Published : 11 May 2025, 01:05 AM
পেহেলগামের মর্মান্তিক সন্ত্রাসী হামলার রক্তাক্ত অভিঘাতে যখন সমগ্র ভারত স্তব্ধ, ঠিক ওই সময় দিল্লি থেকে ঘোষিত হলো ‘অপারেশন সিঁদুর’। ভারতে দাবি, সীমান্ত পার হয়ে পাকিস্তানের জঙ্গি ঘাঁটিতে তাদের নিশানা করা হামলাটি আপাতদৃষ্টিতে ছিল সীমিত ও কৌশলগত। কিন্তু এই সীমিত হামলার আড়ালেই যেন লুকিয়ে রয়েছে এক বহুমাত্রিক সংকটের ইঙ্গিত। কারণ, প্রশ্ন কেবল প্রতিক্রিয়ার মাত্রা নয়, প্রশ্ন ভারত কেন এই প্রতিক্রিয়ার পথ বেছে নিল এবং ভবিষ্যতে তার পরিণতি কী হতে পারে।
সর্বশেষ খবর অবশ্য বলছে, চুক্তির টেবিলে বসে যুদ্ধবিরতিতে গিয়েছে ভারত ও পাকিস্তান। পাল্টাপাল্টি হামলার চার দিনের মাথায় শনিবার বিকাল থেকে এ যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের গত কয়েক দশকের সবচেয়ে বড় সংঘাতের ‘আপাতত’ ইতি ঘটেছে। তবে এই যুদ্ধবিরতি দীর্ঘস্থায়ী হবে কি না, তা নির্ভর করছে আন্তর্জাতিক কূটনীতি ও দুই দেশের পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর। অস্ত্রবিরতি ঘোষণার পর শ্রীনগরে বিস্ফোরণের অভিযোগ এনেছেন জম্মু ও কাশ্মীরের মুখমন্ত্রী ওমর আব্দুল্লাহ। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে পোস্টে আব্দুল্লাহ বলেন, “যুদ্ধবিরতির কী হল? শ্রীনগরজুড়ে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে।”
যুদ্ধ হয়তো থামবে অচিরেই। তবে যে কোনো যুদ্ধের পেছনে শাসকদের নিজস্ব হিসাব-নিকাশ থাকে। এই যুদ্ধের পেছনেও আছে। তবে সাদা চোখেই দেখা যায়, সম্প্রতি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোটেও স্বস্তির নয়। মণিপুরে দীর্ঘমেয়াদী জাতিগত সহিংসতা, পাঞ্জাবে কৃষক আন্দোলনের অব্যাহত ক্ষোভ, পশ্চিমবঙ্গে কেন্দ্র-রাজ্য দ্বন্দ্ব, সর্বোপরি জাতীয় রাজনীতিতে সাধারণ নির্বাচন ঘনিয়ে আসার চাপ— সবকিছু মিলিয়ে কেন্দ্রীয় শাসকের সামনে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি।
ইতিহাস বলছে, অনেক সময় সরকার অভ্যন্তরীণ চাপ হালকা করতে বাহ্যিক শত্রু তৈরি করে; যুদ্ধ বা সশস্ত্র সংঘাত তখন হয়ে ওঠে এক জাতীয়তাবাদের ‘উদ্দীপক’— যা ক্ষণিকের জন্য হলেও জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে। অতএব, অপারেশন সিঁদুরের পেছনে যে রাজনৈতিক লাভের আশঙ্কা নেই, তা বলা যায় না।
কিন্তু রাজনৈতিক কৌশল যতই জোরাল হোক না কেন, যুদ্ধের অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে কোনো রাষ্ট্রই মুখ ফিরিয়ে রাখতে পারে না। গত এক দশকে ভারতের অর্থনীতি উচ্চবৃদ্ধির পথ পেরিয়ে এখন এক সংবেদনশীল সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। বেকারত্বের হার ঊর্ধ্বমুখী, কৃষিখাতের অস্থিরতা অব্যাহত, শিল্পোৎপাদনে মন্দার প্রবণতা দেখা দিচ্ছে এবং রাজস্ব ঘাটতি চাপ সৃষ্টি করছে সরকারের ওপর। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে অনিশ্চয়তা। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বিভিন্ন প্রযুক্তি ও শুল্কনীতিতে মতবিরোধ চলছে, চীনের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি সীমান্ত উত্তেজনা এবং বাণিজ্যিক বৈরিতা স্পষ্ট। এমন প্রেক্ষাপটে একটি পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধ শুরু করা মানে শুধুই আর্থিক আত্মঘাত।
পাকিস্তানকে এই যুদ্ধে অবহেলার চোখে দেখা হবে এক মারাত্মক কৌশলগত ভুল। রাজনৈতিকভাবে নাজুক, অর্থনৈতিকভাবে কার্যত দেউলিয়া ও বিদেশি ঋণে বিপর্যস্ত হলেও, পাকিস্তান সামরিক দিক থেকে বেশ সবল। সেনাবাহিনী ও সরকারের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দীর্ঘদিনের, কিন্তু ওই দ্বন্দ্বই কোনো বহিরাগত হুমকির মুখে আচমকা ‘জাতীয় একতা’র মোড়কে গলে যেতে পারে।
ভারতীয় হামলা সেদেশের রাজনীতিক ও সেনানায়কদের হাতে এমন এক হাতিয়ার তুলে দিতে পারে, যা তারা ‘প্রয়োজনীয় প্রতিশোধ’ বলে জাতিকে বোঝাবে এবং তাতে যুদ্ধ উল্টো পাকিস্তানে জাতীয় ঐক্যের অদ্ভুত টনিক হয়ে উঠতে পারে। চীন ও তুরস্কের সঙ্গে সামরিক সম্পর্ক, আমেরিকান প্রযুক্তির দীর্ঘমেয়াদি ব্যবহার এবং আধুনিক অস্ত্রভাণ্ডার মিলিয়ে পাকিস্তানের প্রতিরোধ ও পাল্টা আক্রমণ-ক্ষমতা রয়েছে। বিশেষ করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তির উন্নতি এবং ভৌগোলিক সুবিধাজনিত প্রতিরক্ষা কৌশল পাকিস্তানকে অপ্রত্যাশিত পাল্টা আঘাতে সক্ষম করে তুলেছে।
পাশাপাশি, পাকিস্তানের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি প্রভাবশালী দেশের সাম্প্রতিক ঘনিষ্ঠতা এই যুদ্ধপ্রসঙ্গকে আরও জটিল করে তুলছে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বেশকিছু দেশ দীর্ঘদিন ধরেই পাকিস্তানের অর্থনৈতিক সহায়তাকারী; শুধু অর্থনীতিই নয়— ধর্মীয়, কূটনৈতিক ও সামরিক সম্পর্কও রয়েছে গভীর। মধ্যপ্রাচ্যে ভারত-সমর্থন ও পাকিস্তান-সহানুভূতি দুই-ই রয়েছে। কাজেই পাকিস্তানকে দুর্বল মনে করলে ভুল হবে।
আন্তর্জাতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও ভারতের বর্তমান কূটনৈতিক অবস্থান খুব সুবিধাজনক বলা যায় না। চীনের সঙ্গে দীর্ঘকালীন সীমান্ত দ্বন্দ্ব, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক কিছুটা স্থিতিশীল হলেও ইউক্রেইন যুদ্ধের পর নতুন ভারসাম্যে তা দুর্বল হয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কৌশলগত অংশীদারত্ব থাকলেও বাণিজ্য নিয়ে চলমান জটিলতা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের স্থায়ী ভিত্তিকে নড়বড়ে করে তুলেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্য প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক বহু ক্ষেত্রে অবিশ্বাস ও কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ। বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ— সব ক্ষেত্রেই ভারতকে সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের প্রভাব ঠেকাতে হিমশিম খেতে হয়েছে। এমন অবস্থায় যুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হলে ভারতকে এই কূটনৈতিক ফ্রন্টগুলোতে বিরাট চাপের মুখে পড়তে হতে পারে।
তারচেয়ে বরং এখন ভারতের সামনে একটি কৌশলগত সুযোগ রয়েছে— যুদ্ধ নয়, আন্তর্জাতিক জনমতকে ব্যবহার করে পাকিস্তানের ওপর কূটনৈতিক চাপ বাড়ানো। পেহেলগামের বর্বর হামলা এক ভয়াবহ মানবিক ট্র্যাজেডি, যার নিন্দা আন্তর্জাতিক মহল সর্বসম্মতভাবেই করেছে। ভারত যদি এই আঘাতের জবাবে সংযত থাকে এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় পাকিস্তানকে বাধ্য করতে পারে জঙ্গি নেটওয়ার্ক দমনে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে, তবে সেটিই হবে প্রকৃত বিজয়। কারণ, জঙ্গিবাদ শুধু সামরিক নয়— একটি কূটনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ। সেখানে শক্তি যেমন প্রয়োজন, তেমনি প্রয়োজন কৌশল, ধৈর্য ও আন্তর্জাতিক সমর্থন।
এই মুহূর্তে ভারতের করণীয়গুলো কেবল প্রতিক্রিয়ামূলক নয়, বরং তা হতে হবে কৌশলগত, দায়িত্বশীল ও আন্তর্জাতিক বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। জাতিসংঘের মাধ্যমে একটি নিরপেক্ষ ও শক্তিশালী আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি গঠন করা জরুরি, যার কাজ হবে হামলার প্রকৃত উৎস ও কারা এর নেপথ্যে তা নির্ধারণ করা। পাকিস্তানও এরকম একটি তদন্ত কমিটি করার জন্যই সুপারিশ করেছিল শুরুতে। এই তদন্ত যেন শুধু রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর না হয়ে প্রমাণ ও তথ্যের ভিত্তিতে হয়।
কিন্তু এই উদ্যোগ ব্যর্থ হবে, যদি ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যুদ্ধকে একটি নির্বাচনি ইস্যুতে পরিণত করে। অনেকেই বলছেন, ভারতের এই যুদ্ধ-রাজনীতি আসলে অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি থেকে জনগণের দৃষ্টি অন্যদিকে সরানোর চেষ্টা। রাজনৈতিক নেতারা যদি ভোট-রাজনীতির সুবিধার্থে যুদ্ধোন্মাদনার বারুদ ছড়ান, তাহলে পুরো কৌশল ভেঙে পড়বে। এক শ্রেণির সংবাদমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ইতোমধ্যেই এমন উত্তেজনা ছড়াতে শুরু করেছে, যা বাস্তব নীতির চেয়ে আবেগে অনেক বেশি চালিত। এই অবস্থা খুব দ্রুতই জনমনকে উত্তপ্ত করে তোলে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে তা দেশের কূটনৈতিক ও মানবিক অবস্থানকে দুর্বল করে দেয়। একমাত্র গণতান্ত্রিক সংবেদনশীলতা, পরিণত নেতৃত্ব এবং যুক্তিনিষ্ঠ মূল্যায়নের মাধ্যমেই এই আবেগনির্ভর বিপথগামীতা রোধ করা সম্ভব— এবং সেটাই আজকের ভারতের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক পরীক্ষার জায়গা।
আরেকটি কথা, পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলা শুধু একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং কাশ্মীরের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ও সামাজিক জটিলতার প্রতিফলন। বিশেষ ধারা বাতিল, কেন্দ্রীয় শাসন জারি, নিরাপত্তা বাহিনীর উপস্থিতি বাড়ানো—এসব পদক্ষেপে হয়তো প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ শক্তিশালী হয়েছে, কিন্তু মনের ভেতরে জমে থাকা বঞ্চনা, অবিশ্বাস ও বিচ্ছিন্নতার অনুভূতি দূর হয়নি। যুগের পর যুগ ধরে কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের নাগরিক অধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং আত্মপরিচয়ের দাবি যেভাবে উপেক্ষিত হয়েছে, তাতে একটা গোটা প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে সংশয়ের ভেতরে। পাকিস্তান নিশ্চয়ই সমস্যা ঘনীভূত করেছে, কিন্তু একে শুধু বাইরের ষড়যন্ত্র বলে দায় ঝেড়ে ফেললে সমস্যার মূলে পৌঁছানো যাবে না। ভারত যদি সত্যিই চায় কাশ্মীরের মানুষ হৃদয় দিয়ে ভারতীয় হয়ে উঠুক, তাহলে শুধু বাহুবলে নয়— সহমর্মিতা, আত্মসমালোচনা আর আস্থার ভিত্তিতে সম্পর্ক গড়তে হবে। নিরাপত্তার নামে প্রতিনিয়ত অবিশ্বাসের পরিবেশ তৈরি করলে জাতীয়তাবাদের স্লোগানেও ওই শূন্যতা পূরণ হয় না।
যুদ্ধ মানে কেবল শত্রুকে জবাব দেওয়া নয়— তা এক কঠিন ভারসাম্যের খেলা, যেখানে প্রতিটি লাভের সঙ্গে লুকিয়ে থাকে বহু অদৃশ্য ক্ষতি। সাময়িক প্রতিশোধ বা শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে জাতীয় আত্মমর্যাদা রক্ষা করা গেলেও, দীর্ঘমেয়াদে প্রশ্ন উঠে আসে— কী পেল ভারত এই যুদ্ধ থেকে? হয়তো সীমান্তে কিছু সাফল্য, হয়তো আঞ্চলিক বার্তা, কিন্তু তার বিনিময়ে এসেছে অর্থনৈতিক চাপ, কূটনৈতিক অস্বস্তি, এবং সবচেয়ে বড় ক্ষতি—নাগরিক জীবনের নিরাপত্তা ও শান্তির ঘাটতি।
ভারতের অর্থনীতি এই মুহূর্তে এক রূপান্তরের পথে, যেখানে প্রতিটি বাজেট, প্রতিটি বিনিয়োগ, প্রতিটি যুবকের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে স্থিতিশীলতার ওপর। যুদ্ধ ওই স্থিতিশীলতার সবচেয়ে বড় শত্রু। আন্তর্জাতিক মহলে ভারতের অবস্থান আজ যেখানে—জি২০-এর নেতৃত্ব, দক্ষিণে একটি আঞ্চলিক শক্তি, ব্রিকস বা কোয়াডের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য— ওই উচ্চতায় উঠেও যদি যুদ্ধই একমাত্র কূটনৈতিক ভাষা হয়ে দাঁড়ায়, তবে তা হবে এক বিপরীতমুখী যাত্রা।
এই প্রেক্ষাপটে ভারতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ নিজেকে সংযত রেখে পরিণত রাষ্ট্রের ভূমিকা পালন করা, যে কেবল অস্ত্রের ভাষা বোঝে না— বোঝায়ও। সীমিত প্রতিরক্ষা হোক প্রয়োজনীয়, কিন্তু কূটনৈতিক সংলাপ হোক অনিবার্য। ইতিহাস বলে, শেষপর্যন্ত সবাই চুক্তির টেবিলেই ফেরে। প্রশ্ন হলো, কেন ওই টেবিলে পৌঁছাতে রক্ত, আগুন ও কান্নার পথ ধরে হাঁটতে হবে?