Published : 08 Oct 2022, 08:55 PM
‘যত মত, তত পথ’- হিন্দুধর্মের মূল মন্ত্র, যার মানে হচ্ছে, সব ধর্মই সমান সত্য। ‘ইসলামই একমাত্র ধর্ম’- ইসলামে এই দাবি করা হলেও ‘কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনি কো ইসলাম’ নজরুলের এই কথাটাও মিথ্যা হবার কোনো কারণ নেই। পাঠক বই পড়ুক বা না পড়ুক, লাইব্রেরির সব বই যেমন পাঠকের জন্যে সংরক্ষিত, তেমনি প্রতিটি ধর্ম মানুষের জন্য, মানুষ সেই ধর্ম পালন করুক বা না করুক। মানুষ পালন করবে বলেইতো ধর্মগুলো প্রবর্তিত হয়েছে। গির্জায় যে কারও প্রবেশাধিকার আছে। মুসলমান না হলে কাবাঘরে কিংবা হিন্দু না হলে মন্দিরে প্রবেশাধিকার থাকবে না- এই প্রতিবন্ধ মেনে নিয়েও বলা যায়, এমন কোনো ধর্ম নেই, যেটি কাগজে-কলমে শুধু সেই ধর্মাবলম্বীদের জন্য সংরক্ষিত।
এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ‘ধর্ম যার যার’ কথাটা সত্য নয়, প্রতিটি ধর্মই সব মানুষের, সবার। তবে ‘ধর্ম যার যার’ কথাটির একটি অর্থ হতে পারে, প্রত্যেকে নিজের ধর্ম পালন করুক, কোনো অসুবিধা নেই তাতে। অন্য মানুষ, অন্য ধর্মের মানুষ যেন সেই ধর্মের ব্যাপারে বা ধর্ম পালনের ব্যাপারে যেন খামাখা নাক না গলায়। তুলনীয়: প্রত্যেক শিশু নিজ নিজ পুতুল নিয়ে খেলুক। কোনো শিশু যেন অন্য শিশুর পুতুলের নাক-কান ছিঁড়ে না দেয়, কিংবা অন্যের পুতুল কেড়ে না নেয়।
বেশির ভাগ ধর্মের অনুসারীরা যে এমনটা মনে করে না, বেশির ভাগ মানুষও যে এমনটা ভাবে না, তার প্রমাণ, ধর্মপ্রচার এবং ধর্মান্তর। প্রচারেই প্রসার। সব ধর্মই প্রচারে বিশ্বাসী, বেশিরভাগ তথাকথিত ধার্মিক অন্য ধর্মের লোককে, ছলে-বলে-কৌশলে ‘ফুঁসলিয়ে ভাগিয়ে’ আনতে চায় নিজের ধর্মের Show-শীতল ছায়াতলে। মুসলমান এবং খ্রিস্টানেরা কায়মনোবাক্যে চায়, সারা পৃথিবীর মানুষ যথাক্রমে মুসলমান ও খ্রিস্টান হয়ে যাক। বেশি দিন আগের কথা নয়, ঊনবিংশ শতকেই আফগানিস্তানের কাফিরিস্তানের অধিবাসীদের জোরপূর্বক মুসলমান করা হয়েছে, কাফিরিস্থানের নামটা পর্যন্ত বদলে দেওয়া হয়েছে: ‘নূরীস্থান’। এটা অনেকটা পাকিস্তান আমলে ঢাকার ‘রামচন্দ্রপুর’ মউজার নাম বদলে ‘মোহাম্মদপুর’ রাখার মতো। ভারতেও কোথাও কোথাও, স্বেচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়, মুসলমানদের হিন্দুধর্মে ফিরিয়ে আনা হচ্ছে, এক উৎসবের মাধ্যমে, যার নাম ‘ঘর-ওয়াপসী’।
পুতুল নিয়ে সাধারণত নিজে নিজে খেলা যায় না। অন্যের পুতুলের সঙ্গে নিজের পুতুলের বিয়ে দেবার একটা ব্যাপার আছে। মধ্যযুগে হিন্দু ও মুসলমান উভয় সম্প্রদায় সত্যপীরের পূজা করতো। এখনও সত্যনারায়ণের পুঁথিতে মুসলমানি তথা আরবি-ফার্সি শব্দের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়, উদাহরণস্বরূপ, সত্যনারায়ণের একটি পুঁথি শেষ হয়েছে: ‘মুজরা-সেলাম’ কথাটি দিয়ে। মধ্যযুগে একাধিক মুসলমান কবি রাধাকৃষ্ণের কীর্তন লিখেছেন! আধুনিক যুগে নজরুল এমন শ্যামাসঙ্গীত লিখেছেন, যা ছাড়া দুর্গা ও কালীপূজা অনেকের কাছে অসম্পূর্ণ মনে হতে পারে! আমি ব্যক্তিগতভাবে নজরুলের শ্যামাসঙ্গীতকে মন্ত্রের সমতুল্য মনে করি, মন্ত্রের চেয়েও অধিক ভক্তিরস আছে বলে মনে করি নজরুল রচিত শ্যামাসঙ্গীতে। এখনও হিন্দু-মুসলমান উভয়েই মাজারে সিন্নি দেয়, শাল চড়ায়, বিশেষ করে খাজাবাবার মাজারতো খুবই বিখ্যাত। হুমায়ুন আহমদের মতো যুক্তিবাদী বিজ্ঞান-শিক্ষক লেখক পর্যন্ত পুত্রলাভার্থে খাজাবাবার মাজারে ধরনা দিয়েছেন।
অন্য ধর্মের নিয়ম কানুন নিজের ধর্মে অন্তর্ভুক্ত করে সেই ধর্মে বিশ্বাসীদের নিজের ধর্মে সামিল করার একটা চেষ্টা সবসময়ই ছিল। জাহিলিয়া যুগের কিছু ধর্মাচরণ ইসলামের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে: হজ, হাজরে আসওয়াদে চুমু খাওয়া, শয়তানকে পাথর ছোঁড়া ইত্যাদি। ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের সম্মিলিত প্রভাবে কমপক্ষে দুটি ধর্মের সৃষ্টি হয়েছে ভারতবর্ষে: শিখ ধর্ম এবং অধুনা বিলুপ্ত ব্রাহ্মধর্ম। কবির ও লালনের ধর্মে হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে সবারই প্রবেশাধিকার আছে।
আমার মাতামহী কট্টর হিন্দু ছিলেন, অহিন্দু যে কোনো কিছুকেই তিনি সাধারণত অস্পৃশ্য মনে করতেন। কিন্তু গরুর প্রথম দুধটা, গাছের প্রথম ডাবটা তিনি মাজারে-মসজিদে পাঠাতেন। এক মুসলমান নারী তাকে ধর্মের মা ডেকেছিল। সেই মেয়ে মায়ের ঠাকুরঘরে ঢুকতো না, আমাদের বাড়িতে এলে মায়ের কাপড় পেতে নামাজ পড়তো। ১৯৭১ সালে সেই মুসলমান মেয়ে হিন্দু মাকে নিজের বাড়িতে হিন্দুমতে স্বপাক খাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিল, চুলা নিজের হাতে লেপে-পুঁছে। এর মানে, মাতামহী মনে করতেন, তার মুসলমান মেয়ের ইসলাম ধর্ম পালনের দায়িত্ব কিছুটা তারও। ওনার মেয়ে বিশ্বাস করতেন, হিন্দু মায়ের হিন্দুধর্ম রক্ষার দায়িত্ব কিছুটা হলেও মুসলমান মেয়ের উপর বর্তায়। তাহলে, অন্তত এক্ষেত্রে ধর্মতো আর সম্পূর্ণভাবে ‘যার যার’ থাকলো না, একে অন্যের ধর্মে নাক গলালো, যদিও ইতিবাচকভাবে। অবশ্য পরস্পরের ধর্মপালনে এই স্বতস্ফূর্ত সহায়তাকেও নেতিবাচক হিসেবে বিবেচনা করার লোকের অভাব নেই সমাজে।
রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: ‘দেবে আর নেবে, মিলাবে মিলিবে।’ এই মিলন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ইচ্ছার ব্যাপার যেমন, তেমনি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াও বটে। দুই সহাবস্থিত ধর্মের মধ্যে প্রাকৃতিক, ঐতিহাসিক কারণে আদান-প্রদান, প্রভাববিস্তার চলতেই থাকে। কোন মুসলমান বিয়েতে এখন হিন্দু স্ত্রী-আচার ‘গায়ে হলুদ’ হয় না? চরম কট্টরপন্থিরাও গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানকে উড়িয়ে দেবার সাহস করবে না, কারণ সেটা করতে গেলে, তারা জানে, অনেক ধার্মিকও সেটা মানবেন না। হজ করার সময় যেমন অসীবিত বস্ত্র পরিধান করতে হয়, ঠিক তেমনি হিন্দুরও সেলাইছাড়া কাপড় পরে ধর্মাচরণ করার কথা। কিন্তু হিন্দু বর কিংবা ব্রাহ্মণ পাঞ্জাবি বা সেলাই করা মুসলমানি কুর্তা পরেই আজকাল পূজা কিংবা বিয়ের পিঁড়িতে বসে। ভারতবর্ষের মুসলমান সম্প্রদায়ের ‘চল্লিশা’ বা ‘কুলখানি’র উপর কি হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুষ্ঠান আদ্যশ্রাদ্ধের কোনো প্রভাব নেই?
এবার আসি উৎসব প্রসঙ্গে। ‘উৎসব’ মানুষের মিলন-মেলা বটে, কিন্তু কোনো মিলনই অবাধ, নিরঙ্কুশ নয়। রাজাকারেরা খুশি মনে স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবস পালন করতে চায় কি? বাঙালি জাতিয়তাবাদকে যারা ঘৃণা করে, তারা পহেলা বৈশাখ পালন করার ঘোর বিরোধী। পশুহত্যা যারা পছন্দ করে না, তারা কোরবানি উৎসবে অংশ নেবার কারণ নেই। ভিগান যারা, যারা প্রাণিজ প্রোটিন খায় না, কিংবা যারা গোমাংস খায় না, তারাও কোরবানির মাংস খাবে না। তবে আরবদেশে যেখানে বেশির ভাগ সময় ছাগল ও দুম্বা কোরবানি দেওয়া হয়, সেখানে গোমাংস না খাওয়া, কিন্তু মাংস খাওয়া লোকজনের অংশ নিতে তেমন বাধা নেই।
অমুসলমান ঈদের নামাজ পড়বে না, কিন্তু ঈদের সেমাই খেতে বাধা কোথায়? মুসলমান বন্ধুদের দেখাদেখি ঈদে নতুন পোশাক কিনলেই বা সমস্যা কী? মুসলমানদের মধ্যে যারা মূর্তিপূজা পছন্দ করে না, দুর্গাপূজার ‘পূজা’ অংশে তারা অংশগ্রহণ না করুক। কিন্তু পূজার প্রসাদ অনেকেই খেয়ে থাকে, পূজার আরতি অনেক মুসলমানও উপভোগ করে। মাজারের কাওয়ালি গান কি হিন্দুরা ভক্তিভরে শোনে না? মন্ট্রিয়লের এবারের পূজায় একাধিক মুসলমান আমাকে জিগ্যেস করেছেন: ‘আরতি কেন হচ্ছে না?’ বিদেশে ধূপের ধোঁয়া দিয়ে আরতি যথাসাধ্য পরিহার করা হয়, কারণ স্মোকডিটেক্টর সিগনাল দিয়ে ফেললে দমকল বা পুলিশ চলে এসে পূজার অনুষ্ঠানে খামাখা বিঘ্ন সৃষ্টি হতে পারে। পূজাসংখ্যা এবং (ঈদসংখ্যায়) হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে লেখকেরা লিখে থাকেন, পশ্চিমবঙ্গে এবং বাংলাদেশে। ভারতের বিভিন্ন মন্দিরের বাইরে মুসলমান ব্যাবসায়ীদের আবির, মোমবাতি, ধূপকাঠি ইত্যাদি পূজার উপকরণ বিক্রি করতে দেখেছি। এক সময় দুর্গাপূজার ঢাকিদের একট বড় অংশ মুসলমান ছিল।
কিছু উৎসব ইদানিং সব দেশেই সবার। অনেক ধর্মীয় উৎসব কালক্রমে সার্বজনীয় উৎসবে পরিণত হচ্ছে। বড় দিন বা ক্রিসমাস পাশ্চাত্যে এখন সবার উৎসব। সব ধর্মের লোকেরাই কমবেশি ক্রিসমাস ট্রি ঘরে রাখে, বাচ্চাদের চাপে বাধ্য হয়ে কিংবা অন্যদের দেখাদেখি। বাচ্চাদের এবং অন্যদের ক্রিসমাসের উপহার দিতে দেখা যাচ্ছে সব ধর্মের লোককেই। কট্টরদের কথা ভিন্ন। ক্রিসমাস ট্রির সঙ্গে খ্রিস্টানধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এই প্রথা এসেছে হাজার বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া প্যাগান ধর্মের বৃক্ষপূজা থেকে। নিউ ইয়ার বা গ্রেগরি নববর্ষ, বাংলা নববর্ষ, ইরানি নওরোজ ধর্মনির্বিশেষে সবার উৎসব। বসন্ত-বরণ, একুশে ফেব্রুয়ারি, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবস সব বাঙালির উৎসব। ঋতুভিত্তিক শরৎ-বরণ, বর্ষাবরণ উৎসব যদি কখনও শুরু হয়, তবে সেগুলোও সার্বজনীন উৎসব হবে। হিন্দু উৎসব হোলি ও দিওয়ালি ধীরে ধীরে সার্বজনীন উৎসবে পরিণত হচ্ছে!
ধর্ম আর উৎসব উভয়েই যে কিছু পরিমাণে ‘যার যার’, কিছু পরিমাণে ‘সবার’- এর হাজার প্রমাণ ইতিহাসে, বর্তমানে, মানুষের জীবনাচরণে আছে। ব্যক্তিকে ও গোষ্ঠীকে বুঝতে হবে, ধর্মের, উৎসবের কতটা তার নিজের, কতটা সবার, কতটা তারা পছন্দ, কতটা তার পক্ষে করা সম্ভবই নয়। ‘ভিন্ন রুচির্হি লোকাঃ’- এই সংস্কৃত প্রবাদের অর্থ: ‘প্রত্যেক লোকের রুচি ভিন্ন হয়।’ যার যেমন রুচি, অংশ নিক না উৎসবে, ধর্মে, জোরের কিছু নেই। জোর করলেও কতদিন করবেন, এক দশক, এক শতক? সৃষ্টিকর্তার ইচ্ছায় নজরুলের মতো মানুষের, মানুষদের জন্ম কীভাবে ঠেকাবেন আপনি?
আগে পরে মানুষ ধর্মের নয়, নিজের প্রবৃত্তির দাবিই মেনে চলে, চলতে চায়, চলতে বাধ্য হয়। ধর্ম আর উৎসব যদি প্রবৃত্তির দাবি না মানে, তবে আগে পরে উভয়েই পত্রপাঠ বিদায় হবে, কারণ মানুষের প্রবৃত্তি ও প্রকৃতি কারও অনুরোধে বা আদেশে বদলাবে না। এ কারণেই বেশির ভাগ মানুষ মিথ্যা বলে, দুই নম্বরী করে, সুদ খায়। সমাজে মদ যত বিক্রি হয়, দুধ তত বিক্রি হয় না। সমাজে বেশির ভাগ মানুষ (বর্ণ) চোরা এবং একান্ত বাধ্য না হলে কখনই তারা ধর্মের কাহিনি শুনতে চায় না।
প্রশ্নটা আপাতত পরিমিতিবোধের। সবার মধ্যে কমবেশি পরিমিতিবোধ থাকলে কোনো সমস্যা হয় না, হবে না। তোমার পুতুল নিয়ে তুমি খেলো, আমারটা নিয়ে আমাকে খেলতে দাও। তোমার পুতুলের বিয়েতে আমাকে দাওয়াত দাও, আমি সাধ্যমতো অংশগ্রহণ করবো। আমার পুতুলের বিয়েতে তুমিও সাধ্যমতো শরীক হয়ো। তোমার-আমার দুজনের দাওয়াত-আমন্ত্রণ রইল দুজনের বাড়িতে, কিন্তু আসা-না আসা তোমার-আমার রূচি আর ইচ্ছার ব্যাপার। আমার-তোমার গতিবিধি পরস্পরের ড্রয়িংরুমেই সীমাবদ্ধ থাকবে, নাকি সোজা ঢুকে যাবো আমরা পরস্পরের রান্নাঘরে, সেটা নির্ধারণ করবে স্থান-কাল-পাত্র।
বয়স্ক লোকদের ধর্ম-পুতুল খেলা হাস্যকর মনে হতে পারে নাস্তিকদের কাছে। কিন্তু আমাদের সংস্কৃতি এবং জীবনাচরণের বেশির ভাগটাই কি হাস্যকর, মিথ্যা-নির্ভর নয়? ঘুর্ণিঝড়ের ভোরেও ঘরের চাল উড়ে যাওয়া প্রতিবেশিকে আমরা বলি: ‘শুভসকাল’, অথচ কথাটা ডাহা মিথ্যা! পূর্ব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণ ইত্যাদি দিক, সূর্যের উদয়াস্ত, সপ্তাহ, মাস, বছর ... এই সব কিছু মানুষের দৃষ্টিভ্রম, বানোয়াট ঐতিহ্য। ধর্ম-ভাষা-টাকা, মানুষের জীবনে এই তিনটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিসে মিথ্যানির্ভরতা রয়েছে। অথচ এই সব মিথ্যা, বানোয়াট জিনিস দিয়ে চমৎকার জীবনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিয়েছে মানুষ।
অভিবাদনের যত রকম নিয়ম আছে, দুই হাত জোড় করে প্রণাম, এক হাত তুলে সালাম, ডান হাতে হ্যান্ডশেক, জাপানিদের কোমড় বাঁকানো, মাওরিদের নাকে নাক ঘসা, এই প্রত্যেকটি ঐতিহ্যনির্ভর আচরণ হাস্যকর, অথচ এই একেকটি আচরণ আমরা মেনে নিই, সহ্য করি, নিজেরাও কমবেশি অভ্যস্ত হয়ে যাই অন্যের, বিজাতীয় অভিবাদনে। এটাও সাংস্কৃতিক মিলন-মিশ্রণের উদাহরণ বটে।
মৌলিক, যৌগিক ও মিশ্র- তিন ধরনের পদার্থ আছে। অক্সিজেন কিংবা হাইড্রোজেন মৌলিক পদার্থ। পানি যৌগিক পদার্থ। এমন কি বলা যাবে, পানি প্রথমে অক্সিজেন কিংবা হাইড্রোজেন? জাতিয়তাও অনুরূপ- ধর্ম, ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস সব মিলেমিশে একাকার হয়ে বাঙালি জাতি গঠিত হয়েছে। এর মধ্যে আদিবাসী, হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান, খ্রিস্টান... ইতিহাসের সিমেন্টের মশলা-সুরকিতে পূর্বোক্ত অপরিহার্য উপকরণগুলে এমনভাবে মিশে গিয়েছে যে কোনো উপকরণকেই কম বা বেশি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ করার কিংবা কোনোটিকে বাদ দেবার সুযোগই আর নেই। একটি উপাদান বাদ দিলেও বাঙালি আর বাঙালি থাকবে না শুধু নয়, কোনো একটি উপাদান চাইলেও বাদ দেওয়া অসম্ভব। রান্না একবার হয়ে যাওয়ার পর হলুদ বা লংকাটাকে আপনি কি আর আলাদা করতে পারবেন, কিংবা পারবেন কি সিদ্ধ আলুটাকে পূর্বাবস্থায় ফেরৎ নিতে? প্রথমে অক্সিজেন তার পর পানি- এমন সিদ্ধান্ত যেমন হালে পানি পাবে না, তেমনি প্রথমে হিন্দু বা মুসলমান, তারপর বাঙালি, এমন বিশ্বাসও চিন্তাশীলদের বিচারে ভ্রান্ত প্রমাণিত হবে।
বাঙালিত্বের শ্রেষ্ঠতম উদাহরণ নজরুল। নজরুলের মধ্যে নাস্তিকতা আছে, হিন্দুত্ব আছে, ইসলামও আছে। হিন্দু বলে নজরুল আমার, ওর শ্যামাসঙ্গীত ছাড়া মা দুর্গার বোধন হবে না। মুসলমান বলে, নজরুলের ঈদের গান ছাড়া উৎসব ফিকে মনে হয়। নাস্তিক বলে, খোদার আরশ ছেদ করে উঠতে চেয়েছে যে কবি, সেতো আমার মনের কথাই বলেছে। নজরুল ছিলেন ‘অতিসাম্প্রদায়িক’, ‘মেটা কম্যুনাল’- তিনিই প্রকৃত বাঙালি ছিলেন। এহেন নজরুলকে জাতীয় কবি করে বাঙালি নিজের ভবিষ্যৎ যাত্রাপথ আগেই নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, সম্ভবত নিজের অজান্তে।
গত চৌদ্দ হাজার বছরের মানব সমাজ গঠন-পরিবর্তনের ইতিহাসে এই মিলন-মিশ্রণ, আদান-প্রদান একটা স্বাভাবিক প্রবণতা। এটাই কাম্য, সুস্থ সমাজের লক্ষণ হওয়া উচিত। এমন দিনও হয়তো আসতে পারে, একই প্রার্থনাগৃহে সাকার, নিরাকারবাদী একত্রে প্রার্থনা করবে। বিশের দশকে দক্ষিণ আফ্রিকায় গান্ধীর নেতৃত্বে ভারতীয় হিন্দু-মুসলমান একত্রে রাজনৈতিক সভা করতো মসজিদে, কিন্তু মন্দিরে নয়। তেহরানের জামে মসজিদে নামাজের পরিবর্তে সাময়িকভাবে বইমেলা আয়োজিত হতে দেখেছি। ইতিহাসে কিংবা ভূগোলে মুসলমানদের উদারতার উদাহরণ অন্য সব ধর্মের চেয়ে বেশি ছাড়া কম নয়।
‘চিরদিন কাহারও সমান নাহি যায়’- নজরুলের কথা। সমাজে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা যখন চলমান থাকে, তখন দোষ দেবার জন্যে প্রতিটি জাতিরাষ্ট্রের সংখ্যাগুরু একটা বলির পাঁঠা খুঁজতে থাকে। কোনো না কোনো সংখ্যালঘু এবং তার পরিচিতিমূলক ধর্ম হয় সেই বলির পাঁঠা। এমন পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বুঝদিল লোকটাও যেন অবুঝ হয়ে যায়। অনুরূপ পরিস্থিতি দেশে দেশে, বাংলাদেশে, যুগে যুগে দেখা গেছে। আশার কথা এই যে জ্বালানী না থাকলে সব আগুনই আগে পরে নিভে যায়, যতই কেউ নিজের হীন স্বার্থে ধর্মান্ধতা কিংবা রাজনীতির চুঙা দিয়ে সংঘাতের আগুনে ফুঁ দিক না কেন!
স্বল্পমেয়াদী দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে ধর্ম কিছুটা যার যার, উৎসব অনেকটা সবার। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে উৎসব এবং ধর্ম উভয়েই যার যার নয়, পুরোপুরি সবার হয়ে যায়। এর কারণ, সংঘাত নয়, মিলন-মিশ্রণেই আসল স্ফূর্তি, মানুষ এবং তার ধর্মের। আপনি চাইলেও মিলন হবে, না চাইলেও হবে, আগে আর পরে। যত দ্রুত মিলন হবে, তবে দ্রুত সন্তানের, ফসলের সম্ভাবনা। ‘মিলন হবে কত দিনে?’- লালনের এই প্রশ্নের উত্তর দেবার দায়িত্ব আপনার।