Published : 29 May 2025, 04:21 PM
শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশ—দুটি দক্ষিণ এশীয় দেশ, যারা বহু দিক থেকে পরস্পরের সঙ্গে তুলনাযোগ্য হলেও একেকটি সময় একেক পথে হেঁটেছে। দেশ দুটির রাজনৈতিক ইতিহাস, জাতিগত বৈচিত্র্য, ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার, এমনকি অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতাও অনেকখানি অভিন্ন ছিল। কিন্তু আজ, যখন শ্রীলঙ্কা এক ভয়াবহ অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ধস কাটিয়ে ধীরে ধীরে ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে, তখন বাংলাদেশ এক অজানা অনিশ্চয়তার দিকে এগিয়ে চলেছে। এই বিপরীতমুখী গতিপথ আমাদের সামনে এমন একটি প্রশ্ন নিয়ে আসে, যা কেবল রাজনৈতিক নয়, বরং নৈতিক, সাংগঠনিক এবং রাষ্ট্রচিন্তার গভীরে আঘাত হানে—শ্রীলঙ্কা পারে, বাংলাদেশ কেন পারে না?
প্রশ্নটির উত্তর খোঁজার আগে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে অতীতে—কীভাবে দুই দেশ তাদের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়গুলো পার করেছে, কোন সিদ্ধান্তগুলো তাদের ভিন্ন ভিন্ন দিকে চালিত করেছে এবং আজকে তারা কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।
শ্রীলঙ্কা ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে এবং বাংলাদেশের জন্ম ১৯৭১ সালে, এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে। শ্রীলঙ্কা শুরু থেকেই একটি সাংবিধানিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে, যদিও সেখানে জাতিগত বিভাজন (সিংহলি ও তামিল) বড় ধরনের রাজনৈতিক ও সামাজিক সংকট তৈরি করেছিল। তামিল গেরিলা যুদ্ধ প্রায় তিন দশক শ্রীলঙ্কাকে বিপর্যস্ত করে রেখেছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে এলটিটিই নামক তামিল টাইগারদের সামরিকভাবে পরাজিত করে দেশটি নতুন করে রাষ্ট্র গঠনের পথে এগোয়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও প্রথম দিকটা ছিল অরাজক ও দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে দিয়ে অগ্রসর। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি সমাজতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টাও হয়েছিল, কিন্তু তা ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টে হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে স্তব্ধ হয়ে যায়। এরপর দীর্ঘ সামরিক শাসন, বারবার রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং গণতন্ত্রের নানা প্রতারণার ভেতর দিয়ে দেশটি এগোয়।
সুতরাং শুরুতেই দেখা যাচ্ছে, শ্রীলঙ্কা এবং বাংলাদেশ উভয় দেশের পথচলা ছিল চ্যালেঞ্জে ভরা। কিন্তু একপর্যায়ে শ্রীলঙ্কা গণচাপের কাছে মাথা নত করতে শিখেছে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এখনো তার ছিটেফোঁটাও নেই।
শ্রীলঙ্কার অন্যতম বড় শক্তি হচ্ছে তার শিক্ষাব্যবস্থা। তারা স্বাধীনতার পর থেকেই সর্বজনীন ও বিনামূল্যে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা নিশ্চিত করেছে। এমনকি উচ্চশিক্ষাও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনেকাংশে বিনামূল্যেই চলে। ফলে শিক্ষার হার বেড়েছে, সচেতন নাগরিক বেড়েছে, রাজনীতিতে অংশগ্রহণের আগ্রহ ও বিচক্ষণতা গড়ে উঠেছে। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার সাক্ষরতার হার ৯২ শতাংশেরও বেশি।
অন্যদিকে, বাংলাদেশে শিক্ষার হার বাড়লেও গুণগত মান খুব দুর্বল। পরীক্ষাভিত্তিক শিক্ষা, কোচিং নির্ভরতা, প্রশ্নপত্র ফাঁস এবং নিয়োগে দুর্নীতি শিক্ষাকে এক ধরনের প্রহসনে পরিণত করেছে। বিশেষ করে, বাংলাদেশের পাঠ্যক্রমে নৈতিকতা, যুক্তিবোধ ও গণতন্ত্রচর্চার অভাব শিক্ষার্থীদের নাগরিক হিসেবে গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা। ফলে মানুষ শুধু সার্টিফিকেটধারী হচ্ছে, সচেতন নাগরিক নয়।
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রেও দুই দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য হচ্ছে ‘দায় স্বীকার’ ও নেতৃত্ব পরিবর্তনের সংস্কৃতি। শ্রীলঙ্কার ইতিহাসে বহুবার নেতৃত্ব পরিবর্তিত হয়েছে গণচাপের মুখে। সর্বশেষ ২০২২ সালের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সংকটে গোটাবায়া রাজাপক্ষে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন, প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে সাধারণ মানুষ ঢুকে পড়েছিল। এটি ছিল এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত—জনগণের গণআন্দোলন রাষ্ট্রপতির পদচ্যুতি ঘটায়।
বাংলাদেশে কিন্তু এমন কোনো উদাহরণ নেই। বরং এখানে ব্যর্থতা ঢাকার জন্য নানা কৌশল, ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রাখা এবং বিরোধী কণ্ঠ দমন করার চেষ্টা চলে। নির্বাচন যখন প্রশ্নবিদ্ধ হয়, তখন তা শুধরে নেওয়ার বদলে আরও কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপের সংস্কৃতি গড়ে তোলা হয়। জনগণ রাষ্ট্রের ওপর আস্থা হারায়, আর রাজনীতি হয়ে ওঠে ক্ষমতা ও সুবিধাভোগের হাতিয়ার। বাংলাদেশেও ২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়।
বাংলাদেশ অনেক অর্থনৈতিক সূচকে শ্রীলঙ্কাকে পেছনে ফেলেছে—বিশেষ করে পোশাক রপ্তানি, রেমিটেন্স, অবকাঠামো উন্নয়ন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ইত্যাদিতে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই উন্নয়ন কতটা টেকসই? কতটা অন্তর্ভুক্তিমূলক?
শ্রীলঙ্কা সংকটে পড়ে যাওয়ার পরও তারা ব্যয় সংকোচন, আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ঋণ পুনর্বিন্যাস, এবং আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থার সঙ্গে জবাবদিহির ভিত্তিতে চুক্তি করেছে। তারা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনে কাজ করছে। সরকারি ব্যয়ে কৃচ্ছ্র আরোপ করেছে এবং বিভিন্ন সেক্টরে স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা করেছে।
বাংলাদেশে এখনো বড় বড় প্রকল্পের নামে হয় ব্যাপক ব্যয়, যার অনেক প্রকল্পেই দুর্নীতি বা অস্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। রিজার্ভ ব্যবস্থাপনায় ভুল সিদ্ধান্ত, ব্যাংকিং খাতের নিয়মতান্ত্রিক দুর্বলতা এবং ঋণখেলাপিদের প্রশ্রয় দিয়ে একটি অনিরাপদ অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে।
তাছাড়া, বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনেকটাই রাজনৈতিক প্রভাবাধীন। যে সমস্ত প্রতিষ্ঠান সুশাসনের মাধ্যমে ব্যবসা বা ঋণ নিয়ন্ত্রণ করবে, তারা আজ আর্থিক কেলেঙ্কারির আবাসস্থলে পরিণত হয়েছে। অথচ, শ্রীলঙ্কা এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসতে চেষ্টা করছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে।
শ্রীলঙ্কায় বিচারব্যবস্থা তুলনামূলকভাবে স্বাধীন। তারা সরকারবিরোধী রায় দিতে পারে এবং গণমাধ্যম এখনো নানা ধরনের প্রতিবাদ, অনুসন্ধান ও বিতর্কমূলক রিপোর্ট প্রকাশ করতে পারে। ফলে সেখানে গণতন্ত্রের একটা সীমিত কাঠামো টিকে আছে।
বাংলাদেশে বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসন প্রায়ই সরকারসমর্থিত হয়ে পড়ে। উচ্চ আদালত থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী পর্যন্ত এমন অনেক সিদ্ধান্ত বা ব্যবস্থার উদাহরণ রয়েছে যা পক্ষপাতদুষ্ট বলে মনে করা হয়। একইসঙ্গে, বাংলাদেশের গণমাধ্যম নানা ধরনের নিয়ন্ত্রণের মধ্যে দিয়ে চলছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনসহ নানা বিধিনিষেধের কারণে স্বাধীন মতপ্রকাশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
ফলে নাগরিক সমাজ তাদের উদ্বেগ, বিরোধিতা বা বিকল্প মত তুলে ধরতে ভয় পায়। আর যেখানে নাগরিকের কণ্ঠ স্তব্ধ থাকে, সেখানে রাষ্ট্রের সংশোধন প্রায় অসম্ভব।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান পরিবর্তনের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে তরুণ সমাজ। তারা সোশ্যাল মিডিয়া, অনলাইন ক্যাম্পেইন, প্রতিবাদ কর্মসূচি এবং সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের মাধ্যমে রাজনৈতিক সচেতনতা সৃষ্টি করেছে। সরকার বাধ্য হয়েছে তাদের কণ্ঠ শুনতে।
বাংলাদেশে তরুণরা অনেকাংশে রাজনীতি বিমুখ হয়ে পড়েছে, তারা কেউ কেউ প্রবাসমুখী। সাম্প্রতিককালে প্রবাসমুখিতা বেড়েছে, কেউ চাকরি আর উচ্চশিক্ষার চিন্তায় গুটিয়ে থাকে। একাংশ সরকার-সমর্থিত ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে ক্ষমতা ভোগ করে, অন্যরা চুপ থাকে। এই নীরবতা রাষ্ট্রের জন্য ভয়ানক বিপদ।
তবে বাংলাদেশের তরুণদের মধ্যে বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। তারা তথ্যপ্রযুক্তি, উদ্ভাবন, সামাজিক উদ্যোগ, লেখালেখি, সংগঠন এবং সংস্কৃতিতে দারুণ কাজ করছে। প্রয়োজন শুধু একটি মুক্ত পরিবেশ, যেখানে তারা প্রশ্ন করতে পারবে, ভিন্নমত পোষণ করতে পারবে, নেতৃত্বে আসার সুযোগ পাবে।
বাংলাদেশ পারবে—শুধু তখনই, যখন রাষ্ট্র তার জনগণকে শত্রু নয়, অংশীদার মনে করবে। যখন বিরোধী মতকে হুমকি নয়, বিকল্প ভাবনা হিসেবে দেখা হবে। যখন বিচার, প্রশাসন, নির্বাচন ও গণমাধ্যম স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে। যখন নেতৃত্ব দায় স্বীকার করবে এবং জনগণের ম্যান্ডেটকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেবে।
শ্রীলঙ্কা তাদের সংকটে মুখ ঢাকেনি—তারা স্বীকার করেছে, পরিবর্তন করেছে, পথে নেমেছে। বাংলাদেশ এখনো পুরনো ভুল ঢাকতে ব্যস্ত, আত্মপ্রবঞ্চনার ঘেরাটোপে বন্দি।
তাই প্রশ্নটি কেবল প্রতীকী নয়—এটি বাস্তব এবং জরুরি: শ্রীলঙ্কা পারে, বাংলাদেশ কেন পারে না?
হয়তো আমাদের সাহস নেই, দায় স্বীকারের ইচ্ছা নেই অথবা জনগণের কণ্ঠস্বরকে গুরুত্ব দেওয়ার মনমানসিকতাই গড়ে ওঠেনি।
কিন্তু যতদিন না এই প্রশ্নের জবাব রাষ্ট্র নিজেই খুঁজে বের করবে, ততদিন উন্নয়ন, সংস্কার ইত্যাদি পরিসংখ্যান দিয়ে সত্য আড়াল করা যাবে, কিন্তু সংকট এড়ানো যাবে না।