Published : 04 Aug 2020, 08:27 PM
আইটি সার্ভিস ম্যানেজমেন্টে (আইটিএসএম) যারা কাজ করেন তাদের সিসটেমের (যেমন- সার্ভার অথবা অ্যাপ্লিকেশন) বিনা নোটিশে ঘন ঘন কাজ না করার তড়িৎ সমাধান (কারেকটিভ অ্যাকশন) নিশ্চিতের পর বসতে হয় চিরস্থায়ী সমাধানের (প্রিভেন্টিভ অ্যাকশন) জন্য। তড়িৎ সমাধানের (এবং কখনও কখনও জোড়াতালি সমাধানও) পরও বার বার একই দুর্ঘটনা (রিপিটেড ইনসিডেন্ট) ঘটে চললে আইটি সার্ভিস ম্যানেজমেন্টে একে সমস্যা (প্রবলেম) বলে চিহ্নিত করা হয়। তারপর উপসর্গের গভীরে অনুসন্ধান করতে হয়; এসময় জোড়াতালি সমাধানগুলোও ধরা পড়ে যায়। এসবের উদ্দেশ্য আসলে সমস্যার মূল কারণ খুঁজে (রুট কজ অ্যানালাইসিস) দেখা। তারপরই আসে চিরস্থায়ী সমাধানের প্রস্তাবনা এবং এখানে কোন কাজটি কার দায়িত্বে নিষ্পন্ন হবে তাও অনুমোদন করা হয়।
এই মৌসুমে ভাইরাসের ভয় ছাপিয়ে নদীর ভাঙ্গন আর বন্যা হচ্ছে বার বার ফিরে আসা এক উপসর্গ; অর্থাৎ 'রিপিটেড ইনসিডেন্ট' অর্থাৎ 'প্রবলেম'। আইটি নিয়ে আর কথা নয়; বরং এই সমস্যা ও এর মূল কারণে কতটুকু মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে সেদিকেই পাল তুলবো।
মহামারীর কারণে দেশে দু-তিন মাসের লকডাউন চললেও ওই সময় নদীতে দুর্বৃত্তায়ন থেমে থাকেনি। গত মে মাসের মাঝামাঝিতে অবৈধ বালু উত্তোলন চলমান থাকার বিষয়টি নজরে এনে বর্ষায় নদী ভাঙ্গনে এর প্রভাব পড়বে বলে আগাম সতর্ক করেছিলেন নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার; বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের এক প্রতিবেদনে এসেছিল সেসব কথা (লকডাউনে 'প্রকৃতির মেরামত' ঘিরে নতুন শুরুর আশা)। ওই আগাম পূর্বাভাস চরম সত্যি হয়েই দেখা দিল চলতি বর্ষায়।
ঘন ঘোর বর্ষায় বৃষ্টি আর ঢলে ডাউন স্ট্রিমে থাকা বাংলাদেশে এখন একাধিক জেলার নদীতে অবিরাম ভাঙ্গন আর বন্যা। স্থানীয় অনেক নদীতে পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আর পদ্মার ভাঙ্গন নিয়ে তটস্ত রয়েছে জনপদ।
২০১৮ সালে শরীয়তপুরের নড়িয়াতে পদ্মার ভাঙ্গন নাড়িয়ে দিয়েছিল দেশবাসীকে। ২০১৭ সালেও শরীয়তপুরে পদ্মায় ভাঙ্গন ধরেছিল। এবারও ভাঙ্গন ও পানি বাড়তে থাকায় এই অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ বেকায়দায়।
প্রতিবার ভাঙ্গন আর বন্যায় বড় মানবিক আর আর্থ-সামাজিক বিপর্যয় ঘটে। যার ঘর ভাঙ্গে তার সব রাগ উথলে ওঠে নদীর উপরই। এ অভিমান সুরে সুরে ভেসে বেড়ায়; সর্বনাশা পদ্মা নদী, তোর কাছে সুধাই, বল আমাকে তোর কি রে আর কূল কিনারা নাই…?
কবি আল মাহমুদের 'চোখ যখন অতীতাশ্রয়ী হয়' কবিতায় প্রতিদিন ভাঙ্গন দেখা এক কিশোরের ভাষ্যে কবি প্রকারান্তরে দিয়েছেন নদীর আগ্রাসী পরিচয়; "আমি যখন ছোটো, আমাদের গ্রাম ছিল এক উদ্দাম নদীর আক্রোশের কাছে।"
পরিচিত একজন শিক্ষক ও নদীকর্মীকে একবার দেখেছিলাম, স্থানীয় নদীর ভাঙ্গন নিয়ে প্রশাসনের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে; যে ব্যানারে হাতে তারা দাঁড়িয়েছিলেন, সেখানে লেখা ছিল নদীর 'করাল গ্রাস' থেকে তাদের রক্ষার আর্জি।
বেশ কয়েকটি টিভি চ্যানেল আর পত্রিকার খবরেও দেখে-শুনে-পড়ে আসছি নদীর উদ্দেশে এমন সম্বোধন। পদ্মার বুঝি সর্বনাশা তকমা থেকে আর মুক্তি জুটবে না; তবে দেশের সব নদীকেই আসলে সর্বনাশা আর সর্বগ্রাসী সম্বোধনে শিরোনাম করা হয় কম-বেশি। ভাঙ্গনে গ্রাম-ভবন ধসে বিলীন হলে মানুষের দুর্দশাকে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে শিরোনাম হয় নদী গিলে নিল এসব কিছু।
নদী কেন ভাঙ্গনের মুখে প্রতিবার?
'এ কূল ভাঙ্গে, ও কূল গড়ে, এই তো নদীর খেলা'; নদীর ভাঙ্গা-গড়া খুব প্রাকৃতিক এক ঘটনা তা কবি বুঝেছিলেন। আমাদেরও বুঝতে হবে।
কিন্তু আমাদের নদীগুলোর এই ভাঙ্গন চিত্র কি পুরোটাই প্রাকৃতিক না কি এই ভাঙ্গনে মানুষেরই হাত রয়েছে?
২০১০ সালে বালুমহাল আইন হয়েছে। এই ১০ বছরেও অবৈধ বালু উত্তোলন কোনোভাবেই ঠেকানো যায়নি; বরং উন্নয়ন কর্মকাণ্ড বাড়তে থাকায় নদীতে বছর বছর বাড়ছে বালু তোলার অবৈধ মহোৎসব।
বিশ্বের বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বলছেন, নিয়ম না মেনে বালু উত্তোলনে পরিবেশের ক্ষতি হয়। সেই সঙ্গে নষ্ট হয় নদীর অবকাঠামো। আর এসবের প্রভাব পড়ে জীববৈচিত্র্যেও।
জলবিশেষজ্ঞ বা হাইড্রোলজিস্ট, মরফোলজিস্ট, সয়েল সায়েন্টিস্টদের এসব নিয়ে গবেষণা আছে। কিন্তু সেসব কি উঠে আসছে সংবাদে? টকশোতে? প্রশাসনের চোখে? নাগরিকদের কানে?
বাঁধ দিয়ে যে সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে, তা স্থানীয়দের চাহিদা মেটাতে নিতান্তই কারেকটিভ অ্যাকশন। নদীর গতি, প্রবাহ, অবকাঠামো বুঝে ব্যবস্থা না নিলে ক্ষতিই বাড়বে দিনকে দিন; বাড়ছেও।
বাংলাদেশে জমিয়ে নদী আন্দোলন হয় শুকনা মৌসুমে। তাহলে নদী আন্দোলনটা কি নদীকে বুঝে হচ্ছে? যদি হত, তবে এই বেনোজলের তোড়ে নদীর পাড় ভাঙ্গার দিনেই নদী বাঁচাও আন্দোলনটা দেখা যেত।
নদী বাঁচলেই মানুষ বাঁচলে- কথাটার মর্মার্থ বুঝতে আমরা অনেক সময় নিচ্ছি; তবে অনেক ভাঙ্গনের পরও এখনও সময় পেরিয়ে যায়নি তা উপলব্ধি করার।
আমাদের প্রয়োজন নদী ভাঙ্গনের 'রুট কজ অ্যানালিসিস'। আমাদের প্রয়োজন নদী ভাঙ্গন রোধে নদীবান্ধব 'প্রিভেনটিভ অ্যাকশন'।