Published : 26 Jun 2020, 08:05 PM
'আমি এখন মায়ার সাথে কথা বলতে যাচ্ছি। তুমিও চলো আমার সাথে।'
রিফ্লেক্সের টানে তার কণ্ঠ শুনেই সোফা থেকে তড়াক করে উঠে দাঁড়ালাম। হাতে খুলে রাখা ম্যাগাজিনে দৃষ্টি নিবদ্ধ থাকায় খেয়াল করিনি কখন তিনি ভেতর বাড়ি থেকে বসার ঘরে এসেছেন। তাকিয়ে দেখি বাইরে যাবার জন্য তৈরি হয়ে কাঁধের কালো ব্যাগটির মধ্যে কি যেন খোঁজার চেষ্টা করছেন। আগের দিন আমাকে ফোনে বলে দিয়েছিলেন আজ সকাল সাড়ে আটটার মধ্যে আসার জন্য। তাই রাতেই যাবতীয় সব আমার কাপড়ের ঝোলায় (তখন খুব ব্যবহার করতাম) ভরে রেখেছিলাম। সকালে আসাদ গেইট থেকে বাসে চেপে এলিফেন্ট রোড বাটার মোড়ে নেমেছি। এরপর তো অল্প পথ। প্লেনওলা মসজিদের কাছেই ঔষধ ঘরের গলির একদম শেষ মাথায়। উনার বাড়িতে যাবার সময় ওই গলির মাঝামাঝি নিশানদের বাসা। শহীদ চিকিৎসক আজহারুল হকের ছেলে। এখানে আসলেই হয় আগে বা পরে ওদের বাসায় আমার যাওয়া পড়ে। ওখানে যাতায়াতের অবারিত সুযোগ থাকায় সাংগঠনিক কাজ করতে আমার জন্য নিশানদের বাসাটা তখন সুবিধাজনক। সময় মতো কণিকায় পৌঁছে নিচ থেকে বেল বাজাবার পর মানিক ভাই যিনি এই বাড়ির কেয়ারটেকার হিসেবে আছেন – তিনি এসে যথারীতি দরজা খুলে দেবার পর থেকে বসার ঘরের সোফায় আমি একাই অপেক্ষা করছিলাম।
'আমার ছোট ডায়রিটা খুঁজছি। অপেক্ষা করো – আসছি।' দ্রুতপদে ভেতরে গেলেন। একটু পরেই ফিরলেন ডায়েরি হাতে। সোফায় বসতে বসতে বললেন, "আজকাল এত তালের মাঝে সব মনে থাকছে না। শোন, আমি বলছি – তোমার সামনের টেবিলে রাখা নোট প্যাডে টুকে নাও।" তিনি বলতে থাকলেন – আমি দ্রুত তা লিখতে থাকলাম।
"প্রথমে লেখ বাদলের (মুক্তিযোদ্ধা বাদল খান) নম্বর। ওর গাড়ীটা ব্যবহার করছি। একটু সমস্যা দিচ্ছে – তাই ওকে জানাবো। হ্যা, এখন লেখ শাহরিয়ার (শাহরিয়ার কবীর)-এর নম্বর।' আমি জানালাম যে আমার কাছে আছে। আমি লিখে নিচ্ছি। তখন উনি কাজী আরেফ আহমেদ, আহমদ শরীফ, সৈয়দ হাসান ইমামসহ আরও কয়েকজনের নম্বর বলে গেলেন– আমি লিখে নিলাম। লেখা শেষ হতেই বললেন, 'আমাকে দাও নম্বরগুলো'। হাতে দিতেই সাদা রঙয়ের ফোনের রিসিভার কানে তুলে বাদল খানকে ফোন করলেন। সাধারণত তিনি সরাসরি ডায়েরি থেকে নম্বর দেখে ফোন করেন। আজ তা না করায় নানা কারণে একটু বিক্ষিপ্ত আছেন বুঝতে পারছি। আমি ফোন করে দিতে চাইলে মাথা নেড়ে নাকচ করলেন। আমার পাশে বসেই নম্বর মিলিয়ে একজন একজন করে সবার কাছে ফোন করে কথা বলতে লাগলেন। পরে বললেন, 'কর্নেল জামানের নম্বর এখানে আছে – দেখো তো উনাকে ধরতে পারো কিনা। আজকাল বড্ড অবুঝের মত করছেন তিনি। আচ্ছা করে বকে দেব আজ।'
আমি শুনে তখন বেশ অপ্রস্তুত। তবু আদেশ মানতে হবে। ফোন করলাম কর্নেল নুরুজ্জামানকে। কোন কারণে তাকে পাওয়া না যাওয়ায় সে সময়ে আর কথা বলতে পারলেন না। তবে মনে আছে এর আগে একদিন তিনি সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদকে ফোন করে আমার সামনেই উষ্মা প্রকাশ করেছিলেন – আন্দোলনের জন্য প্রত্যাশিত সাড়া দিতে হুমায়ূন আহমেদের দিক থেকে কিছু ঘাটতি অনুভব করায়। দূরালাপনের এক পর্যায়ে তিনি শব্দ করে ফোনটি রেখে দিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন যা এখনো মনে আছে।
এমন এক জরুরি আন্দোলনের সমন্বয় করার কাজটি যে কত দুরূহ তা খুব কাছ থেকে দেখার দুর্ভাগ্য বা সৌভাগ্য হয়েছে আমার। আশাদায়ী অনেক আবহ বিরাজ করলেও তাকে হাজারো ঝঞ্ঝাট ও অনভিপ্রেত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে, সামাল দিতে হয়েছে। মুখে ক্যান্সার নিয়ে ভয়ানক অস্বস্তির মধ্যেও তিনি তার কর্মকাণ্ড চালিয়ে গেছেন এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে। এই আন্দোলনের একেবারে কেন্দ্রে যেহেতু জাহানারা ইমাম – আর তার বাসায় থেকে সহায়তা করার দায়িত্ব পাবার কারণে এই আন্দোলনকে ঘিরে দেশের-দেশের বাইরের নানা বিষয়ের অনেক কিছুই জানার সুযোগ পেয়েছি। আর তার কাছে আস্থাবান থাকার কারণে তিনিও অকপটে অনেক কথাই আমাদেরকে (যাদেরকে তিনি আস্থার মধ্যে নিতেন) বলতেন।
কর্নেল জামানকে ফোনে না পাওয়ায় বললেন, 'ঠিক আছে– আমি উনাকে পরে ফোন করে নেব। চলো এবার।' পর মূহুর্তেই বললেন, 'মানিক তোমাকে চা-নাস্তা দিয়েছে?' আমি 'না, লাগবে না' বলতেই তিনি আবারো ভেতরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ পরে ট্রে হাতে করে ঘরে ঢুকলেন। হাফ প্লেটে একটি প্রাণহরা ও একটি কালোজাম– সাথে এক গ্লাস ঠাণ্ডা কোক (এই খাবারটি এ বাসায় আন্দোলনের সময় খুব কমন ছিল)। জাহানারা ইমামের এই প্রাণময় আতিথ্যের সাথে আমার ইতোমধ্যে পরিচয় হয়ে গেছে এই আন্দোলনের কাজ করতে এসে– তাই আমি জানি এই খাবার না খেয়ে রওনা দিলে তিনি আমাকে সাথে নেবেন না। বাসায় আম্মার তৈরি করা নাস্তা রুটি-আলু ভাজি খেয়ে এসেছিলাম যা এই সময়ে্র মধ্যে হজমও হয়ে গেছে। তাই দ্রুত খেয়ে বললাম, 'দাদী, আমি প্রস্তুত।' বেরুবার ঠিক আগে মায়া ভাইকে (মুক্তিযোদ্ধা মোফাজ্জল হোসেন চোধুরী মায়া) ফোন দিয়ে বললেন যে একটু পরেই পৌঁছে যাবেন। সে যেন সময় মত থাকে।
নিচে এসে দাঁড়াতেই ড্রাইভার সাহেব কমলা রঙয়ের ভক্সওয়াগনের দরজা খুলে দিয়ে জাহানারা ইমামকে ওঠাতে সহযোগিতা করলেন। আমি অন্য পাশের দরজা দিয়ে উঠলাম। তিনি ড্রাইভারকে বললেন- সোজা ইঞ্জিনিয়ারস ইন্সটিটিউটে চলে যাও। আমরা পৌঁছে গেলাম, কিন্তু মায়া ভাই তখনো সেখানে এসে পৌঁছাননি। সেল ফোন তখনো বাংলাদেশে চালু হয়নি। ইন্টারনেট, সোশাল মিডিয়া বলে যে সাইবার ওয়ার্ল্ড রয়েছে তাও আমাদের মত দেশের মানুষের জানা ছিল না। তাই রাস্তা থেকে মায়া ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করার কোন সুযোগ নেই বিধায় আমরা গাড়ির মধ্যে বসে থাকলাম। এই সুযোগে আমি উনার নির্দেশে আমাদের করা নিউজ পেপার কাটিং-এর ফাইল তার ছোট ছেলের (সাইফ ইমাম জামী) সহায়তা নিয়ে মাইক্রো ফিল্ম করার উদ্যোগ নিতে পেরেছেন কিনা জানতে চাইলাম। আমাদের মত তরুণদের এসব বিষয়ে ঔৎসুক্য জাহানারা ইমামকে খুব অনুপ্রাণিত করতো। তাই তিনি খুব গুরুত্ব দিয়ে আমার এই জানতে চাইবার বিপরীতে কবে আবার মিশিগান যাচ্ছেন এবং উনার এ বিষয়ে কিছু পরিকল্পনার কথাও শেয়ার করলেন। এই আলাপের সময়ে আমাদের ড্রাইভার সাহেব গাড়ির বাইরে থাকাতেই হয়তো তিনি খোলামেলাভাবে উনার কথা বললেন। আলাপ পুরো শেষ হবার আগেই এলেন মায়া ভাই। আমরা গাড়ী থেকে নামলাম। পরের দিন এখানে জাতীয় সমন্বয় কমিটির গণ সমাবেশ হবে। মায়া ভাই বললেন কী ভাবা হচ্ছে মঞ্চের বিষয়ে। হাসান আরিফ, কামাল পাশা চৌধুরীসহ আরো কয়েকজনের নাম বললেন যারা মঞ্চের বিষয়ে সহযোগিতা করছেন তাকে। বেশি আলাপ ছিল না– জাহানারা ইমাম রওনা হবার আগে কণ্ঠ নিচু করে মায়া ভাইকে বললেন, 'মানুষ আসা চাই। এই আন্দোলনের মূল শক্তি তারা। তোমাদের সবাইকে বলে দিও।'
বাস্তবতা এই যে, এর মধ্যে খালেদা জিয়ার সরকার ও পুলিশ বাহিনী এই আন্দোলনের বিপক্ষে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। মদদ দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামী ও তাদের সহযোগিদের। সরকারের কঠোর নীতি এবং জামাত-শিবির-ফ্রিডম পার্টির প্রকাশ্যে নানা হুমকি-ধমকির বিপরীতে কেউ কেউ ভীত হয়ে নিষ্ক্রিয় থাকার চেষ্টা করছেন।
গণ আদালত কর্মসূচি বাস্তবায়নের সূচনা পর্ব থেকেই জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা এবং অন্যান্য মুক্তিযুদ্ধ পক্ষের রাজনৈতিক দলের নেতৃবর্গ গোলাম আজম ইস্যুতে একাট্টা হয়েছেন। পাশাপাশি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, প্রজন্ম '৭১, মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র কমান্ডসহ নানা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এক কাতারে এসে সমবেত হয়েছে কিন্তু জনবলের প্রশ্নে স্বাভাবিকভাবেই আওয়ামী লীগের উপরে নির্ভরতা সবচেয়ে বেশি।
এই বাস্তবতার মধ্যে আওয়ামী লীগকে কোনঠাসা করতে আবার জাতীয় সমন্বয় কমিটির নানা কেন্দ্রিয় নেতা এবং সংগঠন তৎপর রয়েছেন দেখে গণ সমাবেশে মানুষের উপস্থিতি নিয়ে জাহানারা ইমামকে স্বাভাবিক কারণেই খুব অস্থির থাকতে হয়। শুরু থেকে বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা এই আন্দোলনে জনবলের বিষয়ে সহায়তা করে এসেছেন। আওয়ামী বিরোধী নানা লবির তৎপরতার কারণে শেখ হাসিনা নিজের দলীয় লোকের রাশ টেনে ধরতে বাধ্য হন। পরে আবার জাহানারা ইমাম, শাহরিয়ার কবীর, সৈয়দ হাসান ইমাম, আব্দুল মান্নান চৌধুরীসহ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব উদ্যোগ নিলে আবার জনবলের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ জোরদারভাবে মাঠে থাকে।
আমরা ফিরে আসার সময় জাতীয় সমন্বয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরীর সাথে সংক্ষিপ্ত আলাপ করবেন বিধায় জাহানারা ইমাম গাড়ি চালককে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হয়ে যেতে বললেন। সেখান থেকে আবার কণিকায় ফিরে আসলাম আমরা। আগামীকালের সমাবেশের বিষয়ে সন্ধ্যায় এখানে মিটিং আছে। আমাকে বললেন – 'আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি। এরপর লাঞ্চ করে তোমার ছুটি আজ। তোমাদের সংগঠনের কাজও তো করতে হবে তোমাকে। কাল সবাইকে আসতে বলে দিও।'
একটি দিনের কয়েক ঘণ্টার বিচ্ছিন্ন স্মৃতি জড় করেছি মাত্র। পুরো আন্দোলন জুড়ে নিরবচ্ছিন্ন নানা চ্যালেঞ্জ, যন্ত্রণা, অনভিপ্রেত পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়েছে তাকে। এমন কি ভেতরের খুব আস্থাভাজন মানুষও হঠাৎ 'কিবলা' পরিবর্তন করে শত্রু শিবিরের স্বার্থরক্ষা করতে সক্রিয় হয়েছে। ভয়ানক প্রতিকূল প্রশাসনের নানা চাপের পাশাপাশি ভেতরকার এই সকল বিড়ম্বনা-যন্ত্রণার পাহাড় ঠেলে এগিয়েছেন একজন জাহানারা ইমাম। হার মানেননি – এগিয়ে গেছেন দৃঢ়পদে। সেই এগিয়ে যাবার কালে তার পাশে একদিন প্রতিদিন থাকার সৌভাগ্য হয়েছে। স্মৃতির ঝুলি থেকে আমার জীবনের অমূল্য সঞ্চয় সেইসব দিনের কাহিনী দুই মলাটে নিয়ে আসার স্বপ্ন লালন করি সর্বদা।
আজ তার ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাই।