Published : 27 May 2025, 04:34 PM
বাংলাদেশে রাষ্ট্র ও প্রশাসনের ভারসাম্য রক্ষার যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বিদ্যমান, তার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো সরকারি চাকরিজীবী সমাজ। তাদের দক্ষতা, নিরপেক্ষতা ও জবাবদিহির ভিত্তিতেই একটি সরকার নীতিনির্ধারণ ও বাস্তবায়নের কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে পারে। অথচ, সদ্য ঘোষিত ‘সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫’ প্রমাণ করছে, সরকার এখন এই কর্মচারীবৃন্দকে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীল কর্মচারী হিসেবে নয়, বরং নির্ভয়ে প্রশ্ন না করা, মাথা না তোলা, নির্দেশ পালনের জন্য একান্ত বাধ্যগত বানিয়ে রাখতে চায়। সঙ্গত কারণেই অধ্যাদেশটি সরকারি কর্মচারী মহল এবং সুশীল সমাজে গভীর উদ্বেগ ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। প্রায় সাড়ে চার দশক আগের বিশেষ বিধানের কিছু 'নিবর্তনমূলক ধারা' সংযোজন করে প্রণীত এই অধ্যাদেশটি সংবিধান প্রদত্ত মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী এবং কর্মচারীদের পেশাগত স্বাধীনতাকে খর্ব করার একটি সুদূরপ্রসারী চক্রান্ত বলে অনেকেই মনে করছেন।
এই অধ্যাদেশে অন্তর্ভুক্ত চারটি অপরাধের সংজ্ঞা পড়লেই বোঝা যায়—বাক-স্বাধীনতা, মত প্রকাশের অধিকার, কর্মক্ষেত্রে ন্যায়বিচার এবং প্রাতিষ্ঠানিক স্বচ্ছতার চূড়ান্ত অপমৃত্যু ঘটাতে এক পরিকল্পিত আইনগত কারাগার তৈরি করা হয়েছে। এতটা নিবর্তনমূলক ও একচেটিয়া শাস্তির বিধান গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে কল্পনাও করা যায় না।
‘অনানুগত্য’—এই শব্দটিই যেখানে একটি ফাঁদ, সেখানে এই অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, যদি কোনো সরকারি কর্মচারী এমন কোনো কাজে লিপ্ত হন, যা ‘অনানুগত্যের শামিল’ হয় অথবা অন্যদের মধ্যে ‘অনানুগত্য সৃষ্টি করে’, তবে তিনি ‘অসদাচরণে দোষী’ হবেন। প্রশ্ন হলো— অনানুগত্য কাকে বলে? কার মানদণ্ডে সেটা নির্ধারিত হবে? মন্ত্রণালয়ের কোনো অতিরিক্ত সচিবের যুক্তিহীন নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানানো কি অনানুগত্য? অথবা সংগঠন করে সহকর্মীদের যৌক্তিক দাবি আদায়ের আন্দোলন?
বকেয়া বেতন বা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার জন্য একত্র হন, তবে সেটি কি ‘অনানুগত্য’ হিসেবে বিবেচিত হবে? কর্তৃপক্ষের সামান্যতম বিরুদ্ধাচরণকেও যদি ‘অনানুগত্য’ হিসেবে ব্যাখ্যা করা হয়, তবে এটি কর্মচারীদের মধ্যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করবে এবং তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতাকে রুদ্ধ করবে।
এই সংজ্ঞার অস্পষ্টতা ইচ্ছাকৃত। উদ্দেশ্য পরিষ্কার— কারও ‘নজরে’ পড়া মাত্রই কর্মচারীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আইনগত অধিকার রাখবে কর্তৃপক্ষ। বাস্তবে এটি শুধু ভীতিকর নয়, সরাসরি শোষণ ও দমনপীড়নের ব্যবস্থা।
সংগঠিত কর্মবিরতিও এখন রাষ্ট্রদ্রোহের শামিল! অধ্যাদেশ বলছে, কর্মচারীরা যদি ‘সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া’ কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকেন বা কাউকে অনুপস্থিত থাকতে উৎসাহ দেন, তবে সেটাও অপরাধ। প্রশ্ন হলো— একটি সংগঠিত কর্মবিরতি, ধর্মঘট, কর্মবিরতিসহ নাগরিকভাবে স্বীকৃত কোনো প্রতিবাদ পন্থা কি এখন সরাসরি দণ্ডনীয় অপরাধ?
কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতি নিঃসন্দেহে একটি শৃঙ্খলাভঙ্গের ঘটনা। তবে, ‘যুক্তিসংগত কারণ’ ছাড়া অনুপস্থিতি বলতে কী বোঝানো হয়েছে, তার ব্যাখ্যা জরুরি। অনেক সময় ব্যক্তিগত বা পারিবারিক জরুরি প্রয়োজনে তাৎক্ষণিক ছুটি নিতে হয়। যদি এই ধরনের পরিস্থিতিকেও ‘যুক্তিসংগত কারণ’ হিসেবে বিবেচনা না করা হয়, তবে এটি কর্মচারীদের মানবিক অধিকারকে অস্বীকার করবে।
উপরন্তু, ‘কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ’ হওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত আপেক্ষিক। এটি কর্মক্ষেত্রে ব্যক্তিগত বিদ্বেষ বা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়রানির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
এটা মনে করিয়ে দেয় ১৯৭৯ সালের ‘এসেনসিয়াল সার্ভিসেস অ্যাক্ট’, যা ছিল শ্রমিকদের ধর্মঘট নিষিদ্ধ করার একটি অস্ত্র। তবে সেটিও নির্দিষ্ট খাতে প্রযোজ্য ছিল, পুরো সরকারি কর্মীবাহিনীকে এভাবে ঠেকাতে ব্যবহৃত হয়নি।
রাষ্ট্রপতির আদেশের বিরুদ্ধে আপিল নিষিদ্ধ— এটা তো রীতিমতো বিচারের নামে প্রহসন। অভিযোগপত্র দেওয়ার সাতদিনের মধ্যে কারণ দর্শানো এবং তারপর সাতদিনের মধ্যে শাস্তি নির্ধারণ— এত দ্রুত বিচার ব্যবস্থার কথা শুনে ‘দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের’ কুখ্যাত দিনগুলো স্মরণে আসে। অথচ এটি একটি প্রশাসনিক প্রক্রিয়া, যেখানে ব্যবহারিকভাবে কোনো আইনজীবীর সহায়তা, প্রতিরক্ষার সুযোগ বা নিরপেক্ষ তদন্তের নিশ্চয়তা রাখা হয়নি।
এর চেয়েও ভয়াবহ হলো— রাষ্ট্রপতির আদেশের বিরুদ্ধে কোনো আপিল করার সুযোগ নেই। এটি মৌলিক মানবাধিকারের পরিপন্থী। বিচারিক পর্যায়ে চূড়ান্ত আদেশের বিরুদ্ধে আপিলের অধিকার সংবিধানের ৪৪ অনুচ্ছেদ ও ১০২ অনুচ্ছেদের আলোকে মৌলিক অধিকারভুক্ত বিষয়। সেটি নির্বিচারে কেড়ে নেওয়া হয়েছে।
এটাকে বলা যায় শাস্তির ভয় দেখিয়ে মুখ বন্ধ রাখার প্রচেষ্টা। চাকরি থেকে অপসারণ, বরখাস্ত, কিংবা বেতন গ্রেড কমিয়ে দেওয়ার মতো শাস্তি শুধু শাস্তি নয়— এগুলো হলো সামাজিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যুদণ্ড। এটা কর্মচারীদের জন্য চরম অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করবে। এমন এক দেশে, যেখানে উচ্চপদস্থ আমলারা মন্ত্রীর চেয়েও ক্ষমতাধর, সেখানে নিম্ন ও মধ্যপদস্থ কর্মচারীদের জন্য এই আইনের প্রয়োগ হয়ে উঠবে চূড়ান্ত নিপীড়নের হাতিয়ার।
একজন সচিবের বিরুদ্ধে মুখ খুললেই হয়তো নিচে থাকা কর্মচারীর চাকরি চলে যাবে। একজন সহকারী পরিচালক হয়তো শুধুই ‘না’ বলার জন্য গ্রেড হারাবেন। একজন নারী কর্মকর্তা হয়তো অফিসে কোনো অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করে চাকরি থেকেই বরখাস্ত হবেন— এই ভয়ংকর বাস্তবতা এখন হাতছানি দিচ্ছে।
প্রশ্ন হলো, তবে কী রাষ্ট্র চায় ভীত, নিঃস্ব ক্রীতদাস, নাকি সচেতন নাগরিক-কর্মচারী? সরকারি কর্মচারীরা জনগণের টাকায় বেতন পান— সেটা ঠিক। তাই তাদের জবাবদিহি থাকতে হবে, সেটাও সত্যি। কিন্তু সেই জবাবদিহি হোক নিয়মতান্ত্রিক, আইনের শাসনের আলোকে, একটি মানবিক বিচার ব্যবস্থার ছত্রছায়ায়। এই অধ্যাদেশ সেই বিপরীত পথেই হাঁটছে—আইনকে শৃঙ্খলার বাহক থেকে নিপীড়নের অস্ত্রে রূপান্তর করা হয়েছে।
রাষ্ট্রের উচিত কর্মচারীদের মত প্রকাশের অধিকার, কর্মস্থলে মর্যাদা ও আইনি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। আর এই অধ্যাদেশ তার ঠিক উল্টো। এটি শুধু গণতন্ত্রবিরোধী নয়—মানবাধিকারবিরোধী, এবং দীর্ঘমেয়াদে একটি আত্মবিশ্বাসহীন, মৌন, অথর্ব প্রশাসনের জন্ম দেবে, যার দায় বর্তাবে রাষ্ট্রের ওপরই।
এই অধ্যাদেশের ধারাগুলো পড়লে করলে সত্যিই আতঙ্ক জাগে! একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে, যেখানে আইনের শাসন এবং মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা থাকার কথা, সেখানে এমন ‘কালাকানুন’ পৃথিবীর অন্য কোনো সভ্য দেশে আছে বলে জানা নেই। এটি কেবল কর্মচারীদের জন্য নয়, বরং সমগ্র বিচারিক প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহির ওপরও প্রশ্নচিহ্ন এঁকে দিয়েছে।
এই অধ্যাদেশটি কেবল সরকারি কর্মচারীদের পেশাগত স্বাধীনতা ও অধিকারের ওপর আঘাত নয়, এটি গণতন্ত্রের বুনিয়াদের ওপরও এক কড়া আঘাত। তাদের পেশাগত সুরক্ষা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত না হলে, তারা নির্ভয়ে এবং নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে না, যা শেষ পর্যন্ত সুশাসন এবং জনসেবার মানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
অন্তর্বর্তী সরকার এমনিতেই বর্তমানে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছে। সরকারের প্রতি বিভিন্ন মহলের অনাস্থা, ক্ষোভ দিন দিন বাড়ছে। এমন প্রতিকূল পরিস্থিতিতে এই ধরনের একটি বিতর্কিত অধ্যাদেশ জারি করা প্রশ্নবিদ্ধ। এই অধ্যাদেশ অবিলম্বে প্রত্যাহার করা উচিত এবং কর্মচারীদের স্বার্থ এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ একটি ন্যায্য ও ভারসাম্যপূর্ণ আইন প্রণয়ন করা উচিত, যা দেশের সংবিধান এবং আন্তর্জাতিক শ্রম আইন দ্বারা স্বীকৃত অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। অন্যথায়, এটি কেবল কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষই বৃদ্ধি করবে না, বরং দেশের সামগ্রিক গণতান্ত্রিক পরিবেশকে আরও কলুষিত করবে।