Published : 14 May 2025, 03:47 PM
দুটি ঘটনা সম্প্রতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে উত্তাপ সৃষ্টি করেছে। প্রথমটি হলো সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের চিকিৎসার জন্য বিদেশ গমন। গত ৭ মে রাতে তিনি থাইল্যান্ডের উদ্দেশে যাত্রা করেন। দ্বিতীয় ঘটনাটি ঘটে ৯ মে সকালে, যখন নারায়ণগঞ্জের সাবেক মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীকে নাটকীয়ভাবে গ্রেপ্তার করা হয়। আবদুল হামিদের বিদেশযাত্রা ও সেলিনা হায়াৎ আইভী গ্রেপ্তারের মধ্যে কোনো সংযোগ আছে কিনা, তা জানার উপায় নেই। তবে এই ঘটনা দুটোকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তার ফলাফল সুদূরপ্রসারী হতে পারে।
আবদুল হামিদ বাংলাদেশের রাজনীতির অতি পরিচিত এক মুখ। দীর্ঘসময় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেছেন, পরে রাষ্ট্রপতির মতো সম্মানজনক অবস্থানে থেকেছেন। তিনি কোনোদিনই চরম বিতর্কিত রাজনীতিক ছিলেন না। তার সম্পর্কে আগে কেউ এমন অভিযোগ তোলেনি যে, তিনি দুর্নীতিপরায়ণ, প্রতিশোধপরায়ণ বা ক্ষমতার অপব্যবহারকারী। বরং তার সারল্য ও সাধারণ জীবনযাপন তাকে অনেকের কাছে এক ধরনের শ্রদ্ধার জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে তার বিরুদ্ধে একটি মামলা হলেও বিদেশযাত্রার ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা ছিল না।
একজন প্রবীণ মানুষ, যিনি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করেছেন, চিকিৎসার প্রয়োজনে বিদেশযাত্রা তার সাংবিধানিক অধিকার। তিনি নিয়মিত বিমানযোগে গিয়েছেন, গোপনে নয়। তার যাত্রার বিষয়টি গোয়েন্দাদের অজানা থাকার কথা নয়। অথচ কিছু সামাজিক মাধ্যম ও রাজনৈতিক গোষ্ঠী এই যাত্রাকে ‘পলায়ন’, ‘ষড়যন্ত্র’, কিংবা ‘তথ্য লুকিয়ে যাওয়ার’ রূপ দিতে চাইছে। এ ধরনের প্রচারণা সত্যের চেয়ে গুজবের ওপর নির্ভরশীল এবং অন্ধ প্রতিহিংসার প্রকাশ।
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে, যার দায়িত্ব পেয়েছেন তিনজন প্রভাবশালী উপদেষ্টা। কিন্তু তদন্ত শুরুর আগেই প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করা হয়েছে এবং রাজনৈতিক আলোচনা শুরু হয়েছে। একজন অসুস্থ মানুষ কীভাবে ‘রাষ্ট্রবিরোধী কর্মসূচি’ নিয়ে দেশ ছাড়েন— এই প্রশ্নটিও তো অযৌক্তিক নয়।
আমাদের রাজনীতি ক্রমশ মানবিকতা হারাচ্ছে। আবদুল হামিদের বিরুদ্ধে কোনো দুর্নীতির মামলা নেই, রাষ্ট্রদ্রোহের ইতিহাস নেই, এমনকি কোনো অপকর্মের অভিযোগও কেউ কখনো তোলেনি। তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের সহনশীল ও নীতিনিষ্ঠ পথচলা নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষার উৎস হতে পারত।
মানবিক রাজনীতি মানে এমন এক সমাজব্যবস্থা, যেখানে একজন বিরোধীকেও অসুস্থ হলে হাসপাতালে দেখতে যাওয়া হয়। যেখানে ক্ষমতায় থাকলেও প্রতিপক্ষের সন্তানকে চাকরি দেওয়া হয় যদি সে যোগ্য হয়। যেখানে কেউ ভুল করলে তার জন্য মানবিক পুনরুদ্ধারের সুযোগ থাকে। কিন্তু এখনকার রাজনীতিতে সেই জায়গা কই!
আবদুল হামিদের বিদেশযাত্রা নিয়ে এই হৈচৈ, তদন্ত ও প্রশাসনিক ব্যস্ততার মধ্যে আমরা ভুলে বসে আছি যে একটি সমাজের শক্তি কেবল তার উন্নয়নে নয়, তার উদারতায়। একজন অসুস্থ মানুষকে কীভাবে দেখা হয়, তা দিয়েই একটি রাষ্ট্রের সভ্যতা বিচার করা যায়।
নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের কথা খুব উচ্চারিত হচ্ছে। নতুন রাজনীতিতে তো প্রতিপক্ষকে শত্রু নয়, প্রতিযোগী হিসেবে বিবেচনা করার কথা; যেখানে ক্ষমতা থাকবে, কিন্তু ক্ষমতার মাঝে করুণা, শ্রদ্ধা ও বিবেচনার জায়গা থাকবে এবং যেখানে একজন প্রবীণ নেতার চিকিৎসার প্রয়োজনকে ষড়যন্ত্র হিসেবে নয়, দায়িত্ব হিসেবে দেখা হবে। কিন্তু কোথায় তা?
২.
নারায়ণগঞ্জ শহরের ইতিহাসে দীর্ঘসময় ধরে যিনি এক প্রতীক হয়ে উঠেছিলেন, সেই ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভীকে হঠাৎ গ্রেপ্তার করা কেন জরুরি হয়ে উঠল? তিনি শুধু সাবেক মেয়র নন, একজন দৃঢ়চেতা রাজনীতিক, যিনি পরিবারতন্ত্র ও দুর্বৃত্তায়নের বিরুদ্ধে অবিচল ছিলেন। হঠাৎ তাকে রাতের বেলায় গ্রেপ্তার করা কোন রাজনীতির কথা বলে?
আইভী আওয়ামী লীগের মধ্যে থেকেও ব্যতিক্রমী ছিলেন। শেখ হাসিনার অন্ধ অনুসারী না হয়ে তিনি অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন। দলের অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে তার দৃঢ় অবস্থানই তার প্রধান ‘অপরাধ’ বলে অনেকে মনে করেন।
দীর্ঘ ২১ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জের জনগণের জন্য কাজ করেছেন আইভী। চুনকা পরিবারের সন্তান হয়েও তিনি কর্মযোগী মেয়র হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, জনস্বাস্থ্য, নগর পরিকল্পনা ও সামাজিক সমস্যা মোকাবিলায় তিনি নিরলস কাজ করেছেন। সমালোচনার মুখেও তিনি জনগণের আস্থা অর্জন করেছেন। তাই তার গ্রেপ্তার ঠেকাতে রাতভর তার বাড়ির ফটক অবরোধ করেছিলেন সাধারণ মানুষ। তারা জানেন, আইভী শুধু রাজনীতিক নন, প্রতিবাদের এক কণ্ঠস্বর।
পুলিশ জানিয়েছে, আইভীর বিরুদ্ধে পাঁচটি মামলা রয়েছে, যার মধ্যে হত্যার অভিযোগও আছে। প্রশ্ন হলো, এতদিন তিনি কি পলাতক ছিলেন? তিনি তো নিজ বাড়িতে, প্রকাশ্যে ছিলেন, সাংবাদিকদের সামনে বক্তব্যও দিয়েছেন। তাহলে কেন রাতের আঁধারে গ্রেপ্তার অভিযান? কেন জনরোষের মুখে দিনের আলো ফোটার অপেক্ষা করতে হলো? এসব প্রশ্নের উত্তর কে দেবে?
আইভী শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, সারা দেশে সাহসী নারী নেতৃত্বের প্রতীক। ত্বকী হত্যার ঘটনায় তার অবস্থান ছিল বিরল। যখন অনেকে নীরব ছিলেন, তখন তিনি দৃপ্ত স্বরে বলেছিলেন– বিচার চাই। তখন ক্ষমতার অনেক শীর্ষস্থানে থাকা লোকজন চেয়েছিলেন তাকে থামিয়ে দিতে। কিন্তু তিনি থামেননি। সেই ধারাবাহিকতায় যখন তিনি দলের ভেতরের অন্যায়ের বিরুদ্ধেও আওয়াজ তুলেছেন, তখন রাজনৈতিক সুবিধাভোগীরা তাকে 'আপদ' মনে করতে শুরু করেছিল।
রাজনীতিতে বিরুদ্ধমত থাকা অপরাধ নয়— এই সত্যটিই বারবার বিস্মৃত হচ্ছে আমাদের প্রশাসন ও শাসকগোষ্ঠী। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে স্থানীয় রাজনীতিতে দুর্বৃত্তায়ন, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি ও গডফাদারদের আধিপত্য স্বীকৃত হয়ে উঠেছে। আইভী এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেও আজ 'অবাঞ্ছিত' হয়ে গেলেন কেন? নারায়ণগঞ্জে শামীম ওসমান ও আইভীর দ্বন্দ্ব মূলত দুই ধরনের রাজনীতির সংঘাত— একদিকে প্রতিহিংসা, অস্ত্র ও ভয়ের রাজনীতি, অন্যদিকে নাগরিকতা, মানবিকতা ও সংলাপের রাজনীতি। এই দ্বন্দ্বে কোন পক্ষের জয় হওয়া উচিত?
বর্তমান সরকার ও সরকারের সমর্থকরা বৈষম্যহীনতার কথা বলছেন। তারা বলছেন, অতীতের অন্যায় ব্যবস্থা ভেঙে নতুন ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়বে। একজন জনপ্রিয়, কর্মযোগী, আপসহীন নেত্রীকে যেভাবে গ্রেপ্তার করা হলো, তা কতটা সাম্যের পরিচয় দেয়?
রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক স্বাভাবিকতা তখনই ফিরবে, যখন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও ভিন্নমতালম্বীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তির অপব্যবহার বন্ধ হবে। আইভীর মতো নেত্রীরা রাজনীতিতে থাকলে নতুন প্রজন্ম বুঝতে পারবে, রাজনীতি মানে শুধু সুবিধা নয় বরং সাহস, সততা ও ন্যায়ের পথে হাঁটা। এই পথ রুদ্ধ করে দিলে রাজনীতির মাঠ ফাঁকা হয়ে যাবে সুবিধাভোগীদের দখলে।
আর যারা সত্যিই অপরাধী, দুর্নীতিবাজ, খুনি— তারা এখনও কেন ধরাছোঁয়ার বাইরে? দেশে এখনও কিছু মানুষ আছেন যারা নিজের অবস্থানে অবিচল। আমরা কি তাদের জায়গা দিতে পারছি?
আমরা কি পারি, এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে?
মানুষের অধিকার হরণ, ভিন্নমত দলন, দম্ভ ও অহমিকা শেখ হাসিনার পতন অনিবার্য করে তুলেছিল— এই বিষয়টি আমাদের মনে রাখা দরকার।