Published : 20 Feb 2022, 09:03 PM
অচিরেই বাংলা ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট আলোর মুখ দেখতে চলেছে। বাংলা ইশারা ভাষার প্রসার ও গবেষণার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেই শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের সংগঠনগুলো দীর্ঘদিন ধরে বাংলা ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট- এর দাবি জানিয়ে আসছিল। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন- এর পক্ষ থেকে 'বাংলা ইশারা ভাষা দিবস ২০২২' উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ঘোষণাটি দেওয়া হয়। খবরটা জেনে ভালো লাগল। কিন্তু উল্লেখিত দুই কর্তৃপক্ষ কর্তৃক বাংলা ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট বাস্তবায়ন কমিটির তালিকা হাতে পেয়ে আমি বিস্মিত। বাংলা ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট সংক্রান্ত প্রস্তুতি সভায় শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের ভাষা এবং সংস্কৃতিগত অধিকার ও মর্যাদার লঙ্ঘন করে তাদের অংশগ্রহণে বাধা দেওয়া হয়েছে। এই ইনস্টিটিউট যাদের জন্য অত্যন্ত জরুরী- সেই শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষদের নিয়ে বধির সংঘগুলো, বাংলা ইশারা ভাষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞরা, বাংলা ইশারা ভাষা দোভাষী এবং সর্বোপরি তৃণমূলের শ্রবণ প্রতিবন্ধীরা যদি এই ইনস্টিটিউট তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত না থাকেন, সেক্ষেত্রে এর ভবিষ্যৎ নিয়ে সচেতন একজন প্রতিবন্ধী নাগরিক হিসেবে আমি অত্যন্ত চিন্তিত, খানিকটা ক্ষুদ্ধ। তাই বাধ্য হয়ে কলম হাতে নিয়ে তুলে নিয়েছি।
প্রেক্ষাপট
ফেব্রুয়ারি মাস। ভাষার মাস। একদা এই মাসেই পাকিস্তান আমলের বৈষম্যের বিরুদ্ধে বাঙালি মাথা নত করেনি। স্বীকৃতি স্বরূপ আজ আমরা ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পেয়েছি। পৃথিবীর সকল ক্ষুদ্র ভাষাগোষ্ঠী মানুষদের প্রতি সম্মান প্রদর্শন এবং তাদের ভাষাকে প্রাঞ্জল রাখতে জাতিসংঘ ঘোষিত এই দিবস এখন সারা পৃথিবীতে পালন করা হচ্ছে। একুশের এই চেতনায় আমরা শিখেছি অন্যায় ও শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী কণ্ঠ হতে।
প্রতিবন্ধী মানুষ মানববৈচিত্র্যের অংশ। প্রতিবন্ধিতার ভিত্তিতে বা ধরন বিবেচনায় বৈষম্যের কোনো সুযোগ নেই। স্বাধীন নাগরিক হিসেবে রয়েছে যাদের সমান সাংবিধানিক ও আইনি স্বীকৃতি। কিন্তু যুগ যুগ ধরে প্রচলিত নেতিবাচক মানসিকতার কবলে নেতৃত্বহীন, প্রতিনিধিত্বহীন, ক্ষমতাহীন এক বিভীষিকাময় শেকলবন্দি জীবন যাপন করছি আমরা প্রতিবন্ধী মানুষেরা। এর মধ্যে যারা শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষ তারা আরও অনেক বেশি বৈষম্যপীড়িত। নিষ্পেষিত। কারণ তথাকথিত ভদ্র সমাজে আমরা মানুষেরা, জানি ভাবের আদান-প্রদান করতে। এমনকি অন্যান্য প্রতিবন্ধী মানুষেরাও সুন্দরভাবে সাজিয়ে গুছিয়ে না হলেও শব্দের মাধ্যমে কথা তো বলতে জানেন! কিন্তু শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষেরা পারেন না। কারণ তারা শুনতে পান না। জন্ম থেকে শব্দহীন জগতে বেড়ে ওঠার কারণে তারা কথা শেখেননি। কিন্তু এটা আহা-উহু করবার মতন অনেক বড় কোনো সমস্যা নয়। কথা বলতে না পারার কারণে তারা আমাদের মতো কথা বলিয়ে মানুষদের সাথে ভাব বিনিময় করতে পারবেন না, আমাদের এহেন ধারণা চরম মাত্রায় ভুল।
আমাদের প্রতিবন্ধী জনগণের একটি বড় অংশেরই ভাষা ব্যবহারে বা প্রকাশে ভিন্নতা রয়েছে। যেমন দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষেরা কথার মাধ্যমে ভাব প্রকাশ করতে পারলেও তাদের লিখিতরূপ প্রকাশের মাধ্যম ব্রেইল। আর যারা শ্রবণ-দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষ তারা টেকটাইল বা স্পর্শ ভাষার ব্যবহারে শিক্ষা, কর্ম ও জনজীবনে দিন অতিবাহিত করতে পারেন। বাংলাদেশে স্পর্শ ভাষার ব্যবহার বিষয়ে অজ্ঞতা ও অসচেতনতার কারণে এমন কাউকে দেখতে পাওয়া না গেলেও আমরা সবাই হেলেন কেলারকে জানি। যিনি শব্দহীন অন্ধকার এক জগতে বাস করলেও শুধু স্পর্শ ভাষার সাহায্যে তার কর্মে মেধায় পরিচিত হয়েছেন পৃথিবীব্যাপী। এছাড়াও বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও নিউরোলজিজনিত বিভিন্ন ধরনের প্রতিবন্ধী মানুষের সাধারণ ভাষা ব্যবহারের পাশাপাশি যোগাযোগে ইশারা (ইংরেজিতে যাকে বলে Gesture) ব্যবহার করে থাকেন। ভাষাতাত্ত্বিকরা যাকে নিউরো সাইন বলেন। অন্যদিকে শ্রবণ প্রতিবন্ধী জনগণের নিজস্ব ভাষা 'বাংলা ইশারা ভাষা'।
বাংলা ইশারাভাষীদের দীর্ঘদিনের দাবির প্রেক্ষিতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ২০০৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি একুশে বইমেলায় সর্বপ্রথম রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বাংলা ইশারা ভাষা চালুর ঘোষণা দেন। একই সাথে মানুষের তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে বিটিভিসহ সব টেলিভিশন সংবাদে বাংলা ইশারা ভাষা চালুর নির্দেশনা দেন। এই ধারাবাহিকতায় সে সময় শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার অর্জনে অগ্রভাগে থাকা সংগঠন সোসাইটি অব দ্যা ডেফ অ্যান্ড সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ ইউজার্স (এসডিএসএল) এর প্রচেষ্টা এবং সরকারের সদিচ্ছায় ২০১৪ সাল থেকে দেশে প্রথম ৭ ফ্রেব্রুয়ারি 'বাংলা ইশারা ভাষা দিবস' পালন করা শুরু হয়। যদিও হাসপাতাল, থানা, আদালত, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যমসহ সকল প্রায়োগিক ক্ষেত্রে বাংলা ইশারা ভাষার ব্যবহার এখনো চরমভাবে অবহেলিত। রাষ্ট্রীয়ভাবেও এই ভাষার ওপর গবেষণা ও প্রসারে নেই কোনো কার্যকর উদ্যোগ। আইন ও সনদে বাধ্যবাধকতা থাকলেও সরকারি মহলে বাংলা ইশারা ভাষা বিষয়ে অজ্ঞতার ফলে বাস্তবায়নে আমরা পিছিয়ে রয়েছি।
আইনি বাধ্যবাধকতা
বাংলাদেশ সরকার স্বাক্ষরিত জাতিসংঘসহ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার সনদ (সিআরপিডি) এর ধারা ২ (সংজ্ঞা) ইশারা ভাষার স্বীকৃতি প্রদান, ধারা ৯ (সুযোগ প্রাপ্তি ও ব্যবহারের অধিকার) ইশারা ভাষা পেশাদার দোভাষী তৈরি, ধারা-২১ (মতামত ও অভিব্যক্তি প্রকাশের স্বাধীনতা এবং তথ্য প্রাপ্তির অধিকার) এ দাপ্তরিক যোগাযোগে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের চাহিদানুযায়ী ইশারা ভাষাসহ সকল বিকল্প যোগাযোগের উপায়, ধরন ও পদ্ধতির স্বীকৃতি ও সহায়তা প্রদান করার কথা বলা হয়েছে। ধারা-২৪ (শিক্ষা) এ ইশারা ভাষা শেখায় সহায়তা করা এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ভাষাগত পরিচয়কে সমুন্নত করার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া এই ধারায় শিক্ষায় শ্রবণ প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ইশারা ভাষা এবং এই ভাষায় পারদর্শী শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষা ব্যবস্থার সকল স্তরে কর্মরত পেশাজীবী ও কর্মীদের প্রশিক্ষণের জন্য যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। ধারা-২৯ এ বলা হচ্ছে রাজনৈতিক ও জনজীবনে অপরাপর নাগরিকের সাথে সমতার ভিত্তিতে উপভোগের নিশ্চয়তা প্রদান করতে। ধারা-৩০ (সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বিনোদন, অবকাশ ও খেলাধুলায় অংশগ্রহণ) এ ইশারা ভাষা ও ইশারা ভাষাগোষ্ঠীর সংস্কৃতিসহ তাদের স্বকীয় সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত পরিচিতির স্বীকৃতি প্রদানের কথা বলা হয়েছে। ন্যায় বিচার প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করতে বলা হয়েছে, ভাষাগত ও ভাব বিনিময় পদ্ধতি সম্পর্কে বিচার প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত ব্যক্তিগণকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। অর্থাৎ নির্যাতনের শিকার শ্রবণ প্রতিবন্ধী নারী বা অন্যান্য বিচার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে আদালতে দোভাষীর মাধ্যমে জবানবন্দি দেওয়ার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
সিআরপিডি-এর আলোকে প্রণীত হয়েছে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন ২০১৩। এ আইনে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে ''বাংলা ইশারা ভাষা অর্থ শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তির জন্য প্রণীত বাংলা ইশারা ভাষা, যাহা তাহাদের নিজস্ব সংস্কৃতি হইতে উৎসারিত অন্যান্য ভাষার মতোই গতিশীল ও পরিবর্তনশীল।''
দুর্ভাগ্যজনক সত্য হলো শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য সরকারিভাবে দিবস পালন এবং দিবসকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন আয়োজন ছাড়া এ পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হয়নি। সিআরপিডি সনদ এবং আইনের বিভিন্ন ধারা উপধারা লালফিতায় বন্দি হয়েই ধুলোয় গড়াচ্ছে।
দোভাষী সংকট
বিগত ৫০ বছরে নানা সময়ে শত শত বধির সংঘ গড়ে ওঠে এদেশে। তন্মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয় বধির সংস্থা (বিএনএফডি) ছাড়াও জাতীয় বধির ঐক্য পরিষদ, বাংলাদেশ মহিলা বধির সংস্থা, বাংলাদেশ বধির ছাত্র কল্যাণ সংস্থা, জাতীয় বধির ক্রীড়া ফেডারেশনসহ আরো বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ বধির সংঘ ঢাকা কেন্দ্রিক এবং বিভাগ ও জেলা-উপজেলা পর্যায়ে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে এদের কারো সাথে সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে এবং প্রতিবন্ধী মানুষের খাতে কর্মরত বড় এনজিও সংস্থাগুলোর সাথে তেমন যোগাযোগ নেই। এই সংঘগুলো নিজেদের প্রয়োজনে নিজ নিজ জেলা সমাজসেবা কার্যালয়গুলোতে হানা দেয়। প্রশিক্ষণ, চাকরি বা অনুদানের আশায় গুটিকয় এনজিওর দ্বারেও ধর্ণা দেয়। দোভাষীর মাধ্যমে নিজেরাই চেষ্টা চালায় সমস্যা সমাধানের। সবসময় তা ফলপ্রসূ হয় না। কারণে দেশে বাংলা ইশারা ভাষার দোভাষী সংকট ভয়াবহ মাত্রায় বিরাজমান। সঠিক বাংলা ইশারা ভাষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দোভাষী হাতে গোনা ১০/১২ জন।
এই দোভাষীদের নিয়োগ দেওয়া হয় বড় বড় সরকারি আয়োজন অথবা এনজিওগুলোর বড় বড় ইভেন্ট-সেমিনারে। কিন্তু সরকারি এবং এনজিও আয়োজিত প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার সুরক্ষা বিষয়ক সভাগুলোয় নিজস্ব উদ্যোগে দোভাষী রাখা হয় না। বাংলা ইশারা ভাষা দিবস কেন্দ্রিক প্রস্তুতিসভাগুলোতেও শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের সংগঠন নিজ থেকে কোনো দোভাষী নিয়ে গেলে তারা সভায় স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ করতে পারেন। নতুবা চুপ করে বসে থাকেন। কখনো বা সভা বয়কট করে বের হয়ে আসেন। দোভাষী নিয়োগ নিয়ে ইতোপূর্বেও সরকারি কর্মকর্তাদের অবহেলা মনোভাব নজরে এসেছে। নানা সময়ে দেখা গেছে, শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষেরা যেহেতু কথা বলতে পারেন না অতএব তাদের সাথে ভাব বিনিময় করতে সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যাপক অনীহা।
হারিয়ে যাচ্ছে শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের নেতৃত্ব
প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্ব প্রশ্নে সরকারি নীতিনির্ধারণী সংশ্লিষ্ট পর্যায়ে কর্মরত ব্যক্তিদের নেতিবাচক মানসিকতা দিনে দিনে প্রকট হয়ে পড়ছে। বিশেষত বাংলা ইশারা ভাষা প্রসারে এবং শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষদের সংগঠিত করে জনসম্মুখে, সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে সমন্বয় সাধনে নীরব ভূমিকা প্রদানকারী প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বিষয়ক বিশেষজ্ঞ-গবেষক ও সংগঠক রফিক জামান-এর অকাল প্রয়াণে যেন অভিভাবকহীন হয়ে পড়েছে শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের সংগঠনগুলো। ফলে বিগত কয়েক বছরের দিবস উদযাপন কেন্দ্রিক প্রস্তুতি সভা, এমনকি শুভেচ্ছা বক্তব্য নিয়েও কতিপয় এনজিও নেতার মধ্যে চেয়ার দখলের রাজনীতি প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। শ্রবণ প্রতিবন্ধী নেতৃবৃন্দের অনুপস্থিতিতে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা, সেবা প্রদানকারী সংস্থার গুটিকয় ক্ষমতাসীন এনজিও নেতাদের উপস্থিতিতে নির্ধারিত হয় শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষদের ভাগ্য। কিন্তু শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের জগতের নিরবতা ভেঙে দিতে ইদানিং এগিয়ে আসেন না কোনো রফিক জামান। ফলে বাংলা ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা সংশ্লিষ্ট কমিটি গঠন বিষয়ে সরকারি কর্মকর্তা এবং প্রতিবন্ধী মানুষের সেবায় নিয়োজিত কর্মরত সংগঠনগুলোর স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে তর্কবিতর্কের ঝড় ওঠে না। আমাদের দুর্ভাগ্য এত দূরদর্শী, ক্ষুরধার যুক্তিধারী এবং গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ভাণ্ডার নিয়ে আমাদের অধিকার ও সমমর্যাদা প্রতিষ্ঠায় নিজেকে নিবেদিত করবেন প্রতিবন্ধী মানুষের খাতে এমন কেউ বর্তমানে নেই। ইতোপূর্বে রফিক জামানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্ব প্রসঙ্গে এসডিএসএল এর আগের সেই তেজস্বী কণ্ঠস্বর শোনা যায় না।
একদা শ্রবণপ্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার অর্জনের অগ্রভাগে থাকা সংগঠন এসডিএসএল-এর জোরালো পদক্ষেপে 'বাংলা ইশারা ভাষা দিবস' পালনসহ বাংলা ইশারা ভাষার দোভাষী প্রশিক্ষণ এবং ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে আদালত, থানা ও ভিক্টিম সাপোর্ট সেন্টারে দোভাষীর সহায়তা কার্যক্রম শুরু হয়। জন্মলগ্ন থেকেই এসডিএসএল দাবি জানিয়ে আসছিল পর্যায়ক্রমে বাংলা ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপন, বাংলা ইশারা ভাষা আইন প্রণয়ন এবং বাংলা ইশারা ভাষা প্রমিতকরণ বাস্তবায়নের জন্য। এই ভাষা ইনস্টিটিউট তৈরি হলে বাংলা ইশারা ভাষা প্রমিতকরণ এবং গবেষণা কার্যক্রম যেমন সহজ হবে তেমনি সরকারি উদ্যোগে বাংলা ইশারা ভাষার দোভাষী প্রশিক্ষণ বৃদ্ধি পাবে। ফলে আদালতসহ প্রযোজ্য ক্ষেত্রে দোভাষী নিয়োগ শুরু হবে। সম্প্রতি সরকার বাংলায় ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট বাস্তবায়নের লক্ষ্যে একটি কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্বকারী বধির সংঘগুলোকে বাদ দেওয়া হয়েছে এই কমিটি থেকে। শ্রবণ প্রতিবন্ধী ব্যক্তি সংগঠন এসডিএসএলকে আমন্ত্রণ জানানো হলেও ব্র্যাকেটে উল্লেখ করা হয়েছে ইন্টারপ্রেটার (দোভাষী) হিসেবে কাজ করছে এমন প্রতিনিধি পাঠাতে।
এখানে তিনটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয়;
এক. শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্ব 'ইন্টারপ্রেটার' দিয়ে করা কি সম্ভব?
দুই. দোভাষী হিসেবে যারা কাজ করেন তাদের নেতৃত্বের অবস্থান থেকে বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর হওয়ার যোগ্যতার মাপকাঠি কী?
তিন. বাংলা ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট নির্মিত হতে যাচ্ছে কোটি কোটি টাকা ব্যয়ে, এর প্রস্তুতি সভাগুলোর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে দোভাষী নিয়োগে অর্থ বরাদ্দে সরকারের এত কার্পণ্য কেন?
বাংলা ইশারা ভাষা গবেষণার নামে স্বেচ্ছাচারিতা
বাংলা ইশারা ভাষা একটি স্বতন্ত্র ভাষা। কিন্তু বিগত সময়ে বাংলা ইশারা ভাষা গবেষণা সংশ্লিষ্ট গৃহীত কার্যক্রমগুলোতে এ বিষয়টি সুস্পষ্ট নয়। তথ্য ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীন বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল চার (৪) হাজার ইশারা (শব্দ) নিয়ে ২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে বাংলা ইশারা ভাষার মান প্রকাশ করে। শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের অংশগ্রহণ ছাড়া এই কার্যক্রমটি অনেকটা হয়ে গেছে ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দেওয়ার মতো। সেন্টার ফর ডিজেবিলিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিডিডি) এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ শিক্ষা বিভাগ সম্মিলিত ভাবে যে বাংলা ইশারা ভাষার অভিধানটি ২০০০ সালে প্রকাশ করে সেখানে এবং নানা সময়ের গবেষণাগুলো বিশ্লেষণ করলে যে বিষয়টি প্রকট হয়ে চোখে পড়বে, কোনো ইশারা (শব্দ) গ্রহণ বা বর্জন শৃংখলাবদ্ধ নয়। বিষয়টা অনেকটা এমন যেনতেনভাবে ইশারা যা পাওয়া গেছে, তাই গ্রন্থিত করা হয়েছে। তাতে ভাষাতাত্ত্বিক বা রীতিবদ্ধ পদ্ধতির মাধ্যমে ইশারা (শব্দ) সংগ্রহ করা হয়নি। যারা আমেরিকান ও ব্রিটিশ সাইন ল্যাঙ্গুয়েজ অভিধানগুলোর পাতা উল্টাবেন, তারা সহজেই বুঝতে পারবেন, যে এটা একটা স্বতন্ত্র ভাষা। এখানে ইশারা ভাষার শব্দগঠন, বাক্যরীতি, ব্যাকরণ এতটাই সুস্পষ্ট যে এ নিয়ে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকবে না। কিন্তু দেশে প্রকাশিত ইশারা ভাষার অভিধানগুলোর প্রকাশ পদ্ধতির ব্যর্থতার কারণে অনেকেই বাংলা ইশারা ভাষাকে একটি স্বতন্ত্র ভাষা বিবেচনা করতে পারেন না।
দুঃখজনক হলেও সত্য, প্রতিবন্ধী মানুষের খাতে সেবা প্রদানকারী প্রথম সারির কিছু এনজিও এবং সরকারি কর্মকর্তার স্বেচ্ছাচারিতার ফলে আমেরিকান ও ব্রিটিশ ইশারা ভাষার কিছু ইশারা (শব্দ) বাংলা ইশারা ভাষা প্রশিক্ষণ ম্যানুয়ালে ঢুকে পড়েছে। ব্যাপক হারে এই প্রশিক্ষণগুলোর ফলে বর্তমান প্রজন্মের শ্রবণ প্রতিবন্ধী তরুণ-যুবাদের আলাপচারিতার মাধ্যমে বাংলা, আমেরিকান ও ব্রিটিশ ইশারা ভাষার শব্দের মিশ্রণে বিজাতীয় এক ভাষা ছড়িয়ে পড়ছে এ অঞ্চলে।
সংকেত ভাষা বনাম বাংলা ইশারা ভাষা
বিদ্যায়তনিক পরিমণ্ডলে ইংরেজি সাইন ল্যাঙ্গুয়েজের বাংলা পরিভাষা হিসেবে 'সংকেত ভাষা'-কে গ্রহণ করা হয়েছে। বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার গবেষণায় বাংলা ইশারা ভাষাকে 'সংকেত ভাষা' হিসেবে পরিচিত করার দাবি তুলেছেন অনেকে। অতিসম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিসঅর্ডার বিভাগের চেয়ারপারসন তাওহিদা জাহান এর প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের শেষ লাইনে তিনি দাবি তুলেছেন, "সরকারি উদ্দ্যোগে একটি বাংলা সংকেত ভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপন ও বাংলা সংকেত ভাষার প্রমিতকরণ এখন সময়ের দাবি।" তাওহিদা জাহানের মতো বিদ্যায়তনিক পরিমণ্ডলে অনেকেই বাংলা ইশারা ভাষাকে সংকেত ভাষা হিসেবেও গ্রহণ করার বিষয়ে উদার হতে বলছেন। কিন্তু তারা যখন সর্বসাধারণের মধ্যকার আলোচনায় সংকেত ভাষা হিসেবে প্রচারণা অব্যাহত রাখছেন, তখন শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষেরা এবং প্রতিবন্ধী মানুষ নিয়ে কর্মরত ব্যক্তিদের মধ্যে এই নিয়ে দ্বিধা বিভক্তি তৈরি হচ্ছে। ব্রিটিশদের দেশে ব্রিটিশ ইশারা ভাষা, আমেরিকানদের দেশে আমেরিকান ইশারা ভাষা, ঠিক তেমনি ভারতীয় ইশারা ভাষা হিসেবে ভারতে প্রচলিত। যার যার দেশের নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতির ধারক বাহক এই ইশারা ভাষা। আমাদের দেশের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের ভাষা হিসেবে শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের মধ্যে এটি বাংলা ইশারা ভাষা হিসেবেই পরিচিত। কিন্তু আমাদের দেশে বুদ্ধিজীবী মহল এবং বিশেষত এনজিওঘরানায় 'বাংলা' যেন একটি অবজ্ঞার শব্দ। পরিপূর্ণ শ্রদ্ধার সাথে কতিপয় এই বুদ্ধিজীবী মহলের কাছে আমার জিজ্ঞাসা, বাংলা একাডেমির নামকরণ সংস্কৃতি বা ভাষা একাডেমি করা হলো না কেন?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন ডিসঅর্ডার বিভাগের অধ্যাপক ড. হাকিম আরিফ কিছুদিন আগে একটি টেলিভিশনে এক আলাপচারিতায় বলেন, বাংলায় ইশারা ভাষার প্রমিতকরণ যথাযথভাবে করতে একটি তদারকি সংস্থার দরকার। যেমন, বাংলা একাডেমি হচ্ছে বাংলা প্রমিতকরণের মান নির্ধারণের স্বতন্ত্র একটি সংস্থা। বাংলা একাডেমি যখন বাংলা শব্দ ও বাক্য গঠনের রীতি নীতি প্রকাশ করে, তখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, সরকার থেকে শুরু করে সর্বসাধারণ সকলেই সেটা মেনে চলে। অধ্যাপক হাকিম আরিফের সাথে একমত হয়েই বলতে চাই, বাংলা ইশারা ভাষার জন্য স্বতন্ত্র তদারকি সংস্থা দরকার। যেটি একমাত্র হতে পারে বাংলা ইশারা ভাষা ইন্সটিটিউট। বাংলা ইশারা ভাষা বিশেষজ্ঞ হয়ে ওঠা এ ইন্সটিটিউট এ বিষয়ে যে রূপরেখা দেবেন আমরা সকলেই তা মেনে নিতে বাধ্য থাকব এবং বাংলা ইশারা ভাষা থেকে 'বাংলা' হারিয়ে যাবে না।
'বাংলা ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট'– উপেক্ষিত শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের প্রতিনিধিত্ব
সম্প্রতি সরকার ঘোষিত ''ইশারা ভাষা ইন্সটিটিউট"-এর পূর্বে বাংলা শব্দটি অনুপস্থিত। ফলে 'বাংলা' ইশারা ভাষার অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা নিয়ে আমরা সন্দিহান।
অন্যদিকে এই ইন্সটিটিউট বাস্তবায়নে গঠিত কমিটিতে দীর্ঘ ৫০ বছরের পুরনো শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের মুরুব্বি সংগঠন বিএনএফডিসহ শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের অন্যান্য বধির সংঘগুলো, বাংলা ইশারা ভাষা বিষয়ক বিশেষজ্ঞ ব্যক্তিগণ, বাংলা ইশারা ভাষা দোভাষী এবং তৃণমুলের শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের উপস্থিতি নিশ্চিত করার বিষয়ে সরকার দায় এড়াতে পারে না। যেহেতু বিএনএফডির সাথে যুক্ত সারা দেশের লাখ লাখ তৃণমূলের শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষ, যারা সত্যিকার অর্থেই বাংলা ইশারা ভাষা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ তাদেরকে বাদ দিয়ে এ কেমন বাংলা ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট হতে যাচ্ছে! বাংলা ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা সংশ্লিষ্ট কমিটির তালিকায় দেখা গেছে একটি দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের সংগঠনের নাম। এটি যে বধির বিদ্যালয়গুলোতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষকদের নিয়োগের রেওয়াজের ধারাবাহিকতা তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
অথচ দেখতে না পাওয়ার ফলে দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের কমিউনিটির সাথে বাংলা ইশারা ভাষার ব্যবহারকারী শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা কারো অজানা নয়। এছাড়াও বাংলা ইশারা ভাষা ইনস্টিটিউট স্থাপন কমিটিতে শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের সংগঠনের অন্তর্ভুক্তি প্রসঙ্গে উল্লেখিত দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মানুষের সংগঠন ভিজ্যুয়াল ইম্পেয়ারড পিপলস সোসাইটি (ভিপস) এবং অন্যান্য তালিকাভুক্ত এনজিওগুলোর অঙ্গীকার প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
শেষ কথা
সত্যিকার অর্থেই বাংলা ইশারা ভাষা প্রমিতকরণ করতে হলে এ দেশের ৬৪ জেলার ৬৪ ধরনের আঞ্চলিক বাংলা ইশারা ভাষার শব্দ ভাণ্ডার নিয়ে ইশারা (শব্দ) সংগ্রহ করতে হবে। অবশ্যই প্রতিটি জেলার অজস্র অগণিত শ্রবণ প্রতিবন্ধী মানুষের সাথে আলোচনা, কর্মশালার মাধ্যমে এই শব্দভাণ্ডার তৈরি করে তবেই বাংলা ও ইশারা ভাষার সঠিক প্রমিতকরণ নিশ্চিত করা সম্ভব। আমাদের দাবি বাংলা ইশারা ভাষার প্রমিতকরণ এবং বাংলা ইশারা ভাষা ইন্সটিটিউট বাস্তবায়নে সরকার আন্তর্জাতিক, সাংবিধানিক এবং আইনি বাধ্যবাধকতাকে আমলে নিয়ে তৃণমূলের বধির সংঘগুলোকে এই কার্যক্রমের সাথে সরাসরি (কোন এনজিও-এর মাধ্যমে নয়) যুক্ত করবে।
এছাড়াও একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার, অপ্রতিবন্ধী মানুষদের সাথে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। যিনি প্রতিবন্ধী মানুষের ক্ষমতায়ন ও প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিতের চেতনায় কাজ করবেন এবং প্রতিবন্ধী মানুষের অধিকার অর্জনের নামে বৈষম্যমূলক কর্মকাণ্ডে আমাদের পক্ষে ক্ষমতাসীনদের বিপক্ষে মুখ খুলতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা সংকোচ করবেন না এমন অপ্রতিবন্ধী মানুষকে নেতা মানতে আমাদের দ্বিধা নেই।
প্রশ্নটা তাই বারেবারে ঘুরে ফিরে চলেই আসে ''প্রতিবন্ধী মানুষের খাতে কেন এবং কীভাবে দুর্বলচিত্তের এই অপ্রতিবন্ধী মানুষদের প্রতিনিধিত্বের জয়জয়কার?"