Published : 22 Dec 2024, 01:28 PM
রাজনীতি আসলে কোন পথে যাচ্ছে তা নিয়ে মন্তব্য করা সহজ নয় এখন। এখন ক্ষমতায় আছে অন্তর্বর্তী সরকার। সংবিধানে এমন সরকারের উল্লেখ নেই। তাতে কোনো অসুবিধা নেই। প্রয়োজন হলো আসল কথা। কাগজে কী লেখা থাকে তা দিয়ে সবসময় সরকার চলতে পারে না। তাছাড়া রাজনীতি একটি চলমান প্রক্রিয়া। মানুষের প্রয়োজনটাই হওয়ার কথা রাজনীতির ভিত্তি। কিন্তু যা হওয়ার কথা তা খুব কম সময়ই হতে দেখা যায়। এখনো দেশে কি সব কিছু সব মানুষের প্রত্যাশা মতো হচ্ছে? কেউ হয়তো বলবেন, হ্যাঁ, এত বছরের একটি কর্তৃত্ববাদী স্বেচ্ছাচারী মানসিকতার একটি সরকারের আকস্মিক পতনের পর দেশটি যে চরম অস্বাভাবিক অবস্থার মধ্যে পড়েনি, এটাই তো ভালো। দেশ এখন যেভাবে চলছে, তার থেকে খুব ভালো চলার অবস্থা ছিল না, নেইও।
তাই হা-হুতাশ না করে রাজনীতির সদর-অন্দরে একটু নজর ফেরানো যেতেই পারে। আমি প্রায় ৬০ বছর ধরে রাজনীতির সঙ্গে কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে আছি। কত ধরনের উত্থান-পতনই তো দেখলাম। পাকিস্তানের মিলিটারি ডিক্টেটর আইয়ুব খানের লৌহদৃঢ় শাসন দেখেছি, দেখেছি তার শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। রাজনীতির একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে রাজপথেই ছিলাম। আমার জীবনকালেই রাজনীতিতে সম্ভব-অসম্ভব কত কিছুই দেখলাম।
শুরু করেছিলাম বাম ধারা দিয়ে। তারপর একসময় মনে হলো, নাহ, বামদের দিয়ে হবে না। বামেরা বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে পারে না। তাছাড়া আমাদের দেশের সাধারণ মানুষও বামদের কাছের বলে মনে করেন না। মানুষের কাছে পৌঁছানোর অদ্ভুত এক সম্মোহনী ক্ষমতা ছিল শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধু, স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি। বঙ্গবন্ধুর হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হয়ে চেষ্টা করেছি মানুষের জন্য রাজনীতির সঙ্গে থাকার।
আজ প্রেক্ষাপট ভিন্ন। আওয়ামী লীগ এখন কাঠগড়ায়। চারদিকে নতুন কিছুর প্রত্যাশা। রাজনীতিতেও নতুন কিছু কি হবে? নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের কথা শোনা যাচ্ছে। আমার তো বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, পুরাতন মনটাতে আর সহে না নতুন জ্বালাতন। না, আমি নতুন কিছু না চাইলেই তা হবে না, তেমনটা অবশ্যই নয়।
নতুনের জন্য জায়গা ছেড়ে দিতেই হয়, হবে। রাষ্ট্র সংস্কার ও পুনর্গঠনের লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটি এবং গণঅভ্যুত্থানের পক্ষের শক্তির সমন্বয়ে একটি নতুন দল প্রতিষ্ঠার কাজ চলছে বলে বিভিন্ন সূত্রে খবর পাচ্ছি। সংবাদপত্রেও নতুন দল নিয়ে খবর ছাপা হচ্ছে। যতদূর জেনেছি, নতুন দলের মূল লক্ষ্য ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং রাষ্ট্র কাঠামোর পুনর্নির্মাণ। যদিও দলটির নাম, গঠন প্রক্রিয়া ও নেতৃত্ব এখনও চূড়ান্ত হয়নি, তবে এটি তরুণ নেতৃত্ব ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সমন্বয়ে মধ্যপন্থার আদর্শ নিয়ে রাজনীতির নতুন আঙ্গিকে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে চায় বলেই ধারণা করা যাচ্ছে।
জাতীয় নাগরিক কমিটি, সেই সঙ্গে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নতুন দল গঠন প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখছে বলে মনে করা হচ্ছে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সরাসরি সংযুক্তি না থাকলেও, এর নেতাকর্মীরা নতুন দলের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। দলটির লক্ষ্য হলো ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে বৈষম্যহীন একটি রাজনীতির ধারা প্রতিষ্ঠা করা। এ উদ্দেশ্যে দলটি সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষকে তাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। দলটির অন্যতম আকর্ষণ হচ্ছে তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে দেশের সমস্যাগুলোর সমাধান অনুসন্ধান।
তবে নতুন দলটি কতটা কার্যকর হবে, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমান দ্বিদলীয় ধারায় আওয়ামী লীগ ও বিএনপি রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। ভোটারদের একটি বড় অংশ এই দুই দলের মধ্যেই আবদ্ধ। নতুন দলের প্রতিষ্ঠা ও সফলতা এই ঐতিহ্যগত মেরুকরণকে ভাঙতে পারবে কিনা, তা সময়ের অপেক্ষা।
নতুন দলের মূল আদর্শ হিসেবে ‘মধ্যপন্থা’ অনুসরণের কথা বলা হচ্ছে। এটি কোনো নির্দিষ্ট মতবাদ, যেমন বাম-ডান চর্চার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে চায় না। বরং বাংলাদেশ প্রশ্নে ঐক্যবদ্ধ থাকা এবং উগ্রপন্থা এড়িয়ে যুক্তিযুক্ত সমাধানের পথে হাঁটতে চায়। নাগরিক কমিটির সদস্য সচিব আখতার হোসেন এই অবস্থানকে স্পষ্ট করে বলেছেন, তাদের রাজনীতি উগ্রবাদ বা বিভাজন সৃষ্টির বাইরে।
এমনটা যদি সত্যিই হয়, তাহলে মন্দ কি? কিন্তু সমস্যা হলো, আমাদের কথা ও কাজে আমরা মিল রাখতে পারি না। দেবতা গড়তে গিয়ে আমরা দানব গড়ে ফেলি!
এই দল গঠন প্রসঙ্গে বিরাজমান রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিক্রিয়া নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। বিএনপি এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছে, ছাত্রদের দল গঠনের অধিকার রয়েছে এবং তারা এটি গ্রহণ করবে যদি তা পতিত স্বৈরাচারের পুনর্বাসনের প্ল্যাটফর্ম না হয়। জামায়াতে ইসলামীও এ উদ্যোগকে নাগরিক অধিকার হিসেবে অভিহিত করেছে। তবে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক নতুন দল গঠনে সরকারের সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে সতর্ক করেছেন। তার মতে, সরকারের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে দল গঠনের উদ্যোগ গ্রহণ করলে সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হবে। অন্যদিকে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না দল গঠনকে জনগণের ভালোবাসার ওপর নির্ভর করতে বলেছেন এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটানোর চেষ্টা এড়াতে সতর্ক করেছেন।
জাতীয় নাগরিক কমিটি ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ইতোমধ্যে তৃণমূল পর্যায়ে কাজ শুরু করেছে। ১৭টি জেলার বিভিন্ন থানায়, তিনটি মহানগর, একটি বিশ্ববিদ্যালয় ও একটি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। সংগঠনের বিস্তৃত কার্যক্রম দলের সম্ভাব্য ভিত্তি মজবুত করার লক্ষ্যে কাজ করছে।
তবে দলটির অর্থনৈতিক নীতি, রাষ্ট্র কাঠামো এবং আদর্শ নিয়ে এখনও স্পষ্টতা আসেনি। এটি কি কল্যাণমূলক, নয়া উদার গণতান্ত্রিক নাকি সমাজতান্ত্রিক কাঠামোতে পরিচালিত হবে— এই বিষয়ে দলটি বিস্তারিত কিছু জানায়নি। জাতীয় নাগরিক কমিটির আহ্বায়ক নাসিরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, তাদের মূল লক্ষ্য ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন প্রজন্মের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে একটি উন্নত রাষ্ট্র ব্যবস্থা তৈরি করা।
বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই সরকারে মুহাম্মদ ইউনূস প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের তারিখ এখনও চূড়ান্ত নয়। তবে প্রধান উপদেষ্টা এরই মধ্যে এ নিয়ে একটি ধারণা দিয়েছেন।
নতুন দল প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গণতন্ত্রের জন্য শুভ লক্ষণ হলেও এটি কতটা জনসমর্থন আদায় করতে পারবে এবং দ্বিদলীয় ধারা থেকে কতটা বেরিয়ে আসতে পারবে, তা নির্ভর করবে তাদের আদর্শ ও কর্মপদ্ধতির ওপর। দলটি যদি জনগণের মৌলিক চাহিদা ও সমস্যার সমাধান দিতে পারে এবং বিদ্যমান কাঠামোর দুর্বলতাগুলো দূর করতে পারে, তবে এটি বাংলাদেশের রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে সক্ষম হতে পারে।
আবারও বলছি, আমরা ঘর পোড়া গরুর মতো, সিঁদুরে মেঘেও আমাদের ভয়।