Published : 09 May 2025, 09:21 PM
বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ধর্মীয় উগ্রবাদ এক ভয়াবহ বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সময়ের পরিক্রমায় বারবার দেখা গেছে, যখনই রাজনৈতিক অস্থিরতা চরমে ওঠে, তখনই উগ্রবাদী শক্তির বিস্তার ঘটে। এই প্রেক্ষাপটে মাস দেড়েক আগে দেওয়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বক্তব্য বেশ প্রাসঙ্গিক এবং গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। গত ১৯ মার্চ রাজধানীর ইস্কাটন লেডিস ক্লাবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সম্মানে আয়োজিত ইফতার মাহফিলে ভার্চ্যুয়ালি প্রধান অতিথির বক্তব্যে তারেক রহমান মন্তব্য করেছিলেন, দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিলে গণতন্ত্রের কবর রচনা হবে। এতে দেশ ইমেজ সংকটে পড়বে।
তারেক রহমান বলেন, ধর্মীয় উগ্রবাদী ও চরমপন্থীদের প্রতিহত করতে হবে। একইসঙ্গে গণহত্যাকারীদের বিচার করাই হবে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত। নির্বাচন না দেওয়ার কারণেই ফ্যাসিস্টদের চরমভাবে বিদায় নিতে হয়েছে। তাই নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। তিনি উল্লেখ করেন, সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা ও কিছু রাজনৈতিক দল ভিন্ন সুরে কথা বলছে। জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করে গৌণ উদ্দেশ্যকে প্রাধান্য দিলে জনগণের কাছে ভুল বার্তা যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের ওই বক্তব্যের দেড় মাস পরেও পরিস্থিতি একই রকম আছে। বলা চলে পরিস্থিতির কিছুটা অবনতি ঘটেছে। দেশের রাজনীতির এক চলমান সংকটকেই নতুনভাবে সামনে তুলে এনেছিলেন তারেক রহমান। তার বক্তব্যের মূল প্রতিপাদ্য ছিল— ধর্মীয় উগ্রবাদ মাথাচাড়া দিলে গণতন্ত্রের কবর রচিত হবে। তিনি সতর্ক করে বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের যদি ব্যর্থতা দেখা দেয়, তবে উগ্রবাদী শক্তি এবং গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তি পুনরায় দেশে কর্তৃত্ব স্থাপন করতে পারে।
তারেক রহমানের বক্তব্য তার নিজের দল কতটা গ্রহণ করেছে, তা ভবিষ্যৎ বলবে। তার এই বক্তব্য শুধু রাজনৈতিক বয়ান নয়, বরং বাস্তবতার নিরিখে গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলাদেশের ইতিহাস ঘাঁটলে আমরা দেখতে পাই, ধর্মীয় উগ্রবাদ কখনোই আকস্মিকভাবে মাথাচাড়া দেয়নি বা দেয় না, বরং এটি এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ফসল। পাকিস্তান আমলে সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিস্তার, ১৯৭১ সালের পরেও থামেনি,বরং স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের পুনর্বাসিত করা হয়েছে। এর পর থেকে ধারাবাহিকভাবে জঙ্গিবাদের উত্থান এবং সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠীর সঙ্গে ধর্মীয় চরমপন্থীদের সখ্য— এসবই প্রমাণ করে যে, রাষ্ট্রীয় অব্যবস্থাপনা ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের প্রবণতা উগ্রবাদের বিস্তারের পথ প্রশস্ত করেছে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বাস্তবতায় ধর্মীয় চরমপন্থার বিপজ্জনক প্রভাব বিশেষভাবে স্পষ্ট। তারেক রহমানের বক্তব্যে উল্লেখ করা হয়েছে, অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষতা হারালে এবং সময়ক্ষেপণ করলে, উগ্রবাদীদের পুনরুজ্জীবিত হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এটি নিছক তার ব্যক্তিগত অনুমান নয়, বরং অতীতের অভিজ্ঞতায় এটা বহুবার প্রমাণিত সত্য।
১৯৭৫-পরবর্তী সময়ে উগ্রবাদী রাজনীতির থাবা বিস্তৃত হতে শুরু করে, তেমনি ২০০১ সাল থেকে জঙ্গিগোষ্ঠীর কার্যক্রম ভয়াবহ রূপ নেয়। হরকাতুল জিহাদ, জেএমবি, আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ বিভিন্ন জঙ্গিগোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছিল তখন। আবার ২০১৩ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যবর্তী সময়ে উগ্রবাদীদের হাতে বেশ কয়েকজন ধর্মনিরপেক্ষ ব্লগার, লেখক ও অধিকারকর্মী হত্যার ঘটনা ঘটে। ২০১৬ জুলাই মাসে ঘটে হলি আর্টিজান বেকারির নৃশংস হামলার ঘটনা। এর পরবর্তী বছরগুলোতেও চলতে থাকে উগ্রবাদী গোষ্ঠীর নানা তৎপরতা। সাম্প্রতিক সময়ে পেহেলগামে পর্যটকদের হত্যা, পরিণতিতে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধ বেধে যাওয়াসহ দেশে-বিদেশে নানা উগ্রবাদী কার্যক্রম আবারও চোখে পড়ছে, যা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য হুমকি হয়ে উঠতে পারে।
তারেক রহমানের বক্তব্যে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা ও তাদের দায়িত্ব নিয়ে যে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, সেটিও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস বলে, যখনই কোনো সরকার নিরপেক্ষতা হারায় বা স্বচ্ছতার অভাব দেখা দেয়, তখনই রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়। এটি কেবল দেশে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তারেক রহমান আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন যে, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে, তা গণতন্ত্রের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে এবং উগ্রবাদীদের শক্তি সঞ্চয়ের সুযোগ তৈরি হবে।
দেশের একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় বসেছে। এই সরকারের প্রধান কাজ হলো সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করা। কিন্তু যদি এই সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব ঘটায়, তবে জনগণের আস্থার সংকট দেখা দেবে। বাংলাদেশে এর আগেও বিভিন্ন সময়ে আমরা দেখেছি, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের স্বার্থ রক্ষায় গণতন্ত্রের কথা বলে একনায়কতন্ত্রের পথে হেঁটেছে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে যদি জনগণের প্রত্যাশাকে উপেক্ষা করে নতুন কোনো রাজনৈতিক সমীকরণ তৈরির চেষ্টা হয়, তবে সেটি দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে।
তারেক রহমানের বক্তব্যে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক উঠে এসেছে— রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা। তিনি উল্লেখ করেছেন, ভিন্ন মতাদর্শের রাজনৈতিক দলগুলো একত্রে বসতে পারছে, যা বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ইতিবাচক দিক। কিন্তু বাস্তবতা হলো, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক বিভাজন ও বিদ্বেষ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ধারা নষ্ট করেছে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে দীর্ঘদিন ধরে যে রাজনৈতিক শত্রুতা বিদ্যমান, তা গণতন্ত্রকে ক্রমাগত দুর্বল করেছে। এর ফলে সুযোগ পেয়েছে উগ্রবাদী শক্তি।
তারেক রহমান গণতন্ত্রের পক্ষে শক্ত অবস্থানের কথা বললেও, তার দলে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মিশ্রণ কতটা গণতান্ত্রিক আদর্শের অনুকূলে, ওই প্রশ্ন থেকেই যায়। বাংলাদেশের গণতন্ত্র বহুবার সংকটের মুখে পড়েছে। সামরিক শাসন, স্বৈরাচার, নির্বাচনি প্রহসন, রাজনৈতিক সহিংসতা— এসব কারণে গণতন্ত্র বারবার প্রতারিত হয়েছে। এখন যদি রাজনৈতিক দলগুলো ধর্মীয় উগ্রবাদ মোকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ না হয়, তবে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা থেকেই যাবে।
তারেক রহমানের বক্তব্যের সারমর্ম হলো, গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর দায়িত্বশীলতা বাড়াতে হবে, অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা রক্ষা করতে হবে এবং ধর্মীয় উগ্রবাদীদের রাজনৈতিক মদদ বন্ধ করতে হবে। এটি কতটা বাস্তবায়িত হবে, তা সময়ই বলে দেবে। তবে একটি বিষয় স্পষ্ট— যদি রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে উগ্রবাদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে গণতন্ত্র হুমকির মুখে পড়বে, আর বাংলাদেশ আরও এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে ধাবিত হবে।
এজন্য ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা দূর করতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে, বিশেষ করে রাজনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে। এই ধরনের অনিশ্চয়তা সাধারণত রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক দুরাবস্থা, ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং সামাজিক বিভাজন থেকে সৃষ্টি হয়। এগুলোর মোকাবিলা করতে সুনির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, যা দেশে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়ন নিশ্চিত করতে সাহায্য করবে।
প্রথমত, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি। এটি করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে খোলামেলা ও গণতান্ত্রিক সংলাপ বাড়াতে হবে। রাজনৈতিক বিরোধিতা থাকা সত্ত্বেও যদি দলগুলো জনগণের স্বার্থে একসঙ্গে কাজ করতে পারে, তবে তা দেশের ভবিষ্যৎকে অনেকাংশে স্থিতিশীল করতে সাহায্য করবে। এজন্য নিরপেক্ষ নির্বাচনি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়ে দেশের নেতৃত্ব নির্বাচন করতে পারে। যদি নির্বাচন প্রক্রিয়া সুষ্ঠু এবং সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তাহলে জনগণের আস্থা এবং বিশ্বাস সরকারের প্রতি বাড়বে এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা কমবে।
দ্বিতীয়ত, ধর্মীয় উগ্রবাদ এবং চরমপন্থা মোকাবিলা করতে সামাজিক ও ধর্মীয় সচেতনতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন স্তরে কাজ করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন, বিশেষ করে ধর্মীয় বিষয়গুলো নিয়ে প্রকৃত এবং মুক্তচিন্তার ধারণা শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন।
তৃতীয়ত, অর্থনৈতিক সমতা ও উন্নয়নও নিশ্চিত করতে হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতি যদি দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং বৈষম্যের মোকাবিলা করতে না পারে, তবে এর ফলে সামাজিক অস্থিরতা বাড়তে পারে, যা ভবিষ্যতে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি করবে। এজন্য দেশের অর্থনৈতিক নীতি ও পরিকল্পনাগুলোকে জনগণের কল্যাণের দিকে মনোযোগী করতে হবে। ছোট ও মাঝারি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর উন্নয়ন, কৃষি ও শিল্প খাতের আধুনিকীকরণ এবং কর্মসংস্থানের সুযোগ বাড়ানো খুবই জরুরি।
চতুর্থত, আইন ও মানবাধিকার রক্ষা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি জনগণের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত না করা হয় এবং বিচার ব্যবস্থা অবাধ ও নিরপেক্ষ না থাকে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা সম্ভব হবে না। এজন্য বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
পঞ্চমত, সামাজিক একতা এবং জাতীয় পরিচয় বৃদ্ধি করতে হলে সব জাতি, ধর্ম, ও সম্প্রদায়ের মধ্যে সহাবস্থান এবং একতার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে ধর্মীয় বিভাজনের পথে না হেঁটে তাদের রাজনীতিকে জনগণের কল্যাণে নিবেদিত করতে হবে। সামাজিক বন্ধন মজবুত করা হলে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশ স্থিতিশীল হবে।
মোট কথা, গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি রক্ষা করা, জনগণের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা রাখা এবং ক্ষমতার মীমাংসা নিরপেক্ষভাবে করা বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হবে। এসব উপাদান একত্রে কাজ করলে, দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে অনিশ্চয়তা অনেকটা কমে যাবে এবং একটি শক্তিশালী, স্থিতিশীল এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে উঠবে। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলো কথায় ও কাজে এক না হলে এসবের কিছুই হবে না।
আরও পড়ুন
ধর্মীয় উগ্রবাদ ঠেকাতে না পারলে ফের গণতন্ত্রের কবর হবে: তারেক রহমান