Published : 11 Jun 2025, 07:53 PM
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত শাহজাদপুর কাছারিবাড়িতে ঘটে যাওয়া হামলা ও ভাঙচুরকে নিছক একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখবার সুযোগ নেই। এটি আমাদের সমাজের সামগ্রিক অবক্ষয়ের এক প্রতীকী বহিঃপ্রকাশ।
বলা হচ্ছে, একজন দর্শনার্থীকে আটকে রেখে মারধরের অভিযোগে যে উত্তেজনার শুরু, তা বিস্ফোরিত হলো ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটির দরজা-জানালায়, মিলনায়তনের কাঠামোয় এবং রবীন্দ্র-স্মৃতির নিঃশব্দ গর্ভগৃহে।
ঘটনাটি অপরিকল্পিত—এমনটা মেনে নেওয়া কঠিন, যখন একের পর এক মব দেখেছি আমরা। ৮ জুন থেকে ১০ জুনের মধ্যে যে দূরত্ব রয়েছে এবং তাতে একটা মবের জন্ম দেওয়া খুবই সহজ।
ঈদুল আজহার পরদিন ৮ জুন বিকেলে শাহনেওয়াজ নামের এক দর্শনার্থী স্ত্রী ও ভাতিজাকে নিয়ে রবীন্দ্র কাছারিবাড়ি ঘুরতে যান। তিনি প্রবেশ মূল্য দিয়ে টিকিট কিনেন। মোটরসাইকেল পার্কিংয়ের জন্যও তার কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়। কিনো কোনো টোকেন দেয়নি টিকিটবিক্রেতারা, এমনটাই শাহজাদপুর থানায় দায়ের করা অভিযোগে শাহনেওয়াজ লিখেছেন।
শাহনেওয়াজের অভিযোগ, কাছারিবাড়ি পরিদর্শন শেষে বের হওয়ার সময় তার কাছে মোটরসাইকেল রাখার টিকিট দেখতে চান মেইন গেইটে দায়িত্বপ্রাপ্ত এক কর্মচারী। টিকিট দেখাতে ব্যর্থ হওয়ায় শাহনেওয়াজের সঙ্গে ওই কর্মচারীর কথা কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে হাতাহাতির ঘটনাও ঘটে।
পরে কাস্টোডিয়ানসহ কাছারিবাড়ির অন্য কর্মচারীরা মিলে শাহনেওয়াজকে ধরে নিয়ে গিয়ে অফিসের মধ্যে আটকে রেখে শারীরিক নির্যাতন চালান। খবর পেয়ে শাহনেওয়াজের অভিভাবকরা স্থানীয় বিএনপি নেতাদের নিয়ে তাকে উদ্ধার করেন। এই ঘটনায় শাহনেওয়াজ ওই দিন রাতেই শাহজাদপুর থানায় লিখিত অভিযোগ দেন। এর মাঝে একদিন কেটে যায়, ১০ জুন শাহনেওয়াজকে আটকে রাখার প্রতিবাদে প্রথমে শাহজাদপুর প্রেসক্লাবের সামনে একটি মানববন্ধন করা হয় এবং সেখান থেকেই একটি মব গিয়ে হামলা করে কাছারিবাড়িতে।
শাহজাদপুরের সাধারণ মানুষও এই বাড়িটির গুরুত্ব বুঝে বলে ধারণা করা যায়। ধরে নিলাম, তারা বুঝতে না পেরে হামলার পরিকল্পনা করেছে, তাহলেও তো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রশ্নবিদ্ধ হয়। পুলিশ কেন আগে থেকে বুঝতে পারেনি এমন একটি ঘটনা ঘটতে পারে। আদতে একের পর এক মবকে প্ররোচনা দিয়ে যাওয়ার পরিণতি এটি। সম্প্রতি বহুবার বলা হয়েছে, এনাফ ইজ এনাফ—মব কালচার বরদাস্ত করা হবে না। কিন্তু কাছারিবাড়ি ভাঙচুর প্রমাণ করে, আমরা আসলে মবকে তোষণ করি। ভয় পাই। অনেক সময় উসকেও দিই। এই সংস্কৃতি আজ এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, যেখানে রাস্তায় জনসমক্ষে লাঞ্ছিত হয় নারীরা, শিশু ধর্ষণ বিচারহীন থাকে আর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়ে ওঠে ‘আবেগ প্রকাশের’ উপায়।
তর্কের খাতিরে যদি মেনে নিই, কাচারিবাড়িতে হামলাও তেমন আবেগ প্রকাশেরই একটি ঘটনা এবং অপরিকল্পিতভাবে কতিপয় ব্যক্তি এটি ঘটিয়ে ফেলেছে। তবু প্রশ্ন থাকে—এই ঘটনা না ঘটালেই কি চলত না? এমনিতেই সমাজে অস্থিরতা, সেখানে একদল মানুষ অশান্তির জন্ম দেয়, আরেকদল তা সমর্থন করে। এই বাস্তবতায় আমাদের এমন একটি হামলার চিত্র দেখতে হলো কেন? যে হামলায় আক্রান্ত হলো রবীন্দ্রস্মৃতিবিজড়িত নিদর্শন। রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে বিতর্কের জন্ম, তার সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকারের অবমূল্যায়ন এবং তার প্রতি প্রকাশ্য শত্রুতা এক ভয়াবহ প্রবণতার ইঙ্গিত দেয়।
পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা হয়েছে। বাংলা ভাষার অধিকার আদায়ের জন্য যেমন আন্দোলন সংগ্রাম করতে হয়েছে তখন, তেমনি রবীন্দ্রনাথকে পাঠ করার জন্য, রবীন্দ্রনাথের গান গাইবার জন্যও আন্দোলন করতে হয়েছে। তখন রবীন্দ্রনাথের নাম উচ্চারণ করাটা ছিল রাজনৈতিক অপরাধ। তবুও বাঙালির প্রবল সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের মুখে সেই নিষেধাজ্ঞা টেকেনি। কারণ বাঙালি বুঝতে পেরেছিল ‘রবীন্দ্রনাথকে বাদ দিয়ে বাঙালির আত্মপরিচয় অসম্ভব।’
কিন্তু আজ, স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পার করে আসা বাংলাদেশেই রবীন্দ্রনাথ কি আর নিরাপদ? সেই প্রশ্ন উঠছে বারবার। বর্তমানে রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে ঘটে চলেছে নানা ধরণের বিতর্ক ও আক্রমণ—যার প্রতিটি যেন আমাদের সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের একেকটি স্তর উন্মোচন করছে। কখনও তার কবিতা বাদ দেওয়া হয় পাঠ্যপুস্তক থেকে, কখনও জাতীয় সংগীত গাইতে না দেওয়া, কখনও আবার জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের পরামর্শ দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটানো হচ্ছে। বলাবাহুল্য, রবীন্দ্রনাথ বিপদের মধ্যেই আছেন। কিছুদিন পরপর জাতীয় সংগীত নিয়ে কুতর্কে মনে হয়, যেন তিনি নিজেই বলে গিয়েছিলেন—‘আমার গান যদি জাতীয় সংগীত না হয়, আমি কষ্ট পাব।’
প্রশ্ন হলো, স্বাধীন বাংলাদেশেরই বা কী অর্জন, যদি এই দেশে রবীন্দ্রনাথের মতো একজন সর্বজনস্বীকৃত মনীষীকেও সম্মান দিতে না পারি আমরা? এ কি শুধুই কিছু উচ্ছৃঙ্খল জনতার অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড? নাকি এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘদিন ধরে তৈরি হওয়া এক সুপরিকল্পিত সাংস্কৃতিক উচ্ছেদ প্রকল্প। বিশেষ করে যখন তরুণ প্রজন্মকে রবীন্দ্রবিরোধী নানা গুজব আর বিকৃত তথ্য খাইয়ে দেওয়া হয়—যেমন, তিনি নাকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন, তিনি নাকি মুসলমানদের ঘৃণা করতেন—তখন বোঝা যায়, এটি নিছক ভুল তথ্য নয়, একটি সাংস্কৃতিক বিভ্রান্তি তৈরির শাণিত হাতিয়ার।
তবে এখানেই শেষ নয়। আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাও এই প্রবণতা রুখতে কার্যকর অবস্থান নেয় না। তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করা মানে আমাদের নিজেদেরকে নিজেদেরই আঘাত হানার সামিল। তাকে মুছে ফেলা মানে আমাদের ইতিহাস, সাহিত্য ও আত্মপরিচয়ের মেরুদণ্ডটিকেই ভাঙার চেষ্টা।
যখন আপনি লোহা পিটাতে পিটাতে তার মেরুদণ্ড দুর্বল করে দেবেন, তখন দুর্বল মানুষও তা বেঁকিয়ে ফেলতে পারবে । বাঁকিয়ে বিকৃত আনন্দ লাভ করবে । শাহজাদপুরের কাছারিবাড়িতে রবীন্দ্রনাথের চৌদ্দ পুরুষের কেউ আর থাকেন না । এটি তাদের জমিদারি আমলের নিদর্শন। ইতিহাস বলছে, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরের একটি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় পুরাকীর্তি হচ্ছে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শাহজাদপুরের কাছাবাড়ি। এটি রবীন্দ্রনাথের পৈতৃক জমিদারি তত্ত্বাবধানের কাছারি ছিল। তারও পূর্বে অষ্টাদশ শতাব্দীতে এটি ছিল নীলকরদের কুঠি। সে কারণেই এখনও অনেকে একে কুঠিবাড়ি বলে। পরে রবীন্দ্রনাথের দাদা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর এটি নিলামে কিনে নেন। এখানে রয়েছে জমিদারির খাজনা আদায়ের কাছারির একটি ধ্বংসাবশেষ, একটি বেশ বড় দ্বিতল ভবন। বর্তমানে এখানে নির্মিত হয়েছে একটি আধুনিক মিলনায়তন। দ্বিতল ভবনটি বর্তমানে রবীন্দ্র জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং আঙ্গিনার বিস্তৃত জায়গা জুড়ে তৈরি করা হয়েছে সুদৃশ্য একটি ফুলবাগান। রবীন্দ্রনাথ পিতার আদেশে ঊনত্রিশ বছর বয়সে ১৮৯০ সালে জমিদারি তত্ত্বাবধানের জন্য প্রথম পূর্ববঙ্গে আসেন, শাহজদাপুর ও শিলাইদহে ছিল তার নিয়মিত যাতায়াত। রবীন্দ্রনাথ এখানকার প্রকৃতি ও মানুষের বিচিত্র জীবন প্রবাহের সৌন্দর্য দেখে অভিভূত হন। এই সময়কালে তিনি লিখেছেন অসাধারণ সব ছোটগল্প। এখানে রচিত হয়েছে ‘পোস্টমাস্টার’, ‘ছুটি’, ‘দেনাপাওনা’-র মতো কালজয়ী গল্প। জমিদারির তদারক করতে এসে এই বাংলার মানুষ, প্রকৃতি ও জীবনঘনিষ্ঠ সাহিত্যকে নতুন আঙ্গিকে অনুভব করেছিলেন, ‘ছিন্নপত্রে’র পত্রাবলি লিখেছেন। তাই স্থানগুলো কেবল ইট-পাথরের স্মৃতিচিহ্ন নয়।
এটা কেবল একটি বাড়ির ওপর আক্রমণ নয়—এটা আমাদের আত্মপরিচয়ের বিরুদ্ধে কুঠারাঘাত। আজ কাছারিবাড়ি হামলা ঘটতে দিয়েছি, কাল হযতো শিলাইদহে ঘটতে দেব। এই ধারাবাহিকতা থামবে না যদি আমরা মুখ বন্ধ করে থাকি। রবীন্দ্রনাথ হয়তো এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না—তার মহত্ত্ব আমাদের ইতরতার ঊর্ধ্বে। ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি আমরা—আমাদের বিবেক, আত্মমর্যাদা ও ইতিহাসের প্রতি দায়বদ্ধতা প্রতিনিয়ত ধূলিস্যাৎ হচ্ছে।
রবীন্দ্রনাথ নিঃসন্দেহে বড় কবি এবং একজন দার্শনিকও। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি’ । শাহজাদপুরের ঘটনায় প্রমাণিত হয়েছে আমরা পতাকা পেলেও তা বহন করতে পারছি না। এই ঘটনার প্রতিবিধান প্রয়োজন—কেবল আইনি নয়, নৈতিক এবং সাংস্কৃতিকও। একে অপরাধ হিসেবে দেখলেই হবে না, দেখতে হবে এটি কিসের প্রতীক, কীসের আগাম সংকেত। যদি আমরা আজ না জাগি, কাল ইতিহাস আমাদের আর জায়গা দেবে না।