Published : 13 May 2020, 08:19 PM
নতুন করোনাভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করছে বিশ্ব। বাংলাদেশও তার বাইরে নয়। আক্রান্তের সংখ্যা ও মৃতের সংখ্যা কেবল বেড়েই চলেছে। দেশে চলছে 'লকডাউন'। মানুষ বাঁচার জন্য লড়াই করছে। এমন দুর্যোগেও পড়াশোনা নিয়ে ইঁদুর দৌঁড়ে নেমেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। না সব প্রতিষ্ঠান বললে ভুল হবে, এই দৌঁড়ে কেবল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। আরও নির্দিষ্ট করে যদি বলি, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। পর্দার পেছনের গল্পটা টাকাকে ঘিরে। তা আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই।
অনলাইনে শিক্ষাকার্যক্রম নিয়ে আমার আপত্তি নেই। বিকল্প আমাদের ভাবতেই হবে। কারণ এই 'মহামারী' সহসাই নির্মূল হওয়ার মতো নয়। কিন্তু এখনই কেন? এখন কি আছে শিক্ষা পরিবেশ? এমন এক পরিস্থিতি বিরাজ করছে যা আমাদের সবার জন্যই নতুন অভিজ্ঞতা। বদলে গেছে আমাদের জীবন-যাপনের ধরন। নতুন করে দেখছি নিজের দেশকে, বিশ্বকে। এরকম অবরুদ্ধ আগে কখনো থাকা হয়নি। হয়তো করোনাভাইরাস হয়নি, ভালো আছি৷ কিন্তু মানসিক অস্থিরতা যে নেই, তা কিন্তু অস্বীকার করতে পারব না। পশ্চিমা দেশগুলোতে শিক্ষার্থীদের কাউন্সেলিং করা হচ্ছে। এই মুহুর্তে শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন দরকার, এটা বুঝতে পেরেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। অথচ আমরা কেমন আছি তা যেন আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কাছে খুবই গৌণ।
সরকার ঘোষিত 'সাধারণ ছুটি' পেয়ে শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগই গ্রামের বাড়ি চলে গেছে। আমাদের দেশে ইন্টারনেট যে কী সেবা দেয় তা সবাই জানেন। ঢাকা থেকে দূরে কোথাও গেলে তা আমরা হারে হারে টের পাই। এমন অবস্থায় ক্লাসে যে ব্যাঘাত ঘটবে তা অবশ্যম্ভাবী। ক্লাসে ব্যাঘাতের কারণ শুধু দুর্বল ইন্টারনেট নয়। শিক্ষা সামগ্রী না থাকার কারণেও হচ্ছে। বই, খাতা, কলম, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র অনেক কিছুই শিক্ষার্থীরা সঙ্গে নেয়নি। নেবেই বা কেন! এ ছুটি যে এভাবে শুধু বেড়েই চলবে তা কেউই আন্দাজ করতে পারেনি। সবকিছুই হয়ত ব্যবস্থা করা যাবে। তবে প্রস্তুতি ছাড়া হঠাৎ বিজ্ঞপ্তিতে এমন নতুন পদ্ধতির ক্লাস কতটা সুফল বয়ে আনবে সেটাও কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো বিষয় না।
আর্থিক বিষয়টা সবচেয়ে বড়। রোজ দেড় ঘণ্টা করে দুইটা ক্লাস হলেও, মোট তিন ঘণ্টার ভিডিও কনফারেন্স খরচও কিন্তু কম নয়। ঢাকার বাইরে এখনো ওয়াইফাই সহজলভ্য হয়নি, মেগাবাইট কিনেই ইন্টারনেট ব্যবহার করা হয় বেশি। ইন্টারনেটের এই খরচটা শিক্ষার্থীরা জোগাবে কীভাবে? একজন শিক্ষার্থীরও যদি এই টাকা জোগাড় করতে সমস্যা হয় তাহলে অবশ্যই এটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হবে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) বলেছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো 'চাপ না দিয়ে' আদায় করতে পারবে সেমিস্টার ফি। এটা কতটুকু মানা হবে তা দুশ্চিন্তা আছে সবার। নানা কৌশলে দিতে বাধ্য করা হবে বলেই আশঙ্কা করছে শিক্ষার্থীরা। আমার ছোট বোন ঢাকার একটি বেসরকারি কলেজে পড়ছে। বিকাশে বেতন পাঠাতে নানাভাবে চাপ দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। নির্দিষ্ট কোনো সময় বেধে দেয়নি ঠিকই কিন্তু নিয়ম করে প্রতিদিনই বলা হচ্ছে কে কবে টাকা পাঠাবে, কে কে দাওনি নামগুলো বলো, কার কী সমস্যা আমাদের সাথে শেয়ার করো। ভরা ক্লাসে সবার সামনে সবাইকেই লজ্জায় ফেলা হচ্ছে। এভাবে নানাভাবে পরোক্ষ চাপ তৈরি করা হচ্ছে। এরকমটা যে হবে না তার নিশ্চয়তা কি? ইতোমধ্যে নতুন সেমিস্টারের কার্যক্রম শুরুর বিজ্ঞপ্তিও প্রকাশ করেছে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়। একটা পক্ষ বলছে- টাকার সমস্যা হলে আগামী সেমিস্টারটা ড্রপ দিতে, তাহলেই সব সমস্যা মিটে যাবে। কিন্তু ড্রপ দিবেই বা কেন? টাকা না থাকা মানুষগুলো কি দেশে করোনাভাইরাস নিয়ে এসেছে? তাদের অপরাধটা কোথায়?
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়ারা সবাই কোটিপতি, এমন একটা কথা বাজারে আছে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আরও সিট বাড়ালে নিশ্চয় ১০৫টা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন পড়ত না। অনেক শিক্ষার্থী টিউশন করিয়ে নিজের সেমিস্টার ফি পরিশোধ করে, কেউ করে খণ্ডকালীন চাকরি। গেল দুইমাসে এসব কিছুই করা সম্ভব হয়নি। আয় রোজগারের খাতা একদম ফাঁকা। করোনাভাইরাসের জন্য তো কারো বাড়িতেই ঢুকতে দেওয়া হয়নি, টিউশন করাবে কীভাবে! অনেকে চাকরিও হারিয়েছে ইতোমধ্যে। অনেকের পক্ষে সম্ভবই না এই মুহূর্তে মা-বাবাকে চাপ দিয়ে টাকা আদায় করা। এই যে সামাজিক অস্থিরতা বিরাজ করছে, এই সময়টাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উচিত আপদকালীন শিক্ষা বীমা, আর্থিক প্রণোদনা, সহজ কিস্তি বা যেভাবেই হোক শিক্ষার্থীদের কোনো না কোনোভাবে সাহায্য করা, পাশে থাকা। উল্টো তারা আরও টাকা নেওয়ার জন্য নানা কৌশলী ভূমিকা পালন করছে। যেন শিক্ষার্থীরা এটিএম বুথ, চাপ দিলেই টাকা বের হবে।
সেমিস্টার ফি ছাড় দেওয়ার দাবি উঠেছে। শিক্ষার্থীরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একত্রিত হচ্ছে। সংগঠিত প্রতিবাদ জানাচ্ছে। শিক্ষার্থীদের পক্ষ থেকে আসা দাবিটা কোনোভাবেই অযৌক্তিক নয়। হ্যাঁ এটা মানি যে, একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ আছে অনেক। আমাদের টাকা দিয়েই প্রতিষ্ঠান চলে। শিক্ষক, কর্মচারীদের বেতন-ভাতা দিতে হয়। কিন্তু খরচ বেঁচে যাওয়ার খাতও আছে। প্রায় দুইমাস ধরে ক্যাম্পাসগুলো বন্ধ রয়েছে। এসি বন্ধ, লাইট বন্ধ, লিফট বন্ধ। ফলে প্রতিষ্ঠানের বিদ্যুত খরচ হচ্ছে না। খাওয়ার পানি, ব্যবহারের পানির খরচও লাগছে না। সুতরাং এখান থেকে টাকা বাঁচিয়ে সেমিস্টার ফি ছাড় দিতে পারে। আরেকটি পদ্ধতিও আছে, শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বাদে অন্যান্য খরচ আপাতত বন্ধ রাখা যায়। এই মুহূর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কাজ, নতুন ক্যাম্পাস বা শাখা তৈরির প্রয়োজন নেই। ইমার্জেন্সি নয় এমন খাতের খরচ বন্ধ করে টাকা বাঁচিয়ে শিক্ষার্থীদের সেমিস্টার ফি ছাড় দেওয়া সম্ভব। এই সদিচ্ছাটাই দেখা যাচ্ছে না।
শিক্ষা কোনো পণ্য নয়, বিক্রি করার জিনিস নয়। শিক্ষা মানুষকে মানবিক করে তোলার জন্য। যাদের কাছে শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে এটা অর্জনের জন্য, তারাই দিচ্ছে বিপদে আরও কঠোর হওয়ার শিক্ষা। কী শিখে দেশের হাল ধরবে নতুন প্রজন্ম?