Published : 25 Jun 2025, 06:40 PM
সংরক্ষিত নারী আসনের সংখ্যা ৫০ থেকে ১০০-তে উন্নীত করার বিষয়ে প্রায় সব রাজনৈতিক দলের ঐকমত্য একটি আশাব্যঞ্জক ঘটনা। তবে, কোন পদ্ধতিতে এই আসনগুলো নারীদের জন্য নিশ্চিত করা হবে, তা নিয়ে রয়েছে তীব্র মতবিরোধ। বিভিন্ন পক্ষ থেকে প্রস্তাবিত মতামতের বৈচিত্র্য স্বাভাবিক হলেও, নাগরিক কোয়ালিশনের একাধিক বৈঠকেও এ বিষয়ে কোনো সমাধান মেলেনি। ফলে বলতেই হয়, অনেক দল সনাতন পদ্ধতিকে দলীয় স্বার্থের কারণে সংস্কারের সুযোগ দিতে নারাজ।
নারী আসন নিয়ে আলোচনা নতুন নয়। ১৯৭২ সালের সংবিধানে পরবর্তী ১০ বছরের জন্য সংসদে নারীদের জন্য ১৫টি সংরক্ষিত আসনের কথা বলা হয়েছিল। পরে বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে এই সংখ্যা ৩০, ৪৫ এবং সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে ৫০ করা হয়। ৩০০ আসনের নির্বাচনে প্রাপ্ত আসনের অনুপাতে সরকার ও বিরোধী দল তাদের মনোনীত নারীদের আসন দিতে পারে। তবে, মেয়াদ না বাড়ানোর কারণে ২০০০ সালে সংরক্ষিত নারী আসন বিলুপ্ত হয়েছিল, যা পরে পুনর্বহাল করা হয়। এই সংক্ষিপ্ত সময় ও কার্যক্রম থেকেই বোঝা যায়, নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন নেতৃত্ব গঠনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেনি; বরং প্রায়শই দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। এই কোটা পদ্ধতিকে সংস্কার করা না গেলে, বিলুপ্ত করাই উত্তম, কারণ বাইরে থেকে এটি লিঙ্গভিত্তিক অলঙ্করণ মনে হলেও, অন্তর্নিহিতভাবে এটি চাটুকারিতা ও রাজনৈতিক আনুগত্যের প্রকাশ।
জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের উদ্যোগে নবগঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) এরই মধ্যে নানান সমালোচনায় বিদ্ধ হলেও নারী আসন নিয়ে তাদের অবস্থান প্রশংসনীয়। তারা চায়, নারী আসনের উদ্দেশ্য শুধু প্রতীকী ক্ষমতায়ন নয়, বরং তৃণমূল পর্যায় থেকে জবাবদিহিতার মাধ্যমে নারী নেতৃত্বের কাঠামো গড়ে তোলা। তবে, এটি কাগজে-কলমে যতটা আকর্ষণীয়, বাস্তবায়নে রয়েছে নীতিগত ও আলোচনামূলক বাধা। এখনই কোনো সমাধানমূলক মন্তব্য করা সম্ভব নয়, কারণ প্রতিটি প্রস্তাবই প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার মতো ক্ষেত্র রয়েছে। তবে, সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে কিছু বিষয়ে নজর রাখা ও আলোচনা জরুরি।
নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে আলোচনা সমাজে একটি ছোটখাটো ধাক্কা দেয়। ঐকমত্য কমিশনের প্রস্তাবনায় আসন বৃদ্ধি ও কার্যকর নেতৃত্ব গঠনের উদ্যোগেও এমনটি দেখা যাচ্ছে। তবে, সংস্কারের প্রশ্নে বিতর্ক থাকবেই। কেউ কেউ সংসদে মমতাজের গান গাওয়া বা অন্য নারী সাংসদদের নিষ্ক্রিয়তার কথা তুলে ধরেছেন। আবার কেউ বলছেন, আসন বৃদ্ধি মানে ৩০০ আসনে লুটপাটের পরিবর্তে ৪০০ আসনে লুটপাট। এই ধরনের বয়ানের যথোপযুক্ত জবাব দিতে হলে নারী নেতৃত্বের ভিত্তি শক্ত করতে হবে। আনুষ্ঠানিকভাবে আইন পাশ বা মনোনয়ন বাধ্যতামূলক করা যায়, কিন্তু এর মূল ভিত্তি রাজনৈতিক দলগুলোর হাতে।
আজকের দিনে এসেও নারী নেত্রীদের ‘খাটকর্মী’ বলে গালি দেওয়া হয়। ব্যক্তিজীবনে সফল কেউ নতুন করে রাজনীতিতে আসতে চাইলে তাকে চরম চরিত্রহননের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিয়ে, প্রেম বা ইমেজ নিয়ে মব তৈরির ঘটনা দীর্ঘদিন ধরে চলছে। এ যেন সীতার অগ্নিপরীক্ষা! রাস্তায় নামার আগেই চরিত্র পরীক্ষা নেয় কিছু স্বঘোষিত ‘নীতি পুলিশ’। এমন পরিস্থিতিতে নেতৃত্ব গড়ে ওঠা তো দূর, অধিকার আদায়ে পথে নামার আগেই অনেকে পিছিয়ে যান। এখানে রাজনৈতিক দলের পৃষ্ঠপোষকতার বিকল্প নেই। একজন নারী কমরেডই আরেকজনের পথ সুগম করতে পারেন। তৃণমূল থেকে অভিজ্ঞতা নিয়ে পোড়খাওয়া নেতৃত্ব গড়ে ওঠে, যা শুধু কোটা বা মনোনয়ন দিয়ে হয়তো কিছু এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে, কিন্তু এটা একমাত্র উপায় নয়।
স্থানীয় নির্বাচন এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ। যেখানে সংরক্ষিত আসন থাকলেও যোগ্য নারী প্রার্থী পাওয়া যায় না। মনোনয়ন পান পারিবারিক সূত্রে রাজনীতি করা অনভিজ্ঞ কেউ, যাকে পরিচালনা করেন রাজনৈতিক ‘জ্ঞানসম্পন্ন আত্মীয়’। বর্তমান ৫০টি সংরক্ষিত আসনেও একই চিত্র। মনোনয়ন দেওয়া হয় দলীয় নির্ভরতা, আনুগত্য ও চাটুকারিতার ভিত্তিতে। এতে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয় না, বরং নিষ্ক্রিয়তার স্বাক্ষর রাখে। তৃণমূল থেকে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে নারী নেতৃত্ব গড়ে তুললে এই আসনগুলো শুধু অলঙ্করণ নয়, জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরি করবে।
নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সদস্য জাহেদ উর রহমান একটি টকশোতে বলেছিলেন, উদ্দেশ্য যখন নারীর ক্ষমতায়নের তখন কোনো ধরনের কোটা কোনো কাজে আসবে না—যতদিন না রাজনৈতিক দলগুলো সর্বান্তকরণে এ বিষয়ে সদিচ্ছা পোষণ করবে। তখন ‘নারী অবলা হেতু কোটা’—এই অপবাদ ঘুচবে। এরশাদ আমলে, তখন সংসদে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনের সংখ্যা ছিল ৩০টি। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ওই ৩০ জনের মনোনয়ন নিয়ে তুমুল সমালোচনা হয়েছিল। সে সময়ের জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ‘যায়যায়দিন’ এ নিয়ে প্রতিবেদনের শিরোনাম দিয়েছিল– ‘সংসদের শোভা ত্রিশ সেট অলঙ্কার!’ এরশাদ পত্রিকাটি নিষিদ্ধ করেছিলেন, নারীকে অবমাননা করা হয়েছে এমন অভিযোগ এনে। প্রকৃতপক্ষে এ প্রতিবেদনটিতে নারীকে অবমাননা নয়, যাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল তাদের অযোগ্যতা নিয়ে। স্বনামধন্য সাংবাদিক শফিক রেহমান সম্পাদিত ‘যায়যায়দিন’ এরশাদের শাসনামলে দুবার নিষিদ্ধ হয়েছিল, তার স্বৈরাচারী কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে। সংসদের শোভা ত্রিশ সেট অলঙ্কারের সংখ্যাটির কার্টুননির্ভর প্রচ্ছদ একেঁছিলেন বিখ্যাত শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী।
নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশন প্রস্তাব দিয়েছে, ৩০০ আসনের সাধারণ নির্বাচনের পাশাপাশি আরও ৩০০ আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত রাখতে। তবে, এই ৩০০ আসন কোটার মাধ্যমে পাওয়া আসন, যা ক্ষমতায়নের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করবে কিনা তা সন্দেহ রয়েই যায়। কোটার উদ্দেশ্য এমন হওয়া উচিত নয় যে, নারীকে ‘পিছিয়ে পড়া’ হিসেবে সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ১৯৭২ সালের ১৫টি আসন বা ২০০১ সালের বিএনপির ইশতেহারের লক্ষ্য ছিল কোটা দিয়ে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে ধীরে ধীরে এই পদ্ধতি হ্রাস করা। কিন্তু ইতিহাস বলছে, কোটার হার কমেনি, বরং বেড়েছে। আগামী ত্রয়োদশ নির্বাচনে নারী আসন ১০০-এ বাড়ানো হলেও, লক্ষ্য থাকা উচিত ধীরে ধীরে এই ‘সংরক্ষিত আসন’-এর চিন্তাটাই বিলুপ্ত করা। কারণ, ততদিনে নারী নেতৃত্ব আর উপেক্ষিত থাকবে না, নারীরা প্রত্যক্ষ নির্বাচনে অংশ নিয়ে তার বিরোধী ক্যান্ডিডেটকে টেক্কা দিয়ে আসন জিতে নেবে।
এই চিন্তা আপাতদৃষ্টিতে অলীক মনে হলেও, এর কাছাকাছিও পৌঁছানোর পথটা বেশ দীর্ঘ। যে সমাজে নারীকে শুধু দেহসর্বস্ব ও কম বুদ্ধিসম্পন্ন মনে করা হয়, সেখানে সমানে সমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে অনেক বাধা পেরোতে হবে। সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও অনলাইন মবিং মোকাবিলায় ইতিবাচক বৈষম্যের মাধ্যমে বিদ্যমান বৈষম্য দূর করা প্রয়োজন। গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা দক্ষতা অর্জন করলেও সামাজিক ও পারিবারিক দায়িত্বের কারণে তা বজায় রাখতে পারেন না। উদাহরণস্বরূপ, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় ৬৩শতাংশ মেয়ে চান্স পেলেও, ৪০শতাংশ মহিলা ডাক্তার পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন।
উন্নত বিশ্বে নারী নেতৃত্বের হার আমাদের তুলনায় অনেক বেশি। ভারত, নেপাল ও রুয়ান্ডায় সংবিধান অনুযায়ী ৩০ শতাংশ -৩৩ শতাংশ মনোনয়ন বাধ্যতামূলক। নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনও ৩৩ শতাংশ মনোনয়ন বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে, সমালোচনা রয়েছে, এতে কম জনপ্রিয় আসনে নারীদের মনোনয়ন দেওয়া হতে পারে। ঘূর্ণায়মান মনোনয়ন পদ্ধতির প্রস্তাব এলেও, বিএনপির রুমীন ফারহানাসহ বিশ্লেষকরা মনে করেন, এতে পারিবারিক ‘পাপেট’ প্রার্থীর পথ খুলবে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন উদাহরণ বিরল নয়।
সবশেষে, বর্তমান প্রস্তাবনা ও মতবিরোধ একটি ইতিবাচক বার্তা দেয়। সামাজিকভাবে চিন্তা করলে দেখা যায়, যেকোনো সংস্কার ধীরে ধীরে জলবায়ুর মতো বাস্তবায়িত হয়। সব রাজনৈতিক দল যদি স্বচ্ছভাবে বিতর্ক চালিয়ে যায়, তাহলে প্রহসন বা একতরফা রাজনীতি ফিরবে না। বলা হয়েছে, আগামী জুলাইয়ের বৈঠকে নারী আসন বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানানো হবে। আশা করা যায়, যে পদ্ধতিই গ্রহণ করা হোক, তা নারীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও জবাবদিহিতার মাধ্যমে স্বচ্ছ নেতৃত্বের সূচনা করবে।