Published : 25 Apr 2020, 08:46 PM
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত পৃথিবীতে 'নেই' এর পাল্লা শুধু ভারী হচ্ছে। ভ্যাকসিন নেই, সুনির্দিষ্ট প্রতিষেধক নেই, ভেন্টিলেটর নেই, পিপিই নেই, ল্যাব টেস্টিং ফ্যাসিলিটি নেই, টেস্ট রিএজেন্ট বা কিট নেই। তবে কি লড়াইয়ের ময়দান ছেড়ে পালাবে মানুষ? তাও অতিক্ষুদ্র এক ভাইরাসের কাছে পরাজয় মেনে নিয়ে? নাকি যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধটা চালিয়ে যেতে হবে? আসলেই তাই । বিশেষ করে করোনাভাইরাসের ল্যাব টেস্টিং এর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা বর্তমানে এপর্যায়েই এসে দাঁড়িয়েছে। জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে সার্স-কোভি-২ ভাইরাসের জিনোম সিকোয়েন্স জানার পর থেকেই, আরটি পিসিআর টেস্ট করে রোগীর শ্বাসতন্ত্রীয় নমুনায় ভাইরাসের আরএনএ শনাক্ত করার মাধ্যমে আক্রান্ত রোগীকে চিহ্নিত করা হচ্ছে, ও ভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করার জন্য রোগীকে আইসোলেশনে বা কোয়ারেন্টিনে পাঠানো হচ্ছে । কাজেই সংক্রমণের মাত্রা যতই বাড়ছে, আরটি পিসিআর কিট ও রিএজেন্টের চাহিদা বেড়েই চলছে ।
প্রতিদিন লাখ লাখ আরটি পিসিআর করা হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে। এমনকি বিত্তবান দেশগুলোও আরটি পিসিআর এর জন্য অত্যাবশ্যক সামগ্রী, আরএনএ এক্সট্রাকশন কিট ও পিসিআর কিটের ভয়াবহ সংকটের মুখে। এসব রিএজেন্ট যেসব দেশে তৈরি হয় সেসব দেশ নিজেদের চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাচ্ছে । তাই সেসব উপাদানের রপ্তানি ব্যাহত হচ্ছে। করোনাভাইরাস টেস্ট করার ক্ষেত্রে তাই এখন প্রথাগত চিন্তাভাবনার বাইরে গিয়ে বিকল্প চিন্তা করার সময় এসেছে । এনিয়ে আমাদের কিছু অভিজ্ঞতা তুলে ধরছি ।
কাতারে আমাদের হাসপাতাল ৪০০ বেডের একটি মহিলা ও শিশু হাসপাতাল । এ হাসপাতালে প্যাথলজি বিভাগের অধীনে, আমাদের ল্যাব, একটি স্পেশালাইজড মলিকুলার ইনফেকসাস ডিজিজ ল্যাব । অর্থাৎ আমাদের ল্যাবে নিয়মিত ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাসের ডিএনএ বা আরএনএ শনাক্ত করা হয় । কোভিড-১৯ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হবার পর থেকেই আমরা এ ভাইরাস শনাক্তকারী আরটি পিসিআর টেস্ট এর প্রস্তুতি নিতে শুরু করি এবং ফেব্রুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে আমাদের হাসপাতালের স্টাফ ও রোগীদের স্ক্রিনিং করা শুরু করি। এর পর থেকেই টেস্টের চাহিদা উত্তরোত্তর বাড়ার মুখে, এবং টেস্ট কিট বিশেষ করে আরএনএ এক্সট্রাকশন কিট ফুরিয়ে যাবার আশংকায় বিকল্প খুঁজতে থাকি। বিকল্প চিন্তার ক্ষেত্রে যে কয়েকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ তা হলো-
ক. বিকল্প টেস্টের উপাদানগুলো আমাদের হাতেই আছে কিনা বা তা স্থানীয়ভাবেই জোগাড় করা যাবে কিনা? এবং তার পরিমান টেস্টের চাহিদা মেটানোর মতো কিনা?
খ. বিকল্প টেস্ট করতে গিয়ে টেস্টের গুণাগুণ প্রভাবিত হবে কিনা? খুব দ্রুত টেস্টের বাস্তবায়ন সম্ভব কিনা?
আমাদের সবার অক্লান্ত চেষ্টায়, ইতিমধ্যে দুটো বিকল্প পদ্ধতি বের করতে সক্ষম হয়েছি, যার একটি আমরা হাসপাতালের রিসার্চ ডিপার্টমেন্ট এর সাথে যৌথভাবে করেছি। দেখুন- (https://www.medrxiv.org/content/10.1101/2020.04.08.20055731v1)
এ পদ্ধতিতে টেস্ট করতে গিয়ে আমরা এমন সব উপাদান, যন্ত্রপাতি ও কার্যপ্রণালী ব্যবহার করেছি যা সচরাচর ভাইরাসের আরএনএ এক্সট্রাকশন এ ব্যবহার করা হয়না । কিন্তু সায়েন্টিফিক প্রিন্সিপলের উপর ভিত্তি করে, কার্যপ্রণালীর কিছু পরিবর্তন আনার মাধ্যমে আমরা পদ্ধতিটিকে ভাইরাসের আরএনএ এক্সট্রাকশন এর উপযোগী করে তুলেছি এবং করোনাভাইরাস এর আরটি পিসিআর করার জন্য ভ্যালিডেট করেছি । ইতিমধ্যে আমরা তিন হাজারের উপরে টেস্ট করে ফেলেছি এ পদ্ধতিতে ।
এর পাশাপাশি আমরা আরেকটি পদ্ধতি বের করেছি যা তুলনামূলকভাবে আরও সহজ এবং বাংলাদেশের জন্য প্রয়োগযোগ্য। দেখুন: (https://www.medrxiv.org/content/10.1101/2020.04.18.20070755v1) ।
সেই পদ্ধতিতে আরএনএ এক্সট্রাকশন না করেই সরাসরি স্যাম্পলকে প্রসেস করে আরটি পিসিআর করা যায় কিনা তা বিভিন্নভাবে পরীক্ষা করে দেখেছি । লক্ষ্য করেছি স্যাম্পলকে ডাইলুশন করে ৬৫ ডিগ্রি-তে ১০ মিনিট ইঙ্কিউবেট করে শুধু একটা বিশেষ আরটি পিসিআর রিএজেন্ট ব্যবহার করে ভালো ফল পাওয়া যাচ্ছে । তাই এপদ্ধতিটাকে নির্বাচন করে ১৩২ জন রোগীর নেসোফেরিঞ্জিয়াল সোয়াব নিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হলো। যেহেতু এসব স্যাম্পল আগে আরএনএ এক্সট্রাকশন করে আরটি পিসিআর করা হয়েছে তাই সেসব ফলাফলের সাথে তুলনা করে দেখা গেল এ পদ্ধতিতে শতকরা ৯৮ ভাগের উপরে সঠিক ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে ।
করোনাভাইরাসের আরটি পিসিআর এর ক্ষেত্রে মূল খরচ হলো আরএনএ এক্সট্রাকশনে। কাজেই আমাদের নতুন এই সরাসরি পদ্ধতিতে টেস্ট এর খরচ কমে যাবে শতকরা প্রায় ৭৫ ভাগ। তার মানে হলো ন্যুনতম ৩-৪ ডলার বা ৩০০ – ৪০০ টাকার মধ্যে আরটি পিসিআর টেস্টের খরচ কুলিয়ে যাবার কথা! আবার এপদ্ধতিতে টেস্টের সময়ও কমে যাবে প্রায় এক থেকে দুই ঘণ্টা। তবে টেস্ট করার সময় নিজের নিরাপত্তার কথা বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। ল্যাবে কাজ করার সময়ে যাতে কেউ আক্রান্ত না হয় তা নিশ্চিত করতে বায়োসেফটি হুডের ভিতরে পুরো প্রসেসটা সম্পন্ন করতে হবে ।
আমাদের দেশে যারা এখন করোনাভাইরাসের আরটি পিসিআর টেস্ট করছেন বা নতুন করে করার পরিকল্পনা করছেন তাদের জন্য এ পদ্ধতি বিশেষ কাজে লাগতে পারে। বিশেষ করে যদি পরিস্থিতি যদি এমন হয় যে আরএনএ এক্সট্রাকশন কিট এর অভাবে টেস্ট বন্ধ করে দিতে হচ্ছে সে সময়, অথবা এখন যে পরিমাণ টেস্ট করছেন তার সংখ্যা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিতে চান সেসময়। শুধু এ পদ্ধতিই নয় ভাইরাসের মলিকুলার ডায়াগনোসিস করার আরো অনেক সম্ভাব্য পথ রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন আইইডিসিআর এর তত্বাবধায়নে ক্লিনিকাল মাইক্রোবায়োলোজিস্ট বা ক্লিনিকাল ভাইরোলজিস্ট, বায়োকেমিস্ট, মলিকুলার বায়োলজিস্ট, চিকিৎসক ও অন্যান্য স্বাস্থসেবা প্রদানকারীদের সমন্বিত উদ্যোগ ।
এছাড়াও বাংলাদেশে অনেক মেধাবী গবেষক ও বিজ্ঞানী রয়েছেন যারা এসব ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রাখতে পারেন । প্রথাগত চিন্তার বাইরে গিয়ে, নিজেদের উদ্ভাবনী শক্তি কাজে লাগিয়ে আইডিয়া ডেভেলপ করা ও তার সক্রিয় বাস্তবায়ন করার মাধ্যমে নিজেদের রিসোর্স ব্যবহার করেই অনেক কিছু করা সম্ভব ।