Published : 06 Apr 2013, 12:06 PM
এ মুহূর্তে দেশ এক ভয়ঙ্কর সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। সবাই চিন্তিত, আতঙ্কিত, বিস্মিত। এ কী হচ্ছে? এখন রাতগুলোও যেন হরতালের কালো থাবার নিচে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না। কিন্তু কেন? এমন যে ঘটবে সে কথা কি আমরা জানতাম না? বিয়াল্লিশ বছর ধরে এ আশঙ্কার কথা কি প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক সুধীজন বলে যাচ্ছিলেন না?
একাত্তরে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ চালানোর পরও দোষীদের বিচার বা শাস্তি হয়নি। বরং তারা জনসমর্থনহীন সেনা ছাউনি থেকে আগত নেতাদের দলগঠনের প্রচেষ্টায় সেসব ভুঁইফোড় দলে আশ্রয় পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় উচ্চপদে আসীন হয়ে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে পুষ্ট হয়েছে। ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে রাজনীতিবিদরা তাদের এ বিকাশ ও পুষ্টিতে বাধা তো দেয়ইনি বরং সমর্থন যুগিয়েছে।
আজ একাত্তরের পরাজিত শক্তি, চারাগাছ থেকে একটি পরিপুষ্ট বিষবৃক্ষে পরিণত হয়েছে। এ বিষবৃক্ষের যে বিষাক্ত ফল আমরা সবাই ভক্ষণ করেছি তার বিষক্রিয়ায় নীল হয়ে উঠেছে সমগ্র দেশের শরীর। সে বিষাক্ত ফল খাওয়ার সময় তো এর পরিণাম নিয়ে আমরা ভাবিনি। ইবনে সিনায় রক্ত পরীক্ষা বা চিকিৎসা করানোর সময়, ইসলামী ব্যাংকে টাকা রাখার সময়, কেন এ চিন্তা করা হয়নি যে এর লাভ দিয়েই এদেশের ছেলেদের বুকে গুলি করার জন্য তারা বন্দুক কিনবে? মানারাত স্কুলে মেয়েকে পড়িয়েছেন আর ডাক্তার বানানোর আশায় তাকে রেটিনাতে কোচিং করিয়েছেন- একবারও কি মনে পড়েনি যে আপনার টাকা দিয়ে পুষ্ট হয়েই একদিন আপনার মেয়ের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন ওরা গুঁড়িয়ে দিবে!
আমি চিন্তিত হলেও বিস্মিত নই। দুধকলা দিয়ে যে ধর্মান্ধ সাপ আমরা পুষেছি তা আজ ফণা তুলে দাঁড়িয়েছে। এখন দৌড়ে পালাতে পারবেন না। সাপের সঙ্গে দৌড়ে জেতা যায় না। এবার সে হয় আপনাকে ছোবল দিবে, না হয় আপনি তার টুটি চেপে ধরে বিষদাঁত গুঁড়িয়ে দিবেন। বিয়াল্লিশ বছর ধরে প্রায় প্রতিটি ক্ষণে এ আশঙ্কার কথা উচ্চারিত হয়েছে সচেতন মহল এবং গুণীজনদের মুখে মুখে। শুধু মুখেই বলেছি আমরা যে, সত্যি সত্যিই একদিন এদেশীয় তালেবানরা হুঙ্কার দিয়ে দাঁড়াবে, কিন্তু বাস্তবে হয়তো অনেকেই একে সমস্যা বলে মনে করিনি।
ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মহীনতার মধ্যে যে বিশাল ব্যবধান তা বোঝার জন্য শিক্ষার প্রয়োজন। গভীরভাবে ধার্মিক একজন ব্যক্তিও ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারেন। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে নাস্তিকতা নয়। যারা নাস্তিক তারা স্রষ্টার অস্তিত্বেই বিশ্বাস করেন না। কিন্তু ধর্মনিরপেক্ষ একজন ব্যক্তি ধর্মবিশ্বাসী বা জীবনাচরণে ধর্মের অনুশাসন মেনে চলা ধার্মিক ব্যক্তি হতে পারেন। কিন্তু তিনি বিশ্বাস করেন যে, ধর্ম ব্যক্তিগত পবিত্র বিশ্বাস, যা নিয়ে রাজনীতি করা চলে না। এরা বিশ্বাস করেন ধর্মের নামে অন্য ধর্মে বিশ্বাসী কারও উপর খড়গ তোলা যায় না। তারা চান একটি সুন্দর পৃথিবী যেখানে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি কোনো কিছুই বিবেচ্য হবে না, মানবতাই যেখানে সবার প্রেরণা। সবাই সবাইকে ভালবাসবে, সম্মান করবে, একজনের অধিকার কোনো যুক্তিতেই অন্যজন খর্ব করবে না- এটাই কি সকল ধর্মের শান্তির বাণী নয়?
জামায়াত যে সহিংসতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে এ দেশের মানুষের উপর তা কি ইসলামের শান্তির বাণীর পরিপন্থী নয়? ইসলামের এমন ব্যবহারে কেন মুসলমান হিসেবে আমাদের ক্ষোভ হবে না? এ কি আমাদের ঈমানের দুর্বলতার বহিঃপ্রকাশ নয় যে, আমরা শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে উচ্চকন্ঠে বলতে পারছি না- 'না, আমাদের নাস্তিক, মুরতাদ, কাফের বলার অধিকার কারও নেই। আমরাও মুসলমান। ইসলাম আমারও ধর্ম। আমাকে অন্য মুসলমান কোন স্পর্ধায় নাস্তিক, মুরতাদ, কাফের বলবে? একমাত্র মহান আল্লাহতাআলা জানেন তাঁর বিচারে কে মুমিন মুসলমান। এ বিচারের অধিকার আর কারও নেই।'
কে নাস্তিক, কে কাফের, কে মুরতাদ এ বিচারের সোল এজেন্সি জামাত ও এর সহযোগী দলগুলোকে কে দিয়েছে? তারা আমাদের ঈমানের বিচার করার কে? ঈমানের বিচার করার মালিক একমাত্র আল্লাহতাআলা।
কেন আমরা স্পষ্ট করে বলছি না যে, ইসলামকে যারা ভোটের রাজনীতির জন্য ব্যবহার করে তারা ইসলামের পবিত্রতা বিনষ্ট করছে! তারা ক্ষমতায় যাওয়ার সিঁড়ি হিসেবে ইসলামকে ব্যবহার করছে! এটা পবিত্র ধর্ম ইসলামের অবমাননা। মুসলমান হিসেবে তাতে কি আমাদের বাধা দেওয়া উচিত নয়? পাশাপাশি নিজের দেশের লোকের বিরুদ্ধে, অন্য মুসলমানের বিরুদ্ধে ওরা অস্ত্র তুলছে। ইসলাম কি তা সমর্থন করে? আফসোস এটাই যে, সহস্র বছরে বাংলায় যে উদার ধর্মচর্চার ধারা প্রোথিত হয়েছিল, সুফীবাদ ও অহিংসার যে শান্তিময় ইসলামের প্রতিচ্ছবি বাংলার ঐতিহ্য- তাকে হিংসাত্মক তালেবানি, জঙ্গী এক চেহারা দিয়ে দিল জামায়াত।
বিয়াল্লিশ বছর ধরে আমাদের নষ্ট রাজনীতির ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে উঠেছে একাত্তরের পরাজিত, হত্যা-ধর্ষণকারী-ধর্মান্ধ শক্তি। আজ তারা এত শক্তিশালী যে, সারাদেশে নারকীয় তাণ্ডব চালাচ্ছে, পুলিশবাহিনির সদস্যদের মেরে মাথা থেঁতলে দিচ্ছে- কিন্তু তাদের থামানো যাচ্ছে না। আজ তারা অর্থে, বিত্তে, অস্ত্রে, বহির্বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগে, বহির্বিশ্বের ভাড়াটে লবিষ্ট ও আইনজীবীদের আস্ফালনে অনেক শক্তিশালী। আজ সমগ্র দেশ তাদের তাণ্ডবলীলায় ভীত, কম্পিত!
ভয়ের কারণ আছে বটে। কিন্তু তাই বলে কি আমরা তাদের মোকাবিলা করব না? জীবনের ভয়ে একাত্তরের পরাজিত এ অপশক্তির কাছে বিনা যুদ্ধে দেশমাতৃকাকে তুলে দিতে পারি না। তাহলে আর কেমন সন্তান আমরা? চোখ-কান বুঁজে থাকলে এ ঝড় থামবে না। গোপন আঁতাত করে, পিঠে হাত বুলিয়ে তাদের শক্তি প্রদর্শন থেকে বিরত রাখা যাবে না। কখনওই না। কারণ তারা আজ ক্ষমতার লিপ্সায়, রক্তের নেশায় মাতোয়ারা। আফগানিস্তান, পাকিস্তান তাদের সামনে দৃষ্টান্ত। ওখানে তাদের ভাইদের সফলতায় তারা জেহাদী জোশে মাতোয়ারা। তাদের আকাঙ্ক্ষা ও গন্তব্য স্পষ্ট।
এখন প্রশ্ন হল আমরা কী চাই, কী করব আমরা? এদেশকে আরেকটি আফগানিস্তান বা পাকিস্তান হতে দিব? যদি তা হতে দিতে না চাই তবে লড়াই ছাড়া পথ নেই।
দেশের এ অবস্থায় যারা ভাবছেন দেশ ছেড়ে চলে যাবেন তারা চলে যান। মায়ের খেয়ে বড় হওয়া বিদেশের তাবেদার ছেলে না থাকলেই বরং মায়ের শান্তি। যারা আপোষ করতে চান তাদের জন্য রাস্তা তো খোলাই আছে। মীরজাফরের মতো আপনাদের নামও ঘৃণাভরে বিস্মৃত হবে সবাই। যারা ভীত হয়ে ঘরে বসে থাকতে চান, আত্মরক্ষার অধিকার তাদের আছে।
শুধু একটু ভেবে দেখুন- সময়ের পরীক্ষা বারবার আসে না। আপন আয়নায় যদি মাথা হেঁট হয়ে যায়, তবে সে জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার সার্থকতা আছে কি? সময়ের এ পরীক্ষায় পাশ করলেই শুধু মাথা উচুঁ করে বেঁচে থাকা সম্ভব। আর মায়ের যে গুটিকয়েক ছেলে রাস্তায় নেমে, বুক পেতে, মাকে রক্ষার জন্য লড়াই করতে চান- আপনাদের সালাম। আপনারা এগিয়ে আসুন, মা আপনাদেরই মুখ চেয়ে আছেন। আসুন রাজপথে, গর্বিত দৃপ্তপদে। আপনাদের মতো ছেলেমেয়েরই আজ বাংলা মায়ের বড় প্রয়োজন।
বাংলা মায়ের আজ এক ক্রান্তিকাল চলছে। একে অস্বীকার করার অথবা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। কোনো সংলাপে বা আপোষেই এ সংকট কাটবে না। কেবল অযথা হবে কালক্ষেপণ, বাড়বে সংকট। বালিতে মুখ গুঁজে থাকলেই কি ধুলিঝড় থেমে যায়? বালি থেকে মুখ বের করুন। চোখ খুলুন, দেখুন ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডব কীভাবে লণ্ডভণ্ড করে দিতে চাচ্ছে আমাদের প্রিয় দেশ, আমাদের সব অর্জন।
তাই আজ পিছু হটার সুযোগ নেই। বরং এই ভালো। এবারই হয়ে যাক এসপার-ওসপার। চার দশক পার হয়ে গেছে, এ সময়ে এদেশের শত্রুরা শক্তিতে বেড়েছে শতগুণ। কালক্ষেপণ করলে তারা আরও পুষ্ট ও হিংস্র হবে। তখন আমাদের সন্তানদের ওপর এ লড়াই চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পড়বে। নয়তো তাদের আত্মসমর্পন করতে হবে মাথা হেঁট করে।
যদি ঝরতেই হয় ঝরুক আমাদের রক্ত। তবু বসবাসযোগ্য করে দিয়ে যাব এ দেশ আমার মেয়ের জন্য, আমার ছেলের জন্য। এ শিক্ষাই দিয়ে গেছেন আমাদের পূর্বসূরী সেই ৩০ লাখ শহীদ। আমরা তাই থেমে যাব না।