Published : 19 Jun 2025, 11:45 AM
গ্রামপ্রধান বাংলাদেশে এখনও গ্রামই অর্থনীতির মূল ভিত্তি। সামষ্টিক অর্থনীতির হিসাবে গ্রাম ও শহর কিংবা নারী ও পুরুষের পৃথক অবদান স্পষ্ট না হলেও, গ্রামীণ অর্থনীতির শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। পাশাপাশি এটাও স্বীকার করতে হয় যে, এ ক্ষেত্রে নারীর অবদান অপরিসীম, যা প্রায়শই অস্বীকার করার চেষ্টা করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, তৈরি পোশাক খাতে নারীর অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি।
গ্রামে বসেও নারীরা অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। পাবনার বেড়া উপজেলার মাহফুজা মীনার কথাই ধরা যাক। তিনি একাধারে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা, গৃহিণী এবং সফল খামারি। তার জীবনের সাফল্যের গল্প এখন বইয়ের পাতায় স্থান পেয়েছে।
২০১০ সালে মাত্র ১০-১২টি গরু দিয়ে শুরু করে এখন তার ‘মীনা ডেইরি ফার্মে’ রয়েছে ৬০টিরও বেশি দেশি-বিদেশি জাতের গরু। এই ফার্ম থেকে প্রতিদিন গড়ে ৩০০ লিটার দুধ উৎপাদিত হয়, যা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ইগলু ও অন্যান্য দুগ্ধ প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা হয়। মাহফুজা মীনার মতে, নারী চাইলে সফল উদ্যোক্তা হতে পারেন, তবে এর জন্য পরিশ্রম ও ত্যাগের প্রয়োজন।
শুধু মীনা নন, সারা বাংলাদেশে অসংখ্য নারী গ্রামীণ অর্থনীতিতে সরাসরি ভূমিকা রাখছেন। এই অবদান, হিসাবে আলাদা না হলেও, দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে গতিশীল করছে। অর্থনীতি বলতে শুধু শিল্প-কারখানায় উৎপাদন, বিপণন বা মজুরিভিত্তিক চাকরির ধারণা আংশিক মাত্র।
গ্রামপ্রধান বাংলাদেশে শহুরে জীবনযাত্রা শুরুর আগে গ্রামভিত্তিক অর্থনীতিই ছিল মূল ভিত্তি। তখন কারখানার উপস্থিতি কম ছিল, আর কৃষিই ছিল গ্রামীণ অর্থনীতির প্রধান উৎস। এখনও তাই আছে। তবে নারী-পুরুষের কাজের ক্ষেত্র বেড়েছে। সভ্যতার শুরুতে নারীর হাত ধরেই কৃষির যাত্রা শুরু হয়েছিল। সময়ের সঙ্গে পুরুষের অংশগ্রহণ বাড়লেও নারীরা এখনও কৃষিকাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। গ্রামের প্রতিটি বাড়ির আঙিনায় সবজি চাষ একটি সাধারণ দৃশ্য, যা নারীরা করে থাকেন। এগুলো ছোট হলেও পরিবারের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ।
গ্রামই আমাদের জীবনের প্রাণকেন্দ্র। দেশের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। তাদের কঠোর পরিশ্রমে অর্থনীতি ধীরে ধীরে মজবুত হয়। যদিও সেই ছায়াঘেরা গ্রাম এখন আর নেই, কারণ গ্রামগুলোও আধুনিকতার ছোঁয়া পেয়েছে। গ্রামীণ রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে, কৃষিতে আধুনিক প্রযুক্তি এসেছে, শিক্ষা ও চিকিৎসার প্রসার ঘটেছে, অকৃষি খাত ও আর্থিক সেবার বিকাশ হয়েছে।
অনেক নারী এখন গ্রামে চায়ের দোকান বা মুদির দোকান চালাচ্ছেন। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়েছে। গ্রাম শহরের ভিত্তি। গ্রাম বাঁচলে বাংলাদেশ বাঁচবে। গ্রাম শক্তিশালী হলে শহরের উন্নয়ন সম্ভব। কিছু মানুষ আয়ের আশায় গ্রাম থেকে শহরে গেলেও, গ্রামে সামাজিক বাধা, বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে, একটি বড় কারণ। নারীদের পরিবার বা সমাজ থেকেই বাধা দেওয়া হয়। গ্রাম হওয়া উচিত পরিকল্পিত আয়ের ক্ষেত্র, যেখানে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভব।
বাংলাদেশের অর্থনীতির শক্তিশালী খাত হলো রেমিটেন্স। বিদেশ থেকে আসা রেমিটেন্সের বড় অংশ গ্রামভিত্তিক। সংক্ষেপে, গ্রামই অর্থনীতির প্রাণ। জীবন ও জীবিকার বড় অংশ গ্রামনির্ভর। গ্রামের কৃষি, মাছ চাষ, খামার, তাঁতশিল্প—এসব কেন্দ্র করেই দেশের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। সেখানে প্রতিটি কাজে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ রয়েছে। এছাড়া গ্রামে অনেক কারখানা গড়ে উঠেছে, যেখানে নারী-পুরুষ সমানতালে কাজ করছেন।
বৃহৎ অর্থনীতির ভিত্তি হলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা। তবে সমাজ এখনও নারীর অবদান স্বীকারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে না। শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির দিকে যতই এগোই না কেন গ্রামীণ অর্থনীতি আজও দেশের অন্যতম চালিকাশক্তি। গ্রামে ছোট-বড় শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে, যেখানে অসংখ্য নারী-পুরুষ কাজ করছেন। উৎপাদন খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। গ্রামীণ অর্থনীতি জীবন, জীবিকা, স্বনির্ভরতা ও তরুণ উদ্যোক্তা তৈরিতে অবদান রাখছে। এর গতিপ্রকৃতি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিকে প্রভাবিত করে।
সময়ের সঙ্গে নারীর কর্মক্ষেত্র বিস্তৃত হয়েছে। কাজের বহুমুখীকরণ ঘটেছে। উদাহরণ হলো পরচুলা তৈরির কাজ। পরচুলা, নকশি কাঁথা, বাঁশের ডোল-চাঁটাই তৈরিতে নারীর অংশগ্রহণ বেশি। মাহফুজা মীনার উপজেলায় নারীরা পরচুলা তৈরির কাজে নিয়োজিত, যা তাদের পরিবারে স্বচ্ছলতা এনেছে। গ্রামের নারীরা নাকফুল তৈরিতেও ব্যস্ত। একজন নারী দিনে প্রায় শতাধিক নাকফুল তৈরি করেন, যার আয় সন্তানদের শিক্ষায় ব্যয় হয়। এছাড়া হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালনও করছেন। পাশাপাশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে নারীরা সমান যোগ্যতায় চাকরি করছেন। অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হলে গ্রামীণ অর্থনীতিই হতে পারে প্রধান হাতিয়ার। ব্যবসা-বাণিজ্যে নারীর নেতৃত্ব বেড়েছে। এক দশকে পাঁচগুণের বেশি প্রতিষ্ঠানে নারী নেতৃত্ব এসেছে। পরিবার সামলে, সমাজ টপকে এগিয়ে চলা নারীরাই গ্রামের ভিত মজবুত করছেন, অথচ তাদের স্বীকৃতি এখনও অনেক দূরের পথ।
গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে পারলে সামগ্রিক অর্থনীতিও এগিয়ে যাবে। গ্রামের নারী ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে তুলতে হবে। এতে তাদের মনোবল বাড়বে। সহজ ঋণের ব্যবস্থা ও নারীদের ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ দিতে হবে। তাঁত ও পোল্ট্রি শিল্পে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে হবে। কৃষি শক্তিশালী করতে নারীর অংশগ্রহণের বিকল্প নেই। গ্রামীণ অর্থনীতির সব খাতকে উজ্জীবিত করতে হবে, যা ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে। বেকারত্ব দূর করতে নতুন খাতে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে এবং নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। নারীর হাতে গ্রামীণ অর্থনীতির জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুক এবং ক্রমে বৃদ্ধি পাক।