Published : 17 Jun 2025, 04:23 PM
ইরান–ইসরায়েল যুদ্ধটা ২৪ ঘণ্টাতেই শেষ হওয়ার কথা ছিল, অন্তত ইসরায়েলি দৃষ্টিকোণ থেকে। ইরানের প্রতিরক্ষা বাহিনীর তিনজন শীর্ষস্থানীয় জেনারেলকে দুই ঘণ্টার মধ্যেই হত্যা করা হয়েছে—এরপর কোনো দেশ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পারে? নেতানিয়াহু ভাবছিলেন, একদিন পরেই তিনি বিজয় ঘোষণা করে তেলআবিবের রাস্তায় ফুলের মালা পরে বিজয় প্যারেড করবেন। কিন্তু ইরান তা হতে দিল না। বরং ইরান মিসাইল হামলা চালিয়ে সারা মধ্য ইসরায়েলে আতঙ্ক সৃষ্টি করল। নেতানিয়াহু ও তার প্রতিরক্ষা মন্ত্রীকে ভূগর্ভস্থ শেল্টারে পালিয়ে আশ্রয় নিতে হলো।
১৩ জুন ইসরায়েল আচমকা শুরু করে ইরানে হামলা। এই হামলার পরিকল্পনা করা হয়েছে কয়েক বছর ধরে। নেতানিয়াহু শুধু সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন, যাতে আচমকা হামলা চালিয়ে একদিনের মধ্যেই ইরানকে কুপোকাৎ করে ফেলতে পারেন। কিন্তু যুদ্ধ থামার কোনো আলামত দেখা যাচ্ছে না। ইরানও ইসরায়েলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।
যুদ্ধের বর্তমান পরিস্থিতি বোঝার জন্য দুই দেশের দুটি বিবৃতি পড়লেই যথেষ্ট। ইরান ইসরায়েলিদের বলেছে, তেলআবিব ছেড়ে চলে যেতে। অন্যদিকে ইসরায়েলও ইরানিদের বলেছে, তেহরান ছেড়ে যেতে। তেহরান ছাড়ার জন্য ইরানিদের হুমকি দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পও। সংঘাতের চতুর্থ দিনে ইসরায়েল ও ইরান আক্রমণ-পাল্টাআক্রমণ আরও বিস্তৃত করেছে। উভয় পক্ষ প্রয়োজনে যুদ্ধ চালাতে বদ্ধপরিকর। ‘প্রয়োজনে’ বলছি কারণ, উত্তপ্ত কথাবার্তার মধ্যেও বোঝা যাচ্ছে—দুই পক্ষই পরিশ্রান্ত, কিন্তু কেউ পরাজয় স্বীকার করে যুদ্ধ বন্ধ করতে নারাজ।
প্রতিবার ইসরায়েল নিজে যুদ্ধ শুরু করে, আমেরিকার বোমারু বিমান ও অস্ত্রশস্ত্রে প্রতিপক্ষের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি করে ফেলে, কিন্তু কখনো নিশ্চিতভাবে যুদ্ধ জয় করতে পারে না। তাদের যুদ্ধ চলতেই থাকে। হামাসের সঙ্গেও তাই হয়েছে। মনে হয়, এই বুঝি হামাস পরাজয় স্বীকার করে নেবে, সব জিম্মিদের ছেড়ে দেবে। কিন্তু সেটা তাদের জন্য অধরাই থেকে যায়।
ইরানের ক্ষেত্রেও তাই হচ্ছে। ইরানের অনেক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে এবং ২৭০ জন বেসামরিক লোক নিহত হয়েছে। তবে ইরানও ব্যালিস্টিক মিসাইল ছুড়ে ইসরায়েলের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি করেছে এবং প্রায় ৮০ জন ইসরায়েলিকে হত্যা করেছে। ইরানের ছোড়া মিসাইলের মাত্র ১০ শতাংশ ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যুহ ভেদ করতে পেরেছে। ইসরায়েলের রয়েছে ‘আয়রন ডোম’, তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রও তাদের 'প্যাট্রিয়ট' মিসাইল বসিয়ে ইরানি মিসাইলকে নিষ্ক্রিয় করছে। ভাবতে অবাক লাগে—এই প্রতিরক্ষা না থাকলে আরও অন্তত ৬০০ জন নিহত হতে পারত, ছোট্ট শহর তেলআবিব ধ্বংসের কাছাকাছি পৌঁছে যেত। এরপরেও ইরান যেভাবে প্রতিআক্রমণ করেছে, তাতে পশ্চিমা বিশেষজ্ঞরা বিস্মিত।
মার্কিন যুদ্ধবিশেষজ্ঞ ট্রিটা পার্সি সিএনএনকে বলেছেন, ‘ইরানের অবিরাম ক্ষেপণাস্ত্র হামলা প্রমাণ করেছে—বড় ক্ষতি হলেও ইরানি বাহিনী দ্রুত সংগঠিত হতে সক্ষম। শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তাদের হারানোর পরও তাৎক্ষণিক পাল্টা-আক্রমণ ইসরায়েলের ধারণা বদলে দেয়।’
সিএনএনের আন্তর্জাতিক বিভাগের প্রধান মেথিউ চান্স বলেছেন, ‘ইরানের ওপর ইসরায়েলের অভূতপূর্ব হামলায় প্রাথমিক সাফল্য সত্ত্বেও, তীব্র প্রতিশোধ এবং বোমাবর্ষণের ফলে এখন ইসরায়েলের প্রস্থান কৌশল নিয়ে প্রশ্ন উঠছে—কীভাবে তারা উচ্চাকাঙ্ক্ষী লক্ষ্য অর্জন করবে?’
একজন ইসরায়েলি সূত্র সিএনএনকে বলেছে, ‘এই যুদ্ধ শেষ হবে কূটনৈতিকভাবে, সামরিক নয়।’ ইসরায়েল আশা করছে, তাদের চলমান সামরিক পদক্ষেপ ভবিষ্যতের যে কোনো পারমাণবিক আলোচনায় ইরানকে দুর্বল অবস্থানে ফেলবে। ইসরায়েল সম্ভবত তাদের লক্ষ্য কমিয়ে এনেছে।
একজন ইসরায়েলি সামরিক কর্মকর্তার ভাষ্য, উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পারমাণবিক ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হুমকি স্থায়ীভাবে দূর করা। এই আকাঙ্ক্ষা নতুন নয়। কিন্তু প্রতিবারই ইরানের অদমনীয় মনোভাবের কাছে ইসরায়েল পিছু হটেছে। এবারও সম্ভবত তাই হবে।
নেতানিয়াহু চাচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি যুদ্ধে জড়াক। রিপাবলিকান সিনেটর লিন্ডসি গ্রাহাম ট্রাম্পকে অনুরোধ করছেন, ‘ইসরায়েলের পাশে দাঁড়িয়ে এখনই কাজ শেষ করুন।’ অপরদিকে ডেমোক্র্যাট সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স একটি বিল এনেছেন, যাতে কংগ্রেসের সম্মতি ছাড়া ট্রাম্প এই যুদ্ধে জড়াতে না পারেন। ট্রাম্প কখনো ইরানকে শান্তির বার্তা দেন, আবার কখনো নেতানিয়াহুকে বাহবা দেন। তার মুখ যাই বলুন, তার হৃদয় যে ইসরায়েলের দিকে, তা স্পষ্ট।
এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, নেতানিয়াহু ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। কিন্তু ট্রাম্প এতে ভেটো দিয়েছেন। অনেকে মনে করেন, এই রিপোর্টও সাজানো হতে পারে।
ইরানের দুর্ভাগ্য হলো, বড় কোনো মিত্র তাদের পাশে নেই। উপসাগরীয় দেশগুলো চুপ। তুরস্ক নিন্দা করলেও ন্যাটো সদস্য হওয়ায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে তাদের। ইউক্রেইন যুদ্ধে ব্যস্ত রাশিয়া। ভারতের ভূমিকা বিস্ময়কর। ইরানের তেলের বড় ক্রেতা হয়েও ভারত এবার নিরপেক্ষ। ইরানকে ভবিষ্যতে এমন একটি দেশ খুঁজে নিতে হবে, যারা দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে প্রতিরক্ষা সহায়তা দিতে পারবে।
দুই দেশই এখন ক্লান্ত। স্থলসীমা নেই, তাই দখলভিত্তিক চাপ সৃষ্টির সুযোগও নেই। হয়তো যুদ্ধ চলবে, নয়তো মধ্যস্থতা মেনে নিতে হবে। মার্কিন সংবাদমাধ্যম বলছে, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যুদ্ধ বন্ধ করে ইরানকে পারমাণবিক আলোচনায় ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব দেবেন।
জেরুজালেম পোস্ট বলছে, ট্রাম্প হয়তো আলোচনায় কিছু ছাড় দেবেন না। এরদোয়ানও মধ্যস্থতা চাচ্ছেন। ইরানি প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ইরান যুদ্ধ বাড়াতে চায় না, তবে আক্রমণের সমান জবাব দেবে।
নেতানিয়াহু বলছেন, ‘বিজয়ের পথে’, কিন্তু বাস্তবে ইসরায়েলিদের একাংশ তার ওপর ক্ষুব্ধ। ট্রাম্প তেহরান খালি করার হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। তবে নিউ ইয়র্ক টাইমস বলছে, ট্রাম্প তার দূতদের মাধ্যমে ইরানের সঙ্গে যোগাযোগ করে আলোচনার প্রস্তাব দিয়েছেন। তিনি দাবি করছেন, ইরান ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। সোমবার ট্রাম্প ইরানিদের অবিলম্বে তেহরান খালি করার হুঁশিয়ারি দিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দিলেও অনেকে এটাকে ট্রাম্পের একটা প্রচরণা হিসেবে দেখছেন । নিউ ইয়র্ক টাইমসের সর্বশেষ খবরে প্রকাশ করেছে , ট্রাম্প তার ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স ও মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক দূত স্টিভ ওইটকফকে ইরানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে তার 'প্রস্তাব' জানাতে বলেছেন । সোমবার বিকেলে তিনি বলেছেন, ' তার প্রস্তাবে ইরানিরা ভালো সাড়া দিয়েছে , মূলত এখন তারা আলোচনা টেবিলে আবার ফিরে আসছে এবং একটা চুক্তি করতে প্রস্তুত।'
প্রকৃতপক্ষে নাটাই এখন ডনাল্ড ট্রাম্পের হাতে। তিনি চান, সবকিছু তার ইচ্ছেমতন চলুক—যুদ্ধ শুরুর মতো আলোচনার সুতা গুটানোও যেন তার হাতেই থাকে।