Published : 21 Aug 2021, 07:02 PM
কোভিডের সাথে দেড় বছরের বেশি সময় পার করে এসে এর সাথে আমাদের জানাশোনাটা এখন অনেক বেশি। আমরা খুব ভালো করেই বুঝে গেছি এই অদৃশ্য শত্রুকে হারাতে হলে আমাদের কি করতে হবে। সমস্যা হচ্ছে সমস্যাটি কারো একার নয়, একাকী কোভিডকে হারিয়ে জেতা যায় না। জিততে হলে খেলতে হবে একসাথে বিশ্বের সব প্রান্তে, আজ জিততেও হবে ওই একসাথেই। দেশের ভেতরইে যেখানে নানা মুনির নানা মত, দেশের বাইরে সেখানে মতের যে পার্থক্য থাকবে সেটাতো বলাই বাহুল্য। তার ওপর আছে কোভিডকে পুঁজি করে পরাশক্তিগুলো প্রভাববলয় বিস্তারের সব আয়োজন। কাজেই সারা বিশ্ব থেকে একসাথে, একযোগে কোভিডের পাততাড়ি গুটানোর সম্ভাবনা আপাতত যথেষ্টই কম।
এমন যখন পরিস্থিতি, তখন আমাদের আশু করণীয় হচ্ছে অন্তত দেশের চৌহদ্দির ভিতরে কোভিডকে নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসার চেষ্টা করা যাতে আমাদের জীবনযাত্রাটা আবার আগের মতো না হলেও, অন্তত প্রায় স্বাভাবিক হয়ে যায় আর আমরাও খেয়ে-পরে আগের মতো ভালোভাবে দিনগুলো পার করতে পারি। সমস্যা আছে এখানেও। এখানেও সচেতনতায় ঘাটতি চূড়ান্ত। মানুষ কিছুতেই যেন বুঝতে চাইছে না। ঈদ, পার্বন এসব কিছুই কেন যেন জীবনের আগে অগ্রাধিকারে। সাথে আছে জীবিকার প্রশ্নও। সরকার যেমন অনন্তকাল প্রণোদনা দিয়ে মানুষ বাঁচিয়ে রাখতে পারবে না তেমনি মানুষও শুধুই প্রণোদনায় বেঁচে থাকতে চাইবে তেমনটাও প্রত্যাশা করা যায় না। কথায় বলে বসে খেলে ফুরায় একদিন রাজভাণ্ডারও। শুধু বাংলাদেশই না, এ কথা প্রযোজ্য সারা বিশ্বের বেলাতেই। যে কারণে আমরা মার্কিন মুলুকেও দেখেছি– একদিকে করোনাভাইরাস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে অন্যদিকে এরই মাঝে বাইডেন সরকার করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে বিজয় ঘোষণা করে মাস্কের বিধি-বিধান শিথিল করছে। একই ধরনের উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে ইউরোপের বিভিন্ন দেশেও। অর্থাৎ আমরা ভালোই বুঝতে পারছি যে করোনাভাইরাস মোকাবেলায় লকডাউন কোনো সমাধান নয়। এটি হয়তো কাজে এসেছে চীন বা উত্তর কোরিয়ার মতো বদ্ধ সমাজে, কিন্তু আমাদের মতো উদার, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় লকডাউন সমাধান হতে পারে না। কারণ, আমরা পুলিশ নামাতে পারব, নামাতে পারব আর্মিও, কিন্তু লকডাউন না মানলে মানুষকে শাস্তি দেওয়া সম্ভব হবে না। অনেকে দুর্নীতির কথা বলেন, বলতে চান দুর্নীতি না থাকলে প্রণোদনা ঠিকঠাক মতো পৌঁছে যেত মানুষের ঘরে ঘরে আর ঠিক ঠিকই কার্যকর হতো লকডাউন। যারা এসব বলেন তাদের আসলে আমাদের জনগণের প্রাত্যহিক জীবনযাত্রা সম্বন্ধে ধারণা কম।
একটা গল্প বলি। গত বছর লকডাউনের সময় রাতের বেলা চেম্বার থেকে ফেরার পথে তেজগাঁও বাস টার্মিনালের উল্টো দিকে কিছু লোককে জটলা পাকাতে দেখে সাহস করে গাড়ি থামিয়ে জানতে চেয়েছিলাম ঘর ছেড়ে কেন তারা বাইরে? তাদের উত্তরের সারমর্ম ছিল এমন যে, তারা থাকেন একটি অথবা বড়জোর দুটো কামরা নিয়ে। সেখানে দিনের পর দিন আটকে থাকা অসম্ভব। হাজার হোক তারাও মানুষ, তাদেরও প্রাইভেসির প্রয়োজন পড়ে। সামান্য একটু ধুমপানের কিংবা এক কাপ চায়ের বিলাসিতা করতে হলেও তাদের বের হতে হয় ঘরের বাইরে। আর আমাদের মতো দেশে অর্থনীতির চাকা যেখানে অনেকটাই ঘোরে আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর ভরসা করে, সেখানে চাইলেই লকডাউন আর প্রণোদনায় সমাধান পাওয়া যাবে না। দুর্নীতি নিঃসন্দেহে নিন্দনীয়, কিন্তু এই এক দুর্নীতির দোহাই দিয়ে সব সমস্যার সমাধান খুঁজলে সমস্যাকে অতি সরলীকরণ করে ফেলার ঝুঁকি থেকে যায়।
আমাদেরকে এখন আমাদের মতো করেই সমাধান খুঁজতে হবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের নানা দেশের অভিজ্ঞতায় আমরা খুব ভালোই বুঝতে পারছি যে কোভিডকে পাকাপাকিভাবে বশে আনার সবচাইতে কার্যকর অস্ত্রটি হচ্ছে ভ্যাকসিন। দেশের জনসংখ্যার আনুমানিক আশি শতাংশকে ভ্যাকসিনের আওতায় নিয়ে আসতে পারলে কোভিড বশে আসবে। তখন একদিকে যেমন নতুন রোগী শনাক্তের হার কমে আসবে বলে প্রত্যাশা করা যায়, তবে তার চেয়েও বড় কথা তা হলো, এর ফলে কমে আসবে সিভিয়ার কোভিডের ঝুঁকি। ফলে তখন হয় হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন আর পড়বে না আর যদি পড়েও রোগটা সেক্ষেত্রে আর সিরিয়াস হবে না।
এই একই লক্ষ্যে এগুচ্ছে বাংলাদেশ সরকারও। আমাদের হয়তো নিজস্ব ভ্যাকসিন এখনও নেই, কিন্তু মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কল্যাণে আমরা অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। পৃথিবীর ভ্যাকসিন পরাশক্তিগুলো যেখানে ভ্যাকসিনের মাধ্যমে প্রভাব বলয় বিস্তারের প্রতিযোগিতায় লিপ্ত, একটি দেশ একটি ভ্যাকসিন পরাশক্তির জন্য দরজা খুলে দিলে যখন মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে অন্যরা, সেখানে আমাদের দেশে এক সাথে রোল করছে চার চারটি ভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন। স্পুটনিক ফাইভ-ও এতদিনে চলে আসার কথা ছিল। ভারতে দ্বিতীয় ওয়েভ শুরু হওয়ায় যেমন সাময়িকভাবে স্থগিত হয়েছে দেশে কোভিশিল্ডের আমদানি, ঠিক একইভাবে রাশিয়ায় চলমান কোভিডের তৃতীয় ওয়েভের কারণে স্পুটনিকের বাংলাদেশ যাত্রা কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে। তবে এসব ঝক্কি কাটিয়ে উঠে আমরা যে আগামী বছরের শুরুতেই একুশ কোটি ডোজ ভ্যাকসিন পেতে যাচ্ছি, এটা আমাদের একাধিক দায়িত্বশীল মন্ত্রীর জবানীতে এরই মধ্যে জেনে গেছি। এমন আশাব্যঞ্জক ভ্যাকসিন ব্যবস্থাপনার প্রেক্ষাপটে এখন ভ্যাকসিন যাচ্ছে গ্রামে। বাংলাদেশই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ যারা নিজস্ব ভ্যাকসিন ছাড়াই এমন মহা-ভ্যাকসিনযজ্ঞে সাহসী হয়েছে।
আশা করা যায় এই ভ্যাকসিনযজ্ঞটি সফল হবে এবং আগামী বছরের মাঝামাঝি থেকেই আমরা কোভিডের বাড়াবাড়ি থেকে মুক্তি পাব। কিন্তু যেমনটা ধারণা করা হচ্ছে কোভিড প্যান্ডেমিক থেকে এন্ডেমিক হয়ে রয়ে যাবে বাংলাদেশে এবং পাশাপাশি বিশ্বের অনেকখানেই। মাঝে মাঝেই এখানে ওখানে, এদেশে ওদেশে দেখা দেবে কোভিডের স্থানীয় আউটব্রেক। এমনটা সম্ভবত দেখা যাবে ২০২৪-২৫ সাল থেকেই। কাজেই আমাদের নিজস্ব ভ্যাকসিন সক্ষমতা গড়ে তোলাটা খুবই জরুরি। আমদানি করা ভ্যাকসিন দেশে 'ফিল অ্যান্ড ফিনিশ' করে আমরা প্রাথমিক চাহিদাটা মেটাতে পারব ঠিকই, কিন্তু পাশাপাশি নিজস্ব ভ্যাকসিন উৎপাদনও অত্যন্ত জরুরি। সেক্ষেত্রে যে শুধু দেশের মানুষই বাঁচবে তাই নয়, পাশাপাশি আমরা ভ্যাকসিন পরাশক্তির খাতায়ও নাম লেখাতে পারব যা বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গুরুত্বকে যে কোন জায়গায় নিয়ে যাবে তা সম্ভবত আমরা চিন্তাও করতে পারছি না। আজ শ্রীলংকাকে দুইশ মিলিয়ন ডলার সাহায্য দিয়েই আমাদের এত নাম ডাক, আর যদি এটা হতো দুই মিলিয়ন ডোজ বাংলাদেশি ভ্যাকসিন, ভাবা যায় কোথায় থাকতাম আমরা?
এ তো গেল কোভিডের সাথে দীর্ঘমেয়াদে সহবস্থানের বিষয়। কিন্তু এই মুহূর্তের তাগিদটাও তো অনেক বেশি বৈ কম না। যতদিন না আমাদের আশি শতাংশ মানুষ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুত বিনামূল্যের ভ্যাকসিনের আওতায় আসছে, আমাদের তো লকডাউনকে ফাঁকি দিয়েই সেই সুদিনের প্রত্যাশায় কাউন্ট-ডাউন চালিয়ে যেতে হবে। পত্রিকান্তরে জানা যাচ্ছে সরকারও তেমনটাই ভাবছে। ভাবছে বলেই ভাবনা চিন্তা চলছে প্রয়োজনে আইন সংশোধন করে মাস্ক ব্যবহারকে বাধ্যতামূলক করায় পুলিশের হাতকে জোরদার করার।
পাশাপাশি আমরা অ্যান্টিজেন টেস্টের গণ-ব্যবহারের কথাও চিন্তা করতে পারি। সরকার যেখানে ১৫০০-২০০০ টাকায় কেনা পিসিআর কিট ব্যবহার করে মাত্র ২০০ টাকায় পিসিআর টেস্ট করছে, এসব টেস্টের অন্যান্য খরচের কথা না হয় বাদই দিলাম, সেখান ৫০০ টাকায় কেনা অ্যান্টিজেন কিটে ভর্তুকি দিয়ে যদি এই টেস্টের খরচ ১০-২০ টাকায় নামিয়ে আনা যায় তাহলে আমরা কিন্তু দূরপাল্লার যানবাহন, ডাক্তারের চেম্বার কিংবা নন-কোভিড হাসপাতাল, শপিং সেন্টার কিংবা গরুর হাট থেকে শুরু করে এমন সব জায়গা, যেখানে ব্যাপক লোকসমাগম হয় এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাটা কঠিন, সেসব জায়গায় অ্যান্টিজেন টেস্টের কথা বিবেচনায় রাখতে পারি। এতে করে সম্ভবত অপ্রয়োজনীয় যাতায়াত আর জনসমাগম অনেকইটাই কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
আমরা আসলে এখন যে সময়টা অতিক্রম করছি তা অনেকটা ট্রানজিট কালের মতো। 'ওল্ড নরমালকে' আমাদের রাতারাতি বিসর্জন দিতে হয়েছিল। আমরা সার্স-কোভ-২ নামের এক অদৃশ্য ভাইরাসের তাণ্ডবে হঠাৎই 'নিউ নরমাল' জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হতে বাধ্য হয়েছিলাম। এখন আমরা আবার 'নিউয়ার নরমালের' প্রস্তুতি পর্বে আছি আর 'নিউ নরমালের' মতো আমাদের 'নিউয়ার নরমাল' জীবনযাত্রাও হবে একেবারেই অন্যরকম এবং একেক দেশ আর অঞ্চলে একেক রকম। কাজেই 'নিউ নরমাল' জীবন থেকে শিক্ষা নিয়ে এখন থেকেই 'নিউয়ার নরমালের' জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করাটাই হবে যুক্তিযুক্ত।