Published : 01 Jan 2021, 06:26 PM
সিডনিতে আমরা দুইটি দেশ বাদ দিয়ে বাংলাদেশসহ সবদেশের আগে 'বিষময়-২০২০' সালকে বিদায় জানিয়েছি। বরণ করেছি দুই হাজার একুশকে। 'বরণ' শব্দটি ব্যবহার করা এখন বিপজ্জনক। কারণ আমাদের ঘাড়ের ওপর বসে আছে সে নিরব ঘাতক। আমি যখন লিখছি তখন প্রায় 'নির্মূল বলে আনন্দিত' সিডনিতে আবার বেড়েছে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ বেড়েছে।
আমাদের জীবন আবার সীমাবদ্ধ ও সীমিত হয়ে উঠছে। নববর্ষে সিডনির আলোকসজ্জা সারা পৃথিবীর আকর্ষণ। দেশ ও দেশের বাইরে সিডনির এক বিপুল আয়ের উৎস। প্রতিবছর হাজার হাজার পর্যটক আসার পাশাপাশি অভ্যন্তরীণ ও ডিজিটাল ব্যবসায়ে জমজমাট এবারের আয়োজন ছিল নিষ্প্রাণ। দেখে মনে হচ্ছিল, কোথাও যেন শোকের হু হু হাওয়া বইছে। এ যাবৎ পৃথিবীতে যত মহামারী এসেছে তার মধ্যে করোনাভাইরাস নি:সন্দেহে এরইমধ্যে বিশ্বে এই রোগে আট কোটির বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যু হয়েছে সাড়ে ১৮ লাখের বেশি মানুষের।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভাইরাস থেকে যেসব রোগ মহামারী আকারে ছড়ায় সেগুলো বিভিন্ন কারণে এক সময় দুর্বল হয়ে পড়ে। তবে করোনাভাইরাস দুর্বল হয়েছে এমন কোনো প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশসহ দুনিয়ার সব দেশে এর সংক্রমণ চলছে। কিন্তু আমি বলবো অপ্রস্তুত মানব সভ্যতা এই অদৃশ্য মহামারীকে সামাল দিয়েছে, দিতে পেরেছে। যেসব দেশে নেতৃত্ব সবল এবং প্রাজ্ঞ তারা মৃত্যুর হার কমিয়ে রাখতে পেরেছে। উল্টোদিকে শক্তিধর মোড়ল নামে পরিচিত আমেরিকার অবস্থা কাহিল। সে দেশে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যুর পরও বিদায়ী প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তা মানতে নারাজ ছিলেন। মূলত তার গোয়ার্তুমি আর জেদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র পারেনি সামাল দিতে। তাদের রাষ্ট্র ও সরকার ব্যবস্থা ফেডারেল। তাই বহু রাজ্যের সরকারপ্রধানরা পরিস্থিতি নিজ দায়িত্বে সামাল দিয়েছেন, দিতে পেরেছেন। আমাদের বেলায় এমন হলে কি হতে পারতো ভাবলেও লোম খাঁড়া হয়ে যায়!
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আন্তরিকতা আর নেতৃত্বের গুণে বাংলাদেশ সামাল দিয়েছে ভালোভাবে। কিন্তু গত বছর যা আমাদের বিস্মিত ও হতবাক করেছে তা হলো মানুষের অসততা। কিছু মানুষের অসততা আর লুটপাটের খায়েশ প্রমান করেছে আমরা এখনো মানুষ হতে পারিনি। শাহেদ নামের যে নব্য আওয়ামী লীগার কে পরে বন্দি করা হলো সে কি একা? না এখনো দলে সে সব লোকজন নাই? কোভিড-১৯ প্যানডেমিক যতোটা আতংক আর ভয় জাগিয়েছে তারচেয়ে কোনও অংশে ভয় জাগায়নি লুটেরার দল এবং লুটপাট।
দেশ থেকে এতো হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট হবার ঘটনা আগে ঘটেনি। একটা বিষয় মনে রাখার মতো- সরকারের তিনবারের মেয়াদে যতো আয়-উন্নতির সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে দুর্নীতি। বেড়েছে 'পাওয়ার' এর অপব্যবহার। সামাজিকভাবে এতো অধোপতন সত্যি ভয়াবহ। বছরজুড়ে ছিল ধর্ষণ আর নারী নির্যাতনের ঘটনা। একজন নারী ইউএনও-কে হাতুড়ি পেটা করার মতো সাংঘাতিক ঘটনা দেখেছে জাতি। দেখেছে মৌলবাদের বিস্তার। আপনি কি মনে করেন এসব ঘাতক বা ব্যাধি করোনাভাইরাসের চাইতে কম কিছু?
একদিন মহামারী নিয়ন্ত্রণে আসবে, আসতে বাধ্য। ২০২১ এ সবচাইতে ভালো খবর হলো করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিন মোটামুটি নাগালের ভেতর চলে এসেছে। আমরা আশা করি, এবছর থেকেই পিছু হটবে করোনা। আগে বাড়বে মানুষ। আবার ফিরে আসবে সুস্থ-স্বাভাবিক জীবন।
এ সত্য মেনে নিয়েই ভাবুন কী হবে মৌলবাদের? তারা কি দমে যাবে, না দমে থাকবে? তাদের বর্তমান চেহারাটা কেমন? এটা বলার দরকার পড়ে না কতোটা সাহস আর স্পর্ধা পেলে তারা বঙ্গবন্ধু কন্যার নিরঙ্কুশ শাসনামলে তার পিতা আমাদের জাতির জনকের ভাস্কর্যে হাত দেয়। মাইক্রোফোনের সামনে নেতারা যাই বলুন না কেন, আমরা দেখেছি ধৃত ব্যক্তিদের পরিচয়েও আছে সরকারী দলের ছাপ। অস্বীকার আর ঘটনার পর বহিস্কার বা শাস্তিতে সান্তনা থাকলেও মানুষের মনের ভেতর যে কালো দাগ তা দূর করা যায় না। গেল বছর এমন সব ঘটনা আওয়ামী লীগকে যে কালিমা দিয়ে গেছে তার উদ্ধারের একমাত্র পথ 'আত্মশুদ্ধি'; এ 'আত্মশুদ্ধি'র পথে আওয়ামী লীগ হাঁটবে বলে আশা করতেই পারি। আবার আশঙ্কাও করতে পারি- কোনও শুদ্ধির পথেই সে হাঁটবে না।
রাজনীতিহীন বছরে সমাজ ও সামাজিক দুষ্কর্মই ছিল সংবাদের শিরোনাম, সোশাল মিডিয়ার আলোচনার বস্তুও বটে। একটা বিষয় মনে রাখতেই হবে, বাংলাদেশে একসময় মানুষ করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মেনে নিয়ে চেষ্টা করেছে ঘরে নিরাপদে থাকার।
তবে সামাজিক দস্যু এবং ধনশালীরাই সেই ধারাবাহিকতা প্রথম ভেঙেছেন। কী করে ভুলবো পোশাক শ্রমিকদের খালি পায়ে ঢাকায় টেনে আনার ঘটনা! অথচ সেই সময় কোভিড ছিল তুঙ্গে। অপার আশির্বাদের বিষয় যে সংক্রমণ বা করোনাভাইরাস সেভাবে বিস্তার লাভ করে নি। এ জাতিকে মোটামুটি কবরমুখী করার কাজ করেছিল কতিপয় লোভী ব্যবসায়ী।
পোশাক শ্রমিকসহ নানা খাতের অন্যান্য শ্রমিকরা বছর বছর ব্যবসায়ীদের মুনাফার সর্বোচ্চকরণে শ্রম-ঘাম ঢেলে দিয়েছেন। কিন্তু করোনাভাইরাসের সময় দেখেছি, একশ্রেণির লোভী ব্যবসায়ী শ্রমিক-কর্মচারীদের একমাস কাজ ছাড়া বেতন দেননি। তাদের দিকে খেয়াল রাখা দূরের কথা, তাদের চাকরি কেড়ে নিতেও দ্বিধা করেননি। এরা কিভাবে দেশ ও দশের বন্ধু সেটাই এখন জিজ্ঞাসা। বাংলাদেশের মানুষের শ্রম ও উপার্জনের ওপর ভিত্তি করে ধনী হয়ে যারা দেশ-বিদেশে বাড়িঘর করে আয়েশে জীবন কাটায় তাদের বেলায় আইন কোথায়?
এমন অনেক বিষয়ে প্রশ্নের পাহাড় রেখেই বিদায় নিয়েছে বিষময় ২০২০। তার দাগ বয়ে বেড়ানো মানুষ চোখের সামনে স্বপ্নের পদ্মা সেতু হতে দেখছে বটে কিন্তু তার আগ্রহ আসলে কি আছে তাতে? আগ্রহ না থাকার যেসব মূল কারণ সেদিকে নজর নেই কারও। বহু বছর ধরে ক্ষমতায় থাকার সুফল যেমন, কুফলও আছে বৈকি। সেগুলো শেখ হাসিনা ছাড়া আরো কারো চোখে পড়ে না বা সমাধানও দিতে পারে না।
এ এককেন্দ্রিকতা সমাজের জন্য মঙ্গলজনক নয়। আমাদের নেত্রী আমাদের শেষ ভরসা। ছোট-বড় সব বিষয় তার উপর চাপিয়ে দেওয়া কাম্য হতে পারে না। তার কারণেই বাংলাদেশ মহামারীতেও খাদ্যে ভয়ংকর কোনও বিপদে পড়েনি। বহুদেশে নানা ধরনের ঘাটতি আর সংকট দেখা দিলেও সতেরো কোটি মানুষের বাংলাদেশ এখনো চলছে তার গতিতে। এ জায়গাটা সম্ভাবনার।
তবে দুর্ভাবনার একটি জায়গা শিক্ষা। ডিজিটাল পদ্ধতিতে লেখাপড়া আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। মূল পড়াশোনা বা পাঠদান আসলে বন্ধ। এতে মেধাশূন্যতাসহ যে সামাজিক কু-প্রভাব পড়বে, একা কেউ তার সমাধান দিতে পারবেন না। এর জন্য আধুনিক দেশগুলোর মডেল অনুসরণ করা জরুরি হলেও তা এখনো করা হচ্ছে না।
তবে সবচাইতে নাজুক পরিস্থিতিতে আছে সংস্কৃতি। ধর্ম-অধর্ম আর করোনাভাইরাসের চাপে তার দশা বেহাল। মুক্তিযুদ্ধ থেকে এরশাদ আমল, এমন কি এই সেদিনও সংস্কৃতি আমাদের দেশকে পথ দেখিয়েছে। এখন তা স্তাবকতা আর একপেশে হয়ে ক্লিশ। সংস্কৃতির যে প্রতিবাদ বা রুখে দাঁড়ানোর শক্তি, তা মূলত নি:শেষ। এর পুনর্জাগরণ এ বছর যদি না হয় বাংলাদেশ তার আসল অবয়ব খুঁজে পাবে না
তবু এটা বলবো ভালোমন্দ মিলিয়ে আমাদের দেশ ও বাঙালি বিশ্বব্যাপী ভালো আছে। তাদের জ্ঞান মেধা চোখ ও দৃষ্টি যতোদিন অন্ধ না হবে, ততোদিন তারা সব মহামারী বা কঠিন পরিস্থিতি ডিঙ্গিয়েই সামনে যাবে, যেতে পারবে। বাঙালির জীবন পুণ্যময় হোক। ধরিত্রী হোক বিপদমুক্ত। শুভ হোক ২০২১।
সিডনি