Published : 04 Apr 2025, 04:27 PM
প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প ২ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতিতে বড় রকমের পরিবর্তন এনেছেন। নতুন এই নীতিতে সব দেশের আমদানিকৃত পণ্যে ১০ শতাংশ ভিত্তি শুল্ক ধার্য করা হয়েছে, যেসব দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি আছে তাদের জন্য এই হার আরও বেশি। এই নীতির উদ্দেশ্য হলো অন্য দেশগুলোর বর্তমান বাণিজ্যিক অনুশীলনকে আরও ‘ন্যায্য’ করে তোলা। প্রস্তাবিত এই শুল্কের হার নির্ধারণ করা হয় প্রতিটি দেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতির ভিত্তিতে, যা রপ্তানির পরিমাণ দ্বারা ভাগ করে অর্ধেক করা হয়। এই নীতির মূল লক্ষ্য হলো আমেরিকার দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ঘাটতি শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে আসা।
যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘমেয়াদী বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে এই নীতি গ্রহণ করা হয়েছে। শুধু শুল্ক নয়, অ-শুল্ক বাধাগুলো (যেমন— বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ, মুদ্রা হেরফের, নীতিগত বৈষম্য) মোকাবেলা করাও একটি কৌশল। এটির আরেকটি লক্ষ্য হলো আমদানি কমিয়ে স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানো এবং বাণিজ্য ভারসাম্য শূন্যের কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া। যুক্তরাষ্ট্রের এই নীতি শুল্কের মাধ্যমে বাণিজ্য ন্যায্যতা আনার চেষ্টা, কিন্তু এটি আসলে একটি বড় কৌশলগত পরিকল্পনার অংশ। এর ফলে মার্কিন উৎপাদনশীলতা বাড়তে পারে, কিছু খাতে চাকরির সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। আবার অপরদিকে ভোক্তাদের জন্য পণ্যের দাম, বিশেষত ইলেকট্রনিক্স, গাড়ি, কাপড়, বৃদ্ধি পেতে পারে। আবার বৈশ্বিক শুল্ক যুদ্ধের ঝুঁকি ও আছে যা অর্থনীতিকে মন্দার দিকেও ঠেলে দিতে পারে।
বাংলাদেশের উপর প্রভাব
বিশ্বের পোশাক শিল্পের একটি প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে বাংলাদেশ এই নতুন নীতির আওতায় যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানিকৃত পণ্যে ৩৭ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হচ্ছে। বাংলাদেশ প্রতি বছর যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮৪০ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি করে, যা দেশের মোট তৈরি পোশাক রপ্তানির ২০ শতাংশ। শুল্কের এই উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে, যা দেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশ এবং ৪০ লাখেরও বেশি মানুষের কর্মসংস্থানের উৎস। শুল্ক বৃদ্ধির ফলে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশী পোশাকের দাম বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে ক্রেতারা অন্য সস্তা বাজার খুঁজতে পারে এবং বাংলাদেশ বাজার হারাতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, প্রধান একটি উৎপাদক প্রতিষ্ঠান আর ডি এম গ্রুপের চেয়ারম্যান রাকিবুল আলম চৌধুরী বলছেন যে ক্রেতারা অন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজারে চলে যাবে, যা এই শিল্পের জন্য একটি বড় ধাক্কা হবে। ২০২৪ সালে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এখনও সংকট কাটাতে পারেনি এবং নতুন এই শুল্ক আরোপ পরিস্থিতিকে আরও খারাপ করতে পারে। পোশাক ছাড়াও অন্যান্য রপ্তানি খাতের ওপর প্রভাব পড়বে। শুল্কের কারণে দাম বাড়লে মার্কিন বাজারে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা কমতে পারে। চামড়া ও নন-লেদার জুতা রপ্তানিতে ধস নামতে পারে। চিংড়ি ও অন্যান্য সিফুডের রপ্তানি কমলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে চাপ পড়বে।
যদিও বাংলাদেশ ৩৭ শতাংশ শুল্কের মুখোমুখি হচ্ছে, তার কিছু প্রতিযোগী যেমন চীন ও ভিয়েতনামের জন্য এই হার যথাক্রমে ৫০ ও ৪৬ শতাংশ। এই আপেক্ষিক সুবিধা বাংলাদেশের জন্য কিছুটা স্বস্তি দিতে পারে। তবে আমদানির খরচ বৃদ্ধির ফলে মার্কিন ভোক্তাদের জন্য দাম বেড়ে যেতে পারে এবং বিশ্বব্যাপী সরবরাহ শৃঙ্খলে বিঘ্ন ঘটতে পারে। কিন্তু আমাদের নিজেদের প্রশ্ন করা উচিত স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও কেন আমরা একটি মাত্র পণ্য আর দু-তিনটি প্রতিযোগী দেশ নিয়ে ব্যাপক মাথা ঘামাচ্ছি। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য ঘাটতি ছিল $৬.২ বিলিয়ন। শুল্ক ঘোষণার পর থেকে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা বাড়ছে, যা বাংলাদেশের রপ্তানিকে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে প্রভাবিত করতে পারে। বাংলাদেশ কিংবা অন্যান্য দেশ পাল্টা শুল্ক দিলে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য সম্পর্কে টানাপোড়েন বাড়তে পারে। অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করেছেন যে এমন শুল্কের ফলে অন্য দেশগুলো থেকে পাল্টা ব্যবস্থা আসতে পারে, যা বাণিজ্য উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
বাংলাদেশের কৌশল কি হতে পারে?
প্রথমত দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করা উচিত।বাংলাদেশের উচিত বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা শুরু করা। শুল্ক হ্রাস বা বিশেষ শুল্ক কোটা চেয়ে লবিং করতে হবে। সরাসরি হোয়াইট হাউস ও মার্কিন বাণিজ্য বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগ করলে আরোপিত শুল্ক পুনর্বিবেচনা করা হতে পারে। বাংলাদেশ তার পণ্যগুলোকে ‘সাশ্রয়ী মূল্যের অত্যাবশ্যক পণ্য’ হিসেবে উপস্থাপন করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক রেয়াতের জন্য আলোচনা করতে পারে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের টেকনিক্যাল বাধা সংস্কারের দাবি করেছে। এসব অ-শুল্ক বাধা কমালে শুল্কের সামগ্রিক প্রভাব হ্রাস পেতে পারে। অবশ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ইতিমধ্যেই শুল্ক যুক্তিসঙ্গত করার বিকল্পগুলো চিহ্নিত করছে, যা এই বিষয়টি সমাধানের জন্য প্রয়োজন।
আমাদের রপ্তানি বাজারে বৈচিত্র্য আনা দরকার। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারের ওপর নির্ভরতা কমাতে বাংলাদেশের উচিত রপ্তানির নতুন গন্তব্য খুঁজে বের করা। এশিয়া, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় নতুন বাজার অন্বেষণ করা যেতে পারে। এছাড়া ভারত ও চীনের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে আঞ্চলিক সম্পর্ক জোরদার করে বিকল্প বাজার তৈরি করো যেতে পারে এবং সামগ্রিক শুল্কের বোঝা কমাতে পারে। সাফটা (দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চল) এবং বিমসটেকের মাধ্যমে ভারত, নেপাল ও ভুটানের সঙ্গে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সম্প্রসারণ করা উচিত। অদূর ভবিষ্যতে মুক্ত বাণিজ্য জোট রিজিওনাল কম্প্রিহেনসিভ ইকোনমিক পার্টনারশিপে (আরসিইপি) ও কম্প্রিহেনসিভ অ্যান্ড প্রোগ্রেসিভ অ্যাগ্রিমেন্ট ফর ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (সিপিটিপিপি)-তে যোগদানের প্রস্তুতি নিয়ে এই মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিগুলোতে অংশ নেওয়া। চীন ও দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় জাতি সংস্থা (আসিয়ান) বাজারে প্রবেশের পথও খোলা প্রয়োজন।
হাই-অ্যান্ড পণ্যে স্থানান্তর ও একটি অপশন হতে পারে আমাদের জন্য। সাধারণ টি-শার্টের বদলে প্রিমিয়াম ফ্যাশন, টেকনিক্যাল টেক্সটাইল (যেমন: ফায়ার-রেজিস্টেন্ট ফেব্রিক) উৎপাদনে জোর দেওয়া উচিত। পাশাপাশি পণ্যের মান ও গুণগত মান বৃদ্ধি ও প্রয়োজন। রোবটিক স্টিচিং, এআইভিত্তিক কোয়ালিটি কন্ট্রোল সিস্টেম চালু করা। রিয়েল-টাইম ডেটা অ্যানালিসিস, মার্কিন শুল্ক নীতির পরিবর্তন ও ক্রেতাদের চাহিদা ট্র্যাক করতে এআইভিত্তিক মার্কেট ইন্টেলিজেন্স সিস্টেম চালু করা। উচ্চ মূল্য সংযোজনযুক্ত পোশাক ও পণ্য উৎপাদনের দিকে ঝুঁকলে শুল্ক বৃদ্ধি সত্ত্বেও বাংলাদেশ তার প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে পারে। লিডারশিপ ইন এনার্জি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল ডিজাইন (এলইইডি) সনদ পাওয়া গ্রিন ফ্যাক্টরিগুলোকে মার্কিন ক্রেতাদের কাছে প্রচার করা যেতে পারে, কারণ সেক্ষেত্রে হয়তো পরিবেশবান্ধব পণ্যে শুল্ক ছাড় পাওয়া যেতে পারে। টেকসই ও নৈতিক উৎপাদন পদ্ধতিতে বিনিয়োগ করলে পরিবেশবান্ধব ও সামাজিকভাবে দায়িত্বশীল সোর্সিং খোঁজা ক্রেতাদের আকর্ষণ করা যেতে পারে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নীতি ও অবকাঠামো উন্নয়ন প্রয়োজন। যুক্তরাষ্ট্রের নতুন বাণিজ্য নীতির চাপে বাংলাদেশের আমদানি শুল্ক কাঠামো সংস্কারের অতি প্রয়োজন। সরকারের উচিত যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করা পণ্যের শুল্ক কাঠামো পর্যালোচনা করা এবং এই পরিবর্তনগুলো মার্কিন বাণিজ্য বিভাগকে জানানো যাতে তারা পাল্টা শুল্ক সমন্বয়ে উৎসাহিত হয়। এছাড়া লজিস্টিকস, পরিবহন ও অন্যান্য অবকাঠামোতে বিনিয়োগ করলে কার্যক্রম খরচ কমানো যায় এবং দক্ষতা বাড়ে। মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের দক্ষতা বাড়ানো এবং ডিজিটাল কাস্টমস সিস্টেম চালু করা ভীষণ জরুরি। আমদানি করা কাঁচামাল ও মেশিনারিতে শুল্ক হ্রাস করে স্থানীয় উৎপাদন খরচ কমানো উচিত। তার পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগ উৎসাহিত করাও দরকার। পোশাক শিল্পে বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগ (এফডিআই) উৎসাহিত করলে নতুন প্রযুক্তি ও দক্ষতা আসতে পারে, যা শিল্পের প্রতিযোগিতা বাড়াবে। সরকারের উচিত বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে প্রণোদনা ও সহায়তা দেওয়া এবং অনুকূল ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করা। স্বয়ংক্রিয়তা ও আধুনিক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করলে উৎপাদনশীলতা বাড়ে এবং শ্রম খরচ কমে, যা শুল্ক বৃদ্ধি সত্ত্বেও খরচের সুবিধা ধরে রাখতে সাহায্য করে। চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইইউভিত্তিক কোম্পানিগুলোর সঙ্গে টেকনোলজি ট্রান্সফার চুক্তি করা দরকার। এছাড়া দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ওপর জোর দিলে কর্মীদের উৎপাদনশীলতা ও দক্ষতা বাড়ে। বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ-কে সঙ্গে নিয়ে কারিগরি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট স্থাপন করা । পাশাপাশি আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ করতে বিশেষায়িত অর্থনীতিক অঞ্চল করে ওয়ান-স্টপ সার্ভিস চালু হওয়া উচিত।
যুক্তরাষ্ট্রের পারস্পরিক শুল্ক নীতির লক্ষ্য হলো বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা দূর করা, কিন্তু এটি বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি করেছে। যদিও এই নীতির কিছু কৌশলগত যুক্তি থাকতে পারে, এর বাস্তবায়ন বিস্তৃত অর্থনৈতিক বিঘ্ন ঘটাতে পারে এবং বাণিজ্য সংঘাত এড়াতে সতর্ক ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় অংশগ্রহণ, রপ্তানি বাজার বৈচিত্র্যকরণ, পণ্যের মান বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ নীতি উন্নয়ন, বিদেশী বিনিয়োগ উৎসাহিত করা এবং শিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বৃদ্ধির মতো বহুমুখী কৌশল গ্রহণ করে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কের নেতিবাচক প্রভাব কমাতে পারে এবং বিশ্ব বাজারে প্রবৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতা ধরে রাখতে পারে।