Published : 04 Jun 2024, 06:14 PM
আমি একজন ব্রেস্ট ক্যানসারজয়ী। ২০০৩ সালে প্রথমবার আমার ব্রেস্টে ক্যানসার শনাক্ত হয়। আমি বার্ষিক চেকআপ করানোর সময় মেমোগ্রাফি করি। তখন মেমোগ্রাফিতে ব্রেস্টে লাম্প ধরা পড়ে। বায়োপসি করালে জানা যায়, সেটা ম্যালিগন্যান্ট। আমি দেশের বাইরে চিকিৎসা গ্রহণ করি। আমার শারীরিক ও মানসিক সমস্যা ছাড়া অন্য তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। আবার ২০২২ সালে আমার ক্যানসার শনাক্ত হয়। এবারও ফুল বডি চেকআপ করতে গিয়ে একদমই প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার ধরা পড়ে। এবার সার্জারি প্রয়োজন হয়নি।
আমার পরিবার, প্রতিবেশী ও অপরাজিতার সবাই এবং আমার ডাক্তারসহ সবার সাপোর্ট পাওয়ার কারণে আমি স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছি। ক্যানসার সার্ভাইভাররা যে এত কাজ করে দেখে আমি অবাক হতাম। ওদের দিকে তাকিয়ে থাকতাম— এত হাসি, এত মজার মজার কথা আসে কী করে। ওরাই আমার সাহস, আমার অনুপ্রেরণা। ধীরে ধীরে আমার আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়, বুঝতে পারি আমার দ্বারা ক্যানসারের বিরুদ্ধে অনেক কাজ করা সম্ভব।
তবে আমার যখন প্রথম ক্যানসার ধরা পড়ে, তখন আমাকে দেখতে এলে অনেকেই দূর থেকে দেখে যেতেন। পাশে আসতেন না। আমার সংক্রমণের ভয়ে নয়, বরং তারা ভয় পেতেন যদি আমার কাছে এলে তাদেরও ক্যানসার হয়। কিন্তু তারা জানতেন না যে ক্যানসার ছোঁয়াচে রোগ নয়। আবার কেউ কেউ আমাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতেন, যেন আমি একটু পরেই মরে যাব। আমার সঙ্গে আর তার আর দেখা হবে না। এতে আমারও মনের ওপর চাপ পড়ত। এ দুটো আচরণই আমার ভালো লাগত না।
‘অপরাজিতা সোসাইটি অ্যাগেইনস্ট ক্যানসার’ নামক সংগঠনের আমি একজন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। পরবর্তী সময়ে আমি পর্যায়ক্রমে সোসাইটির কোষাধ্যক্ষ ও কো-চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করি। বিগত ২০১৯ সাল থেকে আমি সোসাইটির চেয়ারপারসনের দায়িত্ব পালন করে চলেছি। অপরাজিতার মাধ্যমে ক্যানসার প্রতিরোধ ও সচেতনতাবিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা করেছি। যেমন :
ক. গার্মেন্টসের মহিলা শ্রমিক এবং স্কুল/কলেজের ছাত্রীদের মধ্যে ক্যানসার প্রতিরোধবিষয়ক সচেতনতা বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে কার্যক্রম পরিচালনা করেছি;
খ. হাসপাতালে কেমোথেরাপি ইউনিটে গিয়ে রোগী ও তাদের স্বজনদের মনোবল বৃদ্ধির জন্য কাউন্সেলিং করে থাকি;
গ. ঢাকা ও ঢাকার বাইরে বিভিন্ন এলাকায় মহিলাদের সংগঠিত করে তাদের ক্যানসার সম্পর্কে সচেতন করার লক্ষ্যে কর্মশালা অনুষ্ঠান করছি;
ঘ. সোসাইটির মাধ্যমে গরিব ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে জাকাত তহবিল গঠন করে অর্থ সংগ্রহ ও রোগীদের মধ্যে প্রতিবছর বিতরণ করে আসছি এবং
ঙ. ক্যানসারবিরোধী বিভিন্ন সংগঠনের সদস্য হিসেবে আমার সংগঠনের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছি।
অপরাজিতার সঙ্গে কাজ করতে করতে কত রকম অভিজ্ঞতা যে আমার হয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। একটা বিষয় বলি। আমরা মেয়েদের কলেজে ক্যানসার-সচেতনতার কাজ করতে করতে গিয়ে ছাত্রীদের কাছে জেনেছিলাম যে তাদের অনেকেই ব্রেস্ট এনলার্জ করার জন্য জেল ব্যবহার করে, যা স্বাস্থ্যঝুঁকিসহ ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। ক্যানসার প্রতিরোধে এই ধরনের প্রোডাক্ট বিক্রি বন্ধ করতে হবে।
ক্যানসার প্রতিরোধে আমি কিছু পরামর্শ দিতে চাই। যেমন :
ক. ক্যানসারবিরোধী সচেতনতা কার্যক্রম/কর্মশালা শহর এলাকায় সীমাবদ্ধ না রেখে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও পরিচালনা করতে হবে।
খ. ক্যানসার প্রতিরোধে ক্যানসারবিরোধী সংগঠনসহ সকল স্তরের জনগোষ্ঠীকে সম্পৃক্ত করে সমন্বিত কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।
গ. ভেজাল খাদ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। সরকার ও সচেতন নাগরিকদের নিরাপদ খাদ্যের জোগান নিশ্চিত করতে একযোগে কাজ করতে হবে।
ঘ. ধূমপান ও মাদক সেবন ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। ধূমপানসহ মাদক উৎপাদনকারীদের নিরুৎসাহিত করার জন্য সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ঙ. ক্যানসার হওয়ার সম্ভাব্য কারণ, বিভিন্ন ধরনের ক্যানসারের লক্ষণ এবং প্রাথমিক পর্যায়ে ক্যানসার শনাক্তকরণের প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি বিষয়ে রেডিও-টেলিভিশনে ব্যাপক প্রচারের ব্যবস্থা করতে হবে। বিশেষ করে প্রতিটি টিভি চ্যানেলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়ে ক্যানসার প্রতিরোধ ও চিকিৎসা-সম্পর্কিত প্রোগ্রাম নিয়মিত প্রচার করতে হবে।
চ. জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালে ক্যানসার ইউনিট খুলে চিকিৎসার পাশাপাশি নিজ নিজ এলাকায় ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম চালাতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে।
ছ. দেশের সকল বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের মালিকদের ক্যানসার প্রতিরোধবিষয়ক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে হবে।
জ. সরকারি হাসপাতাল ও ক্যানসারবিরোধী বেসরকারি সংগঠনসমূহ ইউনিয়নভিত্তিক কমিউনিটি ক্লিনিককে কেন্দ্র করে ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে। এ ব্যাপারে সরকারকে সুনির্দিষ্ট পলিসি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
ক্যানসার প্রতিরোধে সম্ভাব্য সব ধরনের সচেতনতামূলক কাজ করতে আমি আগ্রহী। তবে একার পক্ষে বা একটি সংগঠনের পক্ষে এ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব নয়। তাই আমি সরকারি ও বেসরকারি সকল সংস্থা/সংগঠনের সঙ্গে সমন্বিতভাবে এসব কাজে সম্পৃক্ত হতে চাই। এটা আমার বেঁচে থাকার দায়বদ্ধতা— বাকি জীবনে যতটুকু পারি, ততটুকুই আমার দায়মুক্তি।
লেখক: চেয়ারপারসন, অপরাজিতা ক্যানসার সোসাইটি অ্যাগেইনস্ট ক্যানসার
(সেন্টার ফর ক্যান্সার কেয়ার ফাউন্ডেশনের ‘এখানে থেমো না’ বইয়ে লেখাটি প্রকাশিত হয়েছে)