Published : 08 May 2025, 08:26 AM
পেহেলগামে হামলার পর ভারত পাকিস্তান যখন যুদ্ধ যুদ্ধ ‘মুডে’ চলে গেছে তখনও অনেকে বলেছেন, যুদ্ধ হবে না। এসব রাজনৈতিক ‘আওয়াজ’। কিন্তু শেষমেষ হামলা-পাল্টা হামলা হয়েই গেল।
মঙ্গলবার গভীর রাতে হঠাৎ ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় কেঁপে ওঠে পাকিস্তান ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীর। মঙ্গলবার রাতে ২৫ মিনিট ধরে পাকিস্তানের নয়টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালায় ভারত, যেগুলোকে ‘সন্ত্রাসীদের আস্তানা’ বলছে দেশটি। প্রতিবাদে পাকিস্তানও গোলাবর্ষণসহ সামরিক জবাব দিয়েছে। কাশ্মীরের পেহেলগামে সাম্প্রতিক হামলায় ২৬ জনের প্রাণহানির ঘটনার জেরে যুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছে পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দুই দেশে।
পেহেলগামের ঘটনায় পাকিস্তানভিত্তিক সন্ত্রাসী সংগঠনকে দায়ী করে দিল্লি। কেউ কেউ পাকিস্তান সরকারকেই কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন। তার পরিপ্রেক্ষিতেই সাম্প্রতিক এই হামলা। তবে পাকিস্তান তার সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে আন্তর্জাতিক তদন্ত দাবি করেছিল। মঙ্গলবারের হামলায় ভারত বলছে কোনো সামরিক স্থাপনায় নয়, বরং সন্ত্রাসীদের আস্তানায় হয়েছে হামলা। আবার পাকিস্তান বলছে বেসামরিক নিরপরাধ মানুষ হতাহত হয়েছেন।
এই সংঘাত কি শুধু দুই দেশের মধ্যকার উত্তেজনার বহিঃপ্রকাশ? তার চেয়ে বরং এটি গোটা দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। ‘পারমাণবিক প্রতিবেশী’ এই দুই রাষ্ট্রের দ্বন্দ্বে বিশ্ব সম্প্রদায় উদ্বিগ্ন, কারণ এই অঞ্চলের প্রতিটি সংঘাতের পরিণতি শুধু স্থানীয় নয়, বৈশ্বিক হয়ে দাঁড়ায়।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ এবং সংঘাতের ইতিহাস দীর্ঘ ও রক্তাক্ত। ১৯৪৭-এর বিভাজনের পরপরই কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ শুরু হয়। একই ইস্যুতে পুনরাবৃত্তি হয় ১৯৬৫ সালে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নিজের পূর্ব প্রান্তে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করছিল ভারত, একে কেন্দ্র করে দেশটির পশ্চিম প্রান্তে পাকিস্তানের সাথে পূর্ণ যুদ্ধে লিপ্ত হয় ভারত।
১৯৯৯ সালে কারগিল সংঘাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় ভূখণ্ডে ঢুকে পড়ে। ২০১৯ সালে পুলওয়ামা হামলায় ৪০ জন ভারতীয় সিআরপিএফ সদস্য নিহত হয়, যার দায় নেয় জইশ-ই-মুহাম্মদ। ভারত পাল্টা ‘বালাকোট স্ট্রাইক’ চালায়। ইতিহাসের রূপরেখা প্রমাণ করে, এই দুই রাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তাপ যে কোনো সময় সামরিক উত্তেজনায় রূপ নিতে পারে।
এই যুদ্ধ কি স্রেফ জাতীয়তাবাদ (কেউ বলেন উগ্র জাতীয়তাবাদ), নাকি কৌশলগত বাণিজ্যও? পৃথিবীজোড়া বিশেষজ্ঞরা এমনকি পপুলিস্ট মতও হচ্ছে, যে কোনো যুদ্ধই দিনশেষে বাণিজ্যিক। এই ধরনের যুদ্ধের পেছনে অস্ত্র বাণিজ্যও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাবক। মনে রাখার মতো বিষয়, ২০১৮–২২ সালের মধ্যে ভারত ছিল বিশ্বের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক রাষ্ট্র। আবার পাকিস্তানও সাম্প্রতিককালে চীন, তুরস্ক ও কাতার থেকে অস্ত্র, ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি সংগ্রহ করছে।
সবচেয়ে দুশ্চিন্তার বিষয় হলো, ভারত-পাকিস্তান সংঘাত এখন আর শুধু ‘দ্বিপাক্ষিক ইস্যু’ নয়। আফগানিস্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, চীন-ভারত সীমান্ত সমস্যা, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সংকট আর অভ্যন্তরীণ যুদ্ধ, সবমিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়া এক জটিল কৌশলগত ল্যাবরেটরিতে পরিণত হয়েছে। চীন যেমন পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র, তেমনি ভারতও যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইসরায়েলের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিতে জড়িত। এই জোটগুলো সংঘাতকে আরও বহির্বিশ্বমুখী করে তুলছে।
ভারত ও পাকিস্তান কোনো দ্বিপাক্ষিক সংঘাতে জড়ালে পুরো দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য নড়বড়ে হয়ে পড়ে। আফগানিস্তানের অস্থিরতা, চীন-ভারত উত্তেজনা, নেপাল ও শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অস্থিরতা, আর মিয়ানমারের সেনাশাসনের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ এশিয়া এমনিতেই এক রন্ধ্রে উত্তপ্ত। এখন এই নতুন যুদ্ধ পরিস্থিতি পুরো অঞ্চলকেই এক অজানা বিপদের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। বিশেষত, পারমাণবিক অস্ত্রধারী দুই দেশের সরাসরি সংঘাতে জড়ানো মানেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি, চাপ এবং জোটবদ্ধ প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা বাড়ে। এটি শুধু জাতিসংঘ বা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য নয়, চীন, রাশিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের জন্যও উদ্বেগের বিষয়।
বাংলাদেশ স্বভাবতই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের প্রতিক্রিয়ায় আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের প্রত্যাশা জানিয়েছে। সব পক্ষকেই ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে পদক্ষেপের অনুরোধ করেছে। কোনো পক্ষে জড়িত না হওয়া সবসময়ের নিরপেক্ষতাই সরকারি অবস্থান। কিন্তু এই যুদ্ধে বাংলাদেশের ওপর প্রভাব বহুমাত্রিক। বাংলাদেশের বাণিজ্য, ট্রানজিট ও জ্বালানি নির্ভরতা যেমন ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে, তেমনি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে সাপ্লাই চেইন, আমদানি ব্যয় এবং সীমান্ত বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হতে পারে।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ পরিস্থিতি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা, রাষ্ট্রীয় ব্যয় বৃদ্ধি এবং সীমান্তে নিরাপত্তা জোরদারের প্রয়োজন সৃষ্টি করে। সবচেয়ে বড় কথা বাংলাদেশকে চীন, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ভারসাম্য রেখে চলতে হয়। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে নিরপেক্ষ অবস্থান বজায় রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।
সম্প্রতি অনেক বিশ্লেষণ বলছে, ভারত ও পাকিস্তান উভয়ই ‘সীমিত যুদ্ধ’ কৌশলে বিশ্বাসী। যার মাধ্যমে তারা অভ্যন্তরীণ সমর্থন বাড়াতে এবং নিজেদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা জাহির করতে চায়। তারা পারমাণবিক যুদ্ধ এড়িয়ে, সীমান্তে বেছে বেছে ছোট পরিসরে যুদ্ধ চালাতে চায়।
তবে এমন যুদ্ধ যে কোনো সময় পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে রূপ নিতে পারে ওই নজির ইতিহাসে আছে। বিশেষত, যদি কোনো ফলস ফ্ল্যাগ অপারেশন, ভুল বা অপতথ্য বা সামরিক উত্তেজনার অতিনির্ভরতায় কোনো এক পক্ষ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয়, তা হলে তার ফলাফল হবে দুর্বিষহ। শঙ্কা হলো যুদ্ধ কখনো পুরোপুরি ‘নিয়ন্ত্রিত’ থাকে না। একবার সংঘাত শুরু হলে সেটি কতদূর যাবে, তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারে না। ভারত-পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকরা যেভাবে জনমত ব্যবহার করে যুদ্ধে লিপ্ত হচ্ছে, তাতে ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কা প্রবল।
সংঘাত শেষে কোনো পক্ষই প্রকৃত অর্থে বিজয়ী হয় না। যুদ্ধের কোনো বিজয় নেই। বরং বিপন্ন হয় অর্থনীতি, মানবিকতা এবং স্থিতিশীলতা সবই। চলমান পাক-ভারত যুদ্ধে দুই দেশেরই অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। হয়তো লাশের লাভের ভাগ পাবেন গুটিকয়েক ক্ষমতাধর। কিন্তু মানুষ মরবে, যারা মূল খেলার খেলোয়াড়ই নন, গুটি মাত্র। কুয়াশায় ঢাকা অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ কাম্য নয়। দক্ষিণ এশিয়ার জনগণের প্রকৃত প্রয়োজন শান্তি, উন্নয়ন ও আঞ্চলিক সহযোগিতা। তাই প্রয়োজন কৌশলগত দূরদর্শিতা, স্থিরতা ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি। কারণ এই অঞ্চলের কোনো আগুনে এককভাবে কেউ পোড়ে না, ধোঁয়ায় সবারই দম বন্ধ হয়ে আসে।