাল বানিয়ে ফেলা হয়েছে। কারণ সংক্রামক ব্যধি চিকিৎসার জন্য বিশেষ ধরণের হাসপাতাল জরুরি। এই বিশেষ হাসপাতালটি নির্মাণ করে চালু করা হয়েছে মাত্র দশ দিনের মাথায়। ২৩ জানুয়ারি শুরু করে ১ ফেব্রুয়ারি নির্মাণ শেষ করে হাসপাতাল চালু করে দেওয়া হয়। হাসপাতালের নকশা করতে লেগেছে পাঁচ ঘণ্টা। ড্রাফট চূড়ান্ত করতে লেগেছে চব্বিশ ঘণ্টা। ভাবা যায়? এক হাজার শয্যাবিশিষ্ট এই হাসপাতালটিতে চীনা সশস্ত্র বাহিনীর একহাজার ৪০০ মেডিকেল কর্মী কাজ করছেন।এ ধরনের একটি হাসপাতাল বানাতে যে কোন দেশের অন্তত পক্ষে দুই বছর সময় লাগার কথা। এর আগেও ২০০৩ সালে যখন সার্স ভাইরাস জনগণের প্রাণ হরণে নেমেছিল তখন এক সপ্তাহের মধ্যে বেইজিংয়ে এই ধরনের একটি হাসপাতাল চালু করা হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগানো হয়েছে এবার উহানের সংকট মোকাবেলায়।
করোনা ভাইরাসে আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য উহানে আরেকটি হাসপাতালও নির্মাণ করা হচ্ছে। যার কাজ শেষ হচ্ছে ৫ ফেব্রুয়ারি।
করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে চীনের এই কার্যক্রম প্রশংসা কুড়িয়েছে আন্তর্জাতিক মহলেরও। এরই মধ্যে চীনের বিজ্ঞানীরা এই ভাইরাসের জিনকোড বের করে ফেলেছেন। পরীক্ষামূলক পর্যায়ে প্রতিষেধকও বের হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনা ভাইরাসজনিত পরিস্থিতিকে বিশ্বস্বাস্থ্যের জন্য জরুরি অবস্থা বলে ঘোষণা করেছেন। চীনের বাইরেও অনেকগুলো দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ছে। যদি বাংলাদেশে এই ভাইরাস আক্রমণ করে তাহলে তার মোকাবেলায় আমরা কি প্রস্তুত? চীনাদের খাদ্যাভ্যাসের গুষ্ঠি উদ্ধার আর আল্লাহর গজব পড়ছে বা পড়বে জাতীয় গুজব না ছড়িয়ে আমরা কি যে কোন সংকটে নিজেদের প্রস্তুত করাটা শিখতে পারি না? হুজুগে বাঙালি আর কতকাল হুজুগে মাতবে? আমাদেরও কর্মকুশলতা আর বাস্তবজ্ঞান বাড়ানোর সময় এসেছে বৈকি।
ডেঙ্গুজ্বরের সময় দেখা গেছে মশা দমন করতে গিয়েই আমাদের নমরুদের চেয়েও হাবুডুবু অবস্থা হয়েছে। ঝাড়ু হাতে নিয়ে চিত্রতারকাদের সঙ্গে ফটো তুলে প্রচুর ঠাট্টা তামাশাও দেখতে হয়েছে দেশবাসীকে। সুযোগ বুঝে মশার কয়েলের দাম বাড়িয়ে প্রচুর অন্যায়-মুনাফাও করেছে ব্যবসায়ীরা। ডেঙ্গুতেই যদি এই হাল হয় তাহলে ঢাকার মতো একটি জনবহুল শহরে করোনা ভাইরাস ছড়ালে যে অবস্থা হতে পারে (আল্লাহ না করুন) সেটা নিয়ন্ত্রণ করার মতো সামর্থ্য ও প্রস্তুতি কি আমাদের আছে?
সম্ভবপরের জন্য প্রস্তুত থাকাটাই সভ্যতা। বর্বরতা পৃথিবীর সকল বিষয়েই অপ্রস্তুত। এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের অনেক কিছু শেখার আছে প্রতিবেশি চীনের কাছ থেকে।
করোনাসহ যে কোন ভাইরাস প্রতিরোধে মাস্কের ব্যবহার বৃদ্ধি, হাতধোয়া, প্রকাশ্যে হাঁচি, কাশি ও থুতু না ফেলা ইত্যাদি সিভিক সেন্স অর্জনের এখনই সময়। জনস্বাস্থ্যের দিকে সরকারকে আরও যত্নশীল হতে হবে, চিকিৎসাসেবার মান বৃদ্ধি করতে হবে, চিকিৎসাসেবা সকলের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে হবে। শুধু ঢাকা শহরে নয়, বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের দরিদ্রতম মানুষটিও যেন সঠিক চিকিৎসাসেবা পান একজনও যেন বিনা চিকিত্সা ও অপচিকিত্সায় প্রাণত্যাগ না করেন সেটা নিশ্চিত করা চাই। সরকারের দায়িত্ব তো আছেই। সেইসঙ্গে ব্যক্তিগত দায়ও এড়ানোর উপায় নেই। সচেতনতা ও ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার বিকল্প কিছুই নেই। বিশ্বস্বাস্থ্যের এই সংকটকালে আমরা নিজেরা যেন সুস্থ থাকতে পারি এবং প্রতিবেশি দেশগুলোর প্রতি সব রকম সমর্থন ও সহযোগিতা দিতে পারি সেটাই জাতি হিসেবে আমাদের সুবিবেচনা ও সভ্যতার পরিমাপক।