Published : 23 May 2025, 03:57 PM
অকস্মাৎ বাংলাদেশের রাজনীতি এক অনির্ধারিত সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকার এক চরম দ্বিধা ও সংকটের মুখে। সাম্প্রতিক সময়ে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের কঠোর বক্তব্য, রাজনৈতিক দলগুলোর ক্রমবর্ধমান চাপ এবং সরকারের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনের মিশ্র বার্তা—অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বকে প্রশ্নের মুখে ফেলেছে। এই সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে দাঁড়িয়ে আছেন একজন নোবেলজয়ী, যিনি কখনো সংস্কারের প্রতীক হিসেবে, কখনো বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে, আবার কখনো জাতীয় উত্তরণের মুখ হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, তিনি কী ইতিহাসের সঠিক দিকে থাকবেন, নাকি নিজের চারপাশে গড়ে তোলা ছায়াসাম্রাজ্যে আটকে পড়বেন? তিনি যদি দায় এড়িয়ে যান, তবে ইতিহাস তাকে ক্ষমা করবে না।
সংকটের গভীরতা ও সেনাপ্রধানের বার্তা
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকারের সাম্প্রতিক বক্তব্য—যেখানে তিনি নির্বাচন নিয়ে সময়সীমা নির্ধারণ করে দেন এবং ‘জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো প্রক্রিয়া মেনে নেওয়া হবে না’ বলে সাফ জানিয়ে দেন—তা অন্তর্বর্তী সরকারের সঙ্গে মতভিন্নতারই প্রকাশ। তিনি সরাসরি বলেছেন, ‘ডিসেম্বরের মধ্যে অবশ্যই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে হবে’—এমন একটি অবস্থান যা অধ্যাপক ইউনূসের উপদেষ্টা পরিষদের কিছু সদস্যের ‘জুন পর্যন্ত সময় নেওয়ার’ কৌশলের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
সেনাপ্রধান আরও স্পষ্ট করে বলেছেন, ২০২৬ সালের জানুয়ারির মধ্যে একটি নির্বাচিত সরকার দেখতে চান, যা ইউনূস সরকারের ওপর চাপকে আরও তীব্র করেছে। নির্বাচন নিয়ে বারবার তারিখ বদলানো, উপদেষ্টাদের পরস্পরবিরোধী বক্তব্য, এবং জনগণের মধ্যকার আস্থাহীনতা এখন অধ্যাপক ইউনূসকে এমন এক চৌরাস্তায় এনে দাঁড় করিয়েছে, যেখান থেকে ফেরার পথ সংকুচিত হয়ে আসছে।
সেনাপ্রধান যখন প্রকাশ্যে সরকারের সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, তখন সেটা শুধু শাসনব্যবস্থার ভাঙন নয়, বরং একটি সাংবিধানিক শূন্যতার ইঙ্গিতও বটে।
অধ্যাপক ইউনূস ইতিমধ্যে অভ্যুত্থান-সমর্থকদের সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন এবং পদত্যাগের ইঙ্গিতও দিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো—সেনাবাহিনীর সঙ্গে এই টানাপোড়েনের মাঝে তার নেতৃত্বের গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু? বিশেষ করে যখন তারই কিছু উপদেষ্টা নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে ইচ্ছাকৃতভাবে জটিল করে তুলছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
রাখাইন করিডোর: জাতীয় নিরাপত্তা না কূটনৈতিক জুয়া?
রাখাইন মানবিক করিডোর ইস্যুতে ইউনূস সরকারের নীতিগত অস্পষ্টতা এবং জনগণকে অন্ধকারে রাখার প্রবণতা তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিবকে এনে এই করিডোরের বৈধতা প্রমাণের চেষ্টা করা হলেও, কোনো রাজনৈতিক দল বা জাতীয় ফোরামের সঙ্গে আলোচনা না করায় এটি একটি একতরফা সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা দিয়েছে। এমনকি জামায়াতে ইসলামী, যে দলটি কিনা শুরু থেকে মুহাম্মদ ইউনূসের সরকারকে সমর্থন জুগিয়েছে, সে দলটির আমিরও এ নিয়ে সরকারের স্বচ্ছতা দাবি করেছেন।
অন্যদিকে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার এই করিডোরকে ‘জাতির জন্য আত্মঘাতী’ বলে আখ্যায়িত করে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, সেনাবাহিনী কোনো করিডোর মেনে নেবে না। এই ইস্যুতে সরকারের নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের মন্তব্য পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে।
এতদিন যাদের সমর্থনে সরকার টিকে ছিল, সেই শক্তিগুলোই এখন প্রশ্ন তুলছে: কার স্বার্থে এই করিডোর? আন্তর্জাতিক মহলের চাপ মোকাবেলার নামে কি দেশের সার্বভৌমত্বকে জলে ভাসানো হচ্ছে?
‘মবতন্ত্র’, আইনশৃঙ্খলা ও জনমনের আতঙ্ক
৫ অগাস্ট-পরবর্তী বাংলাদেশে ‘মবতন্ত্র’-এর উত্থান কেবল কিছু বিচ্ছিন্ন গোলযোগ নয়, বরং এটি একটি রাষ্ট্রীয় ব্যর্থতার প্রতীক। জনসম্পৃক্ততা যেখানে গণতান্ত্রিক শাসনের শক্তি হওয়া উচিত, সেখানে বিক্ষুব্ধ জনতার ভিড় এখন এক অপ্রতিরোধ্য আতঙ্কে রূপ নিচ্ছে—যার মূল দায় সরকার ও প্রশাসনের ঘাড়েই বর্তায়।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ক্রিয়তা এবং সরকারের কার্যত নিষ্ক্রিয়, দিশাহীন অবস্থান জনমনে বিভ্রান্তি ও আতঙ্ক তৈরি করেছে। সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামানের কড়া বার্তা—‘মবতন্ত্র আর সহ্য করা হবে না’—এটা নিছক সতর্কবার্তা নয়, বরং সরকারের কাজে ক্রমবর্ধমান বিরক্তির ঘোষণাপত্র।
এটা যে কেবল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন নয়, বরং রাষ্ট্রক্ষমতার বৈধতা নিয়ে মৌলিক প্রশ্ন উঠেছে, তা এই বক্তব্যে স্পষ্ট। ইউনূস সরকার শুরুতেই ‘জনগণের ক্ষমতায়ন’–এর বুলি কপচালেও বাস্তবে সেই জনগণ আজ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, আর রাস্তায় নামা ভিড় আর আত্মবিশ্বাসী নাগরিক না হয়ে উঠেছে রাজনীতির গুটি আর নিরাপত্তাহীনতার জিম্মি। ফলে ‘মবতন্ত্র’ শুধু সমাজে বিশৃঙ্খলা নয়, সরকারের নৈতিক কাঠামো ভেঙে পড়ার এক জ্বলন্ত উদাহরণ, যা ইউনূস সরকারের জন্য এখন এক মারাত্মক অস্তিত্ব সংকটে পরিণত হয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর: উন্নয়ন নাকি গোপন গৃহচুক্তি?
চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগে রাজনীতির আরেকটি অগ্নিকুণ্ড জ্বলছে। সরকারের পক্ষ থেকে স্বচ্ছ ব্যাখ্যার অভাব, চুক্তি নিয়ে ধোঁয়াশা, এবং সেনাপ্রধান এই বিষয়ে তার অবস্থান স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘এ ধরনের কৌশলগত সিদ্ধান্ত শুধু নির্বাচিত সরকারই নিতে পারে।’ এই মন্তব্য সরকার ও সেনাবাহিনীর মধ্যে দূরত্বকে আরও বাড়িয়েছে।
সবকিছু মিলিয়ে স্পষ্ট যে এই সিদ্ধান্ত সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরেও চলে যেতে পারে। একটি নির্বাচিত সরকার না থাকা অবস্থায় এমন গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া কতটা গ্রহণযোগ্য, সেটাও এখন জাতীয় বিতর্কের কেন্দ্রে।
উপদেষ্টাদের ভূমিকা: সমাধান নাকি সংকট?
যে উপদেষ্টারা অধ্যাপক ইউনূসের চারপাশে বর্ম হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকার কথা, তারাই এখন একটি দুর্বল কড়চা হয়ে উঠেছে। ক্ষমতার মোহ, রাজনৈতিক অদূরদর্শিতা এবং আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার প্রতি উদাসীনতা—এসবই একত্রে মিলে জনগণের মধ্যে ভয় ও সংশয়ের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে কিছু উপদেষ্টার বিতর্কিত বক্তব্য ও ভূমিকা, যেমন নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের ‘ইতিহাসের ভুল উদ্ধৃতি’ বা ‘বিভ্রান্তিকর ব্যাখ্যা’, সরকারকে আরও কোণঠাসা করে ফেলেছে।
অধ্যাপক ইউনূসের সরকারের অভ্যন্তরীণ কোন্দলও এখন প্রকাশ্যে। সরকারের আনুকূল্যে নবগঠিত রাজনৈতকি দল এনসিপি অন্তত তিনজন উপদেষ্টা—সালেহ উদ্দিন আহমেদ, ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও আসিফ নজরুলের পদত্যাগ দাবি করেছে। অন্যদিকে, বিএনপি ‘এনসিপির লোক’ বলে পরিচিত দুই উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও মাহফুজ আলমের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে তাদের অপসারণ চেয়েছে।
এই বিভক্তি প্রমাণ করে যে, ইউনূস সরকারের ভিতই এখন নড়বড়ে। অর্থনৈতিক সংকট, বিনিয়োগের অভাব, আইনশৃঙ্খলার অবনতি সত্ত্বেও মানুষ পরিবর্তনের পক্ষে ছিল। কিন্তু ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী জনমতকে উপেক্ষা করে নিজেদের স্বার্থে কাজ করছে, যা দেশকে অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
অধ্যাপক ইউনূসের সামনে এখন কী পথ?
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—যারা ক্ষমতায় এনেছিলেন, তারাই কি এখন পিছুটান দিচ্ছেন? সেনাবাহিনী, রাজনৈতিক দল এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়—সবাই এখন মুহাম্মদ ইউনূসের পরবর্তী পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে আছে।
এ পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠেছে—অধ্যাপক ইউনূস কী করবেন? তিনি কি সেনাপ্রধানের সঙ্গে সংঘাতে যাবেন, নাকি কৌশলে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে নির্বাচনমুখী একটি রোডম্যাপ উপস্থাপন করবেন? তার অতীত দেখায়, তিনি কখনো আপস করতে জানেন, আবার কখনো হঠাৎ পথবদলে অভ্যস্ত। কিন্তু এবার পরিস্থিতি আলাদা—বল এখন আর তার কোর্টে নেই, জেনারেল ওয়াকার তা সরাসরি জনগণের হাতে তুলে দিয়েছেন।
ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ
বুড়িগঙ্গায় শুধু পানি নয়, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ঢেউ গড়িয়ে পড়ছে। অধ্যাপক ইউনূস ও তার সরকারের সামনে এখন যে দুটি পথ খোলা, তার একটি ইতিহাসে তাকে ‘জনগণের প্রতিনিধি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে, অন্যটি তাকে এক ‘ভুল সময়ে ভুল সিদ্ধান্তের প্রতীক’ হিসেবে চিহ্নিত করতে পারে।
নির্বাচনের পথ সুগম না করলে এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘাত বেছে নিলে কী হতে পারে, তা অতীত ইতিহাসেই লেখা আছে।
অধ্যাপক ইউনূস এবং তার মিত্রদের এখনই বুঝতে হবে—ক্ষমতার মোহ জাতির কল্যাণের চেয়ে বড় নয়। বাংলাদেশের মানুষ একটি স্থিতিশীল, গণতান্ত্রিক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ চায়। সেই আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে কোনো নেতৃত্বই টিকতে পারবে না।
এই মুহূর্তে যা প্রয়োজন তা হলো—নিরপেক্ষতা, সাহসিকতা ও বাস্তববাদিতা। জনগণ চায় স্থিতিশীলতা, সেনাবাহিনী চায় দায়িত্বশীলতা, আর রাজনৈতিক দলগুলো চায় অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। এই ত্রিমুখী চাহিদার মধ্যে থেকে একজন রাষ্ট্রনায়কের মতো সিদ্ধান্ত নিতে না পারলে, বাংলাদেশের রাজনীতি সামনে এক অনিশ্চয়তা ও অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাবে। রাজনীতির এই অগ্নিপরীক্ষায় সঠিক পথ বেছে নেওয়াই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
মুহাম্মদ ইউনূস কী করবেন? এই প্রশ্নের উত্তরই এখন বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।