Published : 09 May 2025, 10:33 AM
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে যুদ্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার গঠনমূলক উপাদান একাধিক, সেগুলো হলো: বিজেপির নেতৃত্বে কাশ্মীরকে পুরো আত্মীকরণের ভারতীয় চেষ্টা, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের কিছু উস্কানিমূলক বক্তব্য ও পদক্ষেপ, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন মেরুকরণ, যুক্তরাষ্ট্রে এক যুদ্ধবাজ উগ্র প্রেসিডেন্টের আবির্ভাব, ইসরায়েলি মডেলের বৈশ্বিক বিস্তৃতি ও এক স্থায়ী যুদ্ধ অর্থনীতির বিকাশ।
ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সৃষ্ট সাম্প্রতিক যুদ্ধ পরিস্থিতি বুঝতে হলে এই উপাদানগুলোকে বিবেচনার মধ্যে নিতে হবে। আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছে কাশ্মীরের স্বাধীনতার প্রশ্ন। ভারত-পাকিস্তানের বিভক্তির সময়েই কাশ্মীর স্বাধীনতা হারায় জনগণের ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার একাংশের ভারতে অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে। এরপর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু জম্মু ও কাশ্মীরে একটি গণভোটের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা ধূর্ততার সঙ্গে সবসময় এড়িয়ে যাওয়া হয়। কাশ্মীরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারটি ভারত ও পাকিস্তান দুই দেশই অবজ্ঞা করে। তবে কাশ্মীরের ভারত-নিয়ন্ত্রিত অংশেই অসন্তোষ বেশি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠতে থাকে। যাতে পাকিস্তানেরও কমবেশি ভূমিকা রয়েছে। আর সেই ভূমিকার ছুতায় ভারত সেখানে দমন-পীড়ন, জেলজুলুম, হত্যা-ধর্ষণ সবকিছু চালিয়ে তাকে এক স্থায়ী পুলিশি রাষ্ট্রে পরিণত করে রেখেছে। এভাবে ফিলিস্তিনের ও কাশ্মীরের উভয় জনগোষ্ঠী হয়ে আছে স্বভূমে পরবাসী।
২০১৯-এ ভারতের মোদী-পরিচালিত বর্তমান সরকার কর্তৃক সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ বাতিলের মধ্য দিয়ে কাশ্মীর তার বিশেষ মর্যাদা হারিয়ে পরিণত হয় এক দখলিকৃত ঔপনিবেশিক ভূমিতে। নরেন্দ্র মোদীর সরকার সেখানে প্রবর্তন করে কারাগারের নিরাপত্তা-শৃঙ্খলা ও কবরের শান্তি যাকে তার সরকার স্থিতিশীলতার উদাহরণ বলে প্রচার চালিয়ে পর্যটন ব্যবসা অব্যাহত রেখেছিল। সেই দাবিই ফুটো হয়ে যায় সাম্প্রতিক পেহেলেগামে সন্ত্রাসী হামলা ও ২৬ জন নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে।
কিন্তু এই হামলায় প্রত্যক্ষ মদত থাকুক বা না থাকুক, পাকিস্তানের দিক থেকে উস্কানির অভিযোগ অস্বীকার করার সুযোগ নেই। পেহেলগামে হামলার কয়দিন আগে ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল আসিম মুনীর ইসলামাবাদে এক সভায় যে বক্তব্য দেন তা খুবই অবিবেচনাপ্রসূত। তিনি বলেন, “আমরা হিন্দুদের থেকে আলাদা।” তিনি কাশ্মীরকে বলেন পাকিস্তানের ‘গলার শিরা’ এবং প্রতিজ্ঞা করেন যে, পাকিস্তান কখনো ভারতের দখলদারির বিরুদ্ধে কাশ্মীরের জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামকে সমর্থন দেয়া থেকে পিছপা হবে না।
পাকিস্তান মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ হলেও এবং সেখানে সংখ্যায় খুব উল্লেখ করার মতো না হলেও হিন্দু, খ্রিষ্টানসহ বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাস রয়েছে। পাকিস্তান রাষ্ট্রের সেনাপ্রধান হয়েও তিনি অতি উৎসাহে মুহূর্তের মধ্যে সবাইকে ফেলে কেবল মুসলমানদের সেনাপতি হয়ে গেলেন! অথচ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৭ সালের ১১ অগাস্ট পাকিস্তানের গণপরিষদে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন যে, পাকিস্তানে সকল নাগরিক সমান অধিকারের ভিত্তিতে জীবনযাপন করবে, ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে কোনো বৈষম্য থাকবে না। সেখানে আসিম মুনীরের এ ধরনের সংঘাত সৃষ্টির সহায়ক বক্তব্য দেয়ার কারণ কী? নিজের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সৃষ্টির লক্ষ্যে নাকি নতুন এক যুদ্ধ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ সমস্যা থেকে জনগণের দৃষ্টিকে সরানোর জন্য?
আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান পাকিস্তানি লেখক তারিক আলী নিউ লেফট রিভিউতে (অন দ্য ব্রিংক, ৩ মে ২০২৫) এ সম্পর্কে লিখেছেন, জেনারেল মুনীরের নিজেকে ভারতীয় মোদীর সামরিক পোশাকপরা পাকিস্তানি সংস্করণ হিসেবে উপস্থাপনের প্রয়াস এক চরম ব্যর্থতা। প্রথমত, হিন্দুরা সবসময়ই শত্রু এবং মুসলমানরা তাদের সঙ্গে একত্রে থাকতে পারে না— এ হলো মুসলমান সম্পর্কে মোদীর দাবির ‘বিপ্রতীপ প্রতিধ্বনি’।
অন্যদিকে সামাজিক মাধ্যমে ভারতের খ্যাতিমান লেখক অরুন্ধতী রায় বলেছেন, “পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধে জড়ায়নি, জড়িয়েছে এদের সরকার। তাদের ব্যবসায়ী গোষ্ঠি, চলচ্চিত্র শিল্প ও জনগণ একে অপরের সঙ্গে যুদ্ধ করছে না। এই যুদ্ধ আসলে একটা নাটক যা সীমান্তের দুই পারের শাসকগোষ্ঠির রচনা যারা ভয় ও ঘৃণা থেকে মুনাফা করে। ভারত ও পাকিস্তানের সুবিধাভোগী গোষ্ঠি জাতীয়তাবাদ ও কাশ্মীর বিষয়কে জিইয়ে রাখে দারিদ্র্য, অসাম্য এবং সরকারি ব্যর্থতা ও নির্যাতন থেকে মানুষের দৃষ্টিকে অন্যদিকে সরানোর উদ্দেশ্যে।”
এরপর আন্তর্জাতিক সম্পর্কের নতুন মেরুকরণে যুক্তরাষ্ট্রে যুদ্ধবাজ প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের ক্ষমতালাভ বহুল আলোচিত এবং স্পষ্টত দৃশ্যমান। এই যুদ্ধের দামামার পেছনে ভারতের ইসরায়েলি মডেল থেকে শিক্ষার বিষয়টি বরং আলোচনা করা যাক। ইসরায়েল মডেলের জন্ম জায়নবাদীদের হাতে যারা ফিলিস্তিন দখল করতে হেন কোনো অপরাধ নেই যা করতে পিছপা হয়।
অস্ট্রেলিয়ান সাংবাদিক অ্যান্টরি লোয়েনস্টেইন তার ‘দ্য প্যালেস্টাইন ল্যাবরেটরি: হাউ ইসরায়েল এক্সপোর্টস দ্য টেকনোলজি অব অকুপেশন অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড’ বইতে লিখেছেন যে, “ইসরায়েল মডেল ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় এক রপ্তানি পণ্য। এই সহিংস মডেল এখন অনেক দেশেই স্বৈরাচারী, গণবিরোধী, নির্যাতনমূলক শাসকদের কাছে অতি প্রিয় ও বহুল ব্যবহৃত। এই মডেলের আওতায় দেশে দেশে তারা মারণাস্ত্র ও নজরদারি সহায়ক যন্ত্রপাতি বিক্রয় করে ও সেসব সরকারের পেটোয়া বাহিনীগুলোকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এসব ইসরায়েলের অন্যতম আয়ের উৎস। আর উল্লেখযোগ্য হলো ভারত এই মডেলের অন্যতম গ্রাহক, ফলে ইসরায়েলি অস্ত্রশস্ত্রের অন্যতম ক্রেতা। ফিলিস্তিন হলো এই ইসরায়েলি মডেলের ল্যাবরেটরি বা পরীক্ষাগার। এই পরীক্ষাগারে উত্তীর্ণ হওয়ার পরই কেবল বিশ্বব্যাপী ভারতসহ তার ক্রেতারা তা কিনে ও প্রয়োগ করে থাকে। বিজেপির নেতৃত্বে বর্তমানের ভারত সরকার ইসরায়েলের কাছ থেকে শিখছে কাশ্মীরকে ঠাণ্ডা করার কলাকৌশল।”
শুরু থেকে ভারত প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বললেও বহু বছর ধরে ইসরায়েলের সঙ্গে তার গোপন আঁতাত গড়ে উঠেছে। ২০১৯-এ কারগিল যুদ্ধে ইসরায়েল ভারতকে অস্ত্র সহায়তা দিলে সে সম্পর্ক দৃঢ় হয়ে ওঠে। এখন তো ভারত-ইসরায়েল বন্ধুত্ব আন্তর্জাতিকভাবে আলোচিত বিষয়, বিশেষ করে ভারতের দর্শনীয় পররাষ্ট্রনৈতিক ও মতাদর্শিক ডিগবাজির জন্য। নেতানিয়াহু ও মোদীর বন্ধুত্ব এখন লৌহদৃঢ়। সুখেদুখে তারা সবসময়ই একে অপরের পাশে থাকার প্রতিজ্ঞা করছেন। একজন গাজায় তৈরি করেছেন নির্যাতনের ল্যাবরেটরি, অন্যজন কাশ্মীরে। একজনের শত্রু ইরান, আরেকজনের পাকিস্তান। গণহত্যার অপরাধ দুজনের কাঁধেই– একজনের গুজরাটে, আরেকজনের গাজায়।
১৯৪০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্র সরকারে কর্মরত মার্কসবাদী অর্থনীতিবিদ এডওয়ার্ড সার্ড চলমান পুঁজিবাদের ‘স্থায়ী যুদ্ধ অর্থনীতি’তে রূপান্তরের তত্ত্ব হাজির করেন। ১৯৪০-এ তিনি লিখেন, “যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপকে অনুসরণ করে অস্ত্রের অর্থনীনৈতিক যুগে প্রবেশ করেছে।” এবং “ওয়াল স্ট্রিট খুব ভাল করেই জানে যে, এই দেশের ‘সমৃদ্ধি’ নির্ভর করছে যুদ্ধ চালানো ও যুদ্ধ বজায় রাখার ওপর।” ১৯৪৪-এ প্রকাশিত হয় তার লেখা টুওয়ার্ডস এ পারমানেন্ট ওয়ার ইকোনমি। যেখানে তিনি এই স্থায়ী ‘যুদ্ধ অর্থনীতি’কে পুঁজিবাদের নবরূপান্তর হিসেবে প্রমাণ করেন। যার বৈশিষ্ট্যমূলক দিক হলো– যুদ্ধ আধুনিক যুগের পিরামিড প্রকল্প। বহু লোকের চাকরি দেয়ার মাধ্যমে যাতে সাময়িকভাবে বেকারত্ব দূর করা যায় সার্বিক জীবনমানের অবনতি ঘটিয়ে। অনুৎপাদনশীল শ্রমে দরিদ্র মানুষকে কাজ দিয়ে তাদেরকে ভুলিয়ে রেখে ফায়দা লোটা যায়। (এডওয়ার্ড সার্ড অ্যান্ড দ্য রাইজ অব পারমানেন্ট ওয়ার ইকোনমি, মার্সেল ভ্যান ডার লিনডেন, জ্যাকোবিন, ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৫)
এই আধুনিক পিরামিড প্রকল্পের একমাত্র উৎপাদিত পণ্য– গণহত্যা। একদেশের রাজা ও আরেক দেশের নবাবের এই প্রকল্পই– বর্তমান ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধযুদ্ধ পরিস্থিতি। লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষ আছে তাদের এই বিধ্বংসী উন্মাদ প্রকল্পের খোরাক হওয়ার জন্য!