Published : 14 Jun 2025, 06:48 PM
পোশাক দেখে মানুষ বিচার অনেক আগে থেকেই হয়ে আসছে। শেখ সাদীর গল্প তো সবার জানা। সেই যে খুব সাধারণ ছেঁড়াখোড়া পোশাকে ওনাকে ভিখারি জ্ঞান করা হয়েছিল এক রাজ দরবারে, উনি খুব কষ্ট পেয়েছিলেন এতে। আপ্যায়ন তো দূরের কথা, স্বাভাবিক ব্যবহারও করা হয়নি তার সঙ্গে।
পরে শেখ সাদী ধনাঢ্য ব্যক্তিদের মতো পোশাক পরে গিয়েছিলেন সেই একই রাজার দরবারে। সেদিন খুব ভালো ব্যবহার ও আপ্যায়ন পেয়েছিলেন। খাবার-দাবার সব নিজে না খেয়ে পাঞ্জাবির পকেটে ঢোকাতে লাগলেন। অবাক হয়ে রাজা জানতে চাইলে শেখ সাদী সব খুলে বললেন। যুক্তি দিলেন পোশাক দেখেই যদি মানুষের বিচার হয় তবে এই খাবার পোশাকেরই প্রাপ্য।
দেখার চোখ সম্ভবত সহসা বদলায় না। এক সময়ে ঢাকা শহরের লোকাল বাসের ভেতরে লেখা থাকত–ব্যবহারে বংশের পরিচয়! ছয় সাত বছর আগে হিট হওয়া এক নাটকের নাম ছিল–‘পোশাকে বংশের পরিচয়’। পোশাক বিতর্ক আবার ফিরে এসেছে এবং এটার সূত্রপাত করেছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.)।
সেনাবাহিনীতে এবং বিজিবির প্রধান হিসেবে চাকরি করার সুবাদে তিনি নিজেও একদা পোশাকি মানুষ ছিলেন। গেল ১০ জুন তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপের সময় বিজিবিতে থাকাকালে কিভাবে জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করতেন, তা সবিস্তারে অবহিত করে বলেন, ‘মাদকের বিরুদ্ধে আপনারা লিখবেন। মানুষকে সচেতন করতে হবে। আমি বিজিবিতে দায়িত্বে থাকা অবস্থায় বলতাম—তুমি হয়তো একটা ফেনসিডিল পাচার করছ, ১০০ টাকা উপার্জন করছ। কিন্তু যখন তোমারই ছেলে বা আত্মীয় সেই ফেনসিডিল সেবন করবে, তখন বুঝবে তুমি কী ভুল করেছ।’
সবই ঠিক ছিল, বিপত্তি ঘটালেন মাদকাসক্তদের নিয়ে কথা বলতে গিয়ে। তার বক্তব্যটা হুবহু এমন—‘মেয়েরা দেখলাম, দেখেন—সুন্দর ড্রেস পরে আছে। অথচ এদের ম্যাক্সিমাম মাদকের সঙ্গে জড়িত।’ এর আগে ঢাকার লালমাটিয়ায় দুই নারীর সিগারেট খাওয়া নিয়ে যে কাণ্ড ঘটেছিল তখনও তিনি এমন একটা বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন, যা নারীদের ক্ষুব্ধ করেছিল।
লালমাটিয়ার ওই ঘটনার পর উপদেষ্টা মহোদয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ ও মানববন্ধন করেছিলেন নারীরা । তখন তারা এই উপদেষ্টার পদত্যাগও চেয়েছিলেন।
আসলে যে পুরুষ ও নারী মাদকাসক্তির চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়, কেমন থাকে তাদের পোশাক-আশাক? সুন্দর ফিটফাট নাকি ময়লা পোশাক পরেই তারা দিন গোজরান করেন? রাস্তাঘাটে যে নেশাখোরদের সঙ্গে প্রায়ই আমাদের দেখা হয়, তাদের পোশাকের কথা মনে করুন। যারা আরেকটু বেশি দেখেছেন, মাদকের সঙ্গে জড়িত–মাদক গ্রহণ ও বেচাকেনার সঙ্গে জড়িতদের চিনেন ভালোভাবে, তারা জানেন উপদেষ্টা মহোদয়ের বক্তব্য কতটা অসাড়।
জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী যে পরিপ্রেক্ষিতেই কথাটা বলে থাকুন না কেন, এটা মেয়েদের পোশাক নিয়ে কটাক্ষ করার সামিল। কাজেই এমন দুর্লভ সমাজবিজ্ঞানী বাংলাদেশে আর কবে জন্মেছেন, তা খুঁজে বের করতে অনেকেই গবেষণায় নেমে পড়েছেন দেখতে পাচ্ছি।
সত্যি এটি গবেষণারই বিষয়। কিন্তু তার এই তত্ত্ব সামাজিক মাধ্যমে যেভাবে নিন্দিত হচ্ছে, তাতে বোঝা যাচ্ছে মেয়েরা উপদেষ্টা মহোদয়ের ‘ফ্যাশনবিষয়ক গোয়েন্দাগিরি’ মানতে পারেননি। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীর আবিষ্কারের সরলীকরণ হয়ে বলা হচ্ছে—‘সুন্দর পোশাক’ পরা নারী মানেই ‘মাদকাসক্ত’। তিনি বোধ হয়, ঠিক এই রকম বলেননি, ধারণা করছি, তিনি বলেছেন অপরাধের সঙ্গে জড়িত মেয়েদের বেশির ভাগ মাদকের সঙ্গে জড়িত এবং তাদেরও বেশিরভাগ সুন্দর পোশাক পরে।
এত কিছু থাকতে মাদকের সঙ্গে জড়িত নারীদের পোশাকের দিকে কেন নজর গেল উপদেষ্টার। মাদকসেবন ও ব্যবসার সঙ্গে আদতে নারীদের যুক্ততা কতখানি? মাদক সেবনের জন্য কতজন নারী ভর্তি হয় মাদক নিরাময় কেন্দ্রে? বাস্তব পরিসংখ্যান কী বলে?
সমস্যাটা মূলত পুরুষ মাদকাসক্তদের নিয়ে। গ্রামে গাঁজা, ফেনসিডিল বা ঘরে তৈরি দেশি মদ; শহরে ইয়াবা ও আইসের প্রচলন আছে। আসক্তদের তালিকায় মেয়েরা নেই—এমনটা বলা যাবে না। কিন্তু যারা আছে, তারা কয়জন? ঢাকার বিভিন্ন রিহ্যাব কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ১০০ জন মাদক নিরাময়কেন্দ্রে ভর্তি রোগীর মধ্যে ৯২–৯৫ জনই পুরুষ। বাকিদের মধ্যে ৪–৭ জন নারী।
উদাহরণস্বরূপ, রাজধানীর মোহাম্মদপুরে অবস্থিত ‘প্রত্যাশা মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের ২০২৪ সালের হিসাব উল্লেখ করা যায়। এই তথ্য সরাসরি প্রত্যাশার কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়নি, অনলাইন থেকে পাওয়া। যাই হোক হিসাবটা হলো, প্রত্যাশায় ২০২৪ সালে সেবা নেওয়া ২,৫০০ রোগীর মধ্যে মাত্র ৬৩ জন ছিলেন নারী। ‘আপন’ নামের দীর্ঘদিনের একটি মাদক নিরাময় প্রতিষ্ঠান জানায়, তাদের নারী ইউনিটে বছরে গড়ে ২০–২৫ জন রোগী ভর্তি হয়, যেখানে পুরুষ ইউনিটে সংখ্যা প্রায় হাজার ছুঁই ছুঁই।
অনুমান করা যায় নারীদের মধ্যে মাদকাসক্তের সংখ্যা নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হওয়া রোগীর চেয়ে অনেক বেশি। অনেকেই নিরাময় কেন্দ্রে ভর্তি হন না—লজ্জা, সামাজিক কলঙ্ক বা নিরাপত্তার অভাবে। আবার গ্রামাঞ্চলে মাদকাসক্ত মেয়ের সংখ্যা এতই কম যে বেশিরভাগ রিহ্যাবে নারী ইউনিটের প্রয়োজনও পড়ে না। চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা, রংপুর ও দিনাজপুরের রিহ্যাব কেন্দ্রগুলোতে বছরজুড়ে একজনও নারী রোগী ভর্তি না হওয়ার উদাহরণ আছে। অথচ ছেলেদের বেলায় সেখানে জায়গা না পাওয়ার মতো পরিস্থিতিও হয়।
তাহলে প্রশ্ন হলো, উপদেষ্টা মহোদয় যাদের দেখে 'সুন্দর পোশাক' থেকে মাদকের সঙ্গে জড়িতদের ম্যাক্সিমাম সুন্দর পোশাক পরে বলে অনুমান করছেন, তারা আসলে কারা? এমনকি মাদকাসক্তি কারও থাকলে তার পোশাক সুন্দর থাকবে, এমন আশা করাটাই বরং বোকামি। আগেই বলেছি, রাস্তাঘাটে যাদের আমরা দেখি, তাদের পোশাকের জীর্ণদশার কথা বলে দেওয়া লাগবে না।
পরিবারে বা পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকা মাদকাসক্তদেরও দেখা যায় তারা শরীরের প্রতি যত্ন হারিয়ে ফেলেছে, পোশাক-আশাকে গাফিলতি করছে। চুল এলোমেলো, চোখ অন্যমনস্ক, কথাবার্তায় তালগোল হারিয়ে ফেলা—এসবই মাদকাসক্তির উপসর্গ। মাননীয় উপদেষ্টা আপনি যদি এসব বুঝে থাকেন, তাহলে মাদকাসক্ত চেনার ক্লাস নেবেন, পোশাকের বর্ণনাবিদ হবেন কেন?
আসলে মাদক নিয়ে আমাদের সমস্যা হচ্ছে—এটা একটা রাজনৈতিক ব্যবসা, যেটার নিয়ন্ত্রণে আছে সিন্ডিকেট এবং সিন্ডিকেট পরিচালনা করেন পুরুষরাই। নারীদের যে অল্পসংখ্যক যুক্ত আছেন মাদক ব্যবসায়, তারা থাকেন খুবই সাধারণ কাজে, যেমন ইয়াবা পরিবহনের জন্য নারী আটকের ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়।
ইয়াবা ধরা পড়ে, কিন্তু গডফাদার ধরা পড়ে না। বিদেশ থেকে আসে কন্টেইনারভর্তি মাদক, অথচ কাস্টমসে কেউ জানে না। গুলশান-বনানীর পার্টিতে খোশমেজাজে চলছে মাদকের মহোৎসব অথচ প্রশাসনের কেউ সেখানে যায় না। হঠাৎ যখন মাদক দমন অভিযানের কথা ওঠে, তখন টার্গেট হয় গার্মেন্টসের মেয়েরা, রিকশাচালক, পথশিশু, বা কোনো ‘ফ্যাশনেবল’ মধ্যবিত্ত পরিবারে ছেলেমেয়ে।
তবে উপদেষ্টা মহোদয়ের বক্তব্যে একটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে। মাননীয় উপদেষ্টা মনে করিয়ে দিয়েছেন যে একদা এই দেশে আওয়ামী লীগের আমল ছিল। সে সময়ে ওবায়দুল কাদের কিংবা হাছান মাহমুদরা এমন উল্টাপাল্টা কথার জন্য বিতর্কিত ছিলেন। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল কথায় নয়, কাজেকর্মে তার সরকারের শক্তি প্রদর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন। যদি অন্তর্বর্তী সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার মতো ঘটনাচক্রে শেখ হাসিনা সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এমন কিছু বলে ফেলতেন, তাহলে পথেঘাটে পুলিশ নেমে যেতে পারত। সুন্দর পোশাকের মেয়েরা মাদকের সঙ্গে জড়িত সন্দেহে পুলিশ অভিযানে নেমে পড়লে কেমন হতো ভাবতেই ভয় লাগছে।
তাই মাননীয় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার প্রতি প্রস্তাব থাকল, পরের বার এমন উদ্ভট তত্ত্ব প্রকাশের আগে একবার আয়নায় নিজেকে দেখে নেবেন—পাছে জামা বেশি সুন্দর না হয়ে যায়। ইউনূস সরকারের উপদেষ্টাসভার কার্যক্রমে পরষ্পরবিরোধী কিছু কার্যকলাপ দেখছি শুরু থেকে।
তারা সংস্কার চান কিন্তু নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা নিয়ে ইসলামী দলগুলো প্রকাশ্য জনসভায় বিষোদ্গার করার পর নীরব হয়ে যান। ওই সমাবেশে নারীদের কিছু কার্যক্রমের সমালোচনা করে তাদেরকে ‘বেশ্যা’ বলে সম্বোধন করা হয়। যেমনটা করেছিলেন শেখ হাসিনা কোটাবিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ‘রাজাকারের নাতি-পুতি’ বলে। প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা যখন নিজেদের রাজাকার বলে স্লোগান দিল, আমরা ব্যাজস্তুতি শুনতে পেলাম। ইসলামী দলগুলোর বেশ্যা ডাকার প্রতিবাদে নারীরা সংসদ ভবনের সামনে নারীর জন্য মৈত্রীযাত্রায় ‘চাইতে এলাম হিস্যা-হয়ে গেলাম বেশ্যা’ স্লোগান দেওয়ায় কোমড় বেঁধে নেমে পড়লাম নিন্দামন্দে। নারীরা বারবার মবের শিকার হচ্ছে, এই সব মব থামাবার দায়িত্ব যার, তিনিই দেখছি মব উসকের দেওয়ার মতো কথা বলছেন।
ইউনূস সরকারের উপদেষ্টাসভায় যে নারীরা আছেন, তাদেরকে এতকাল আমরা নারী অধিকার কর্মী বলেও জেনে এসেছি। তাই খুব জানতে ইচ্ছে, নারীর প্রশ্নে এমন কট্টরপন্থী একজন সহকর্মীর সঙ্গে বৈঠকে বসতে তাদের অস্বস্তি হয় কিনা?